সেই দিনগুলোর কথা কেউই ভোলেননি৷ ভুলতে পারেননি৷ কারণ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগই ছিল সবচেয়ে বেশি৷ ৮ নভেম্বর ২০১৬৷ প্রধানমন্ত্রী আচমকা ঘোষণা করে দিলেন, পাঁচশো এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল করা হয়েছে৷ মানুষের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল৷ ছেলে কোলে মা ছুটছেন, দোকানের ঝাঁপ ফেলে দোকানদার ছুটছেন, কাজ ফেলে শ্রমিক ছুটছেন, চাষ ফেলে চাষি৷ সকলেই ছুটছেন এক ব্যাঙ্ক থেকে আর এক ব্যাঙ্কে৷ যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়৷ দীর্ঘ লাইন৷ সবাই দাঁড়িয়ে আছেন ঘন্টার পর ঘন্টা৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাঙ্কে টাকা শেষ৷ কেউ অভিশাপ দিচ্ছেন সরকারকে, আবার কেউ প্রধানমন্ত্রীর কথায় বিশ্বাস রেখে বলছেন, একটু কষ্ট হলেও হয়ত শেষ পর্যন্ত ভালই হবে৷ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কালো টাকার মালিকদের আর রেহাই নেই৷ সবার হাতে হাতকড়া পড়বে৷ বলেছেন, জাল নোটের দিন শেষ হল৷ শেষ হল সন্ত্রাসবাদের দিন, এবার তাদের টাকার জোগান বন্ধ হবে৷ এমনি করে চলল দিনের পর দিন৷ লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন বহু মানুষ, মারা গেলেন একশোর বেশি৷ সংসার চালাতে হিমসিম খেলেন কত মানুষ৷ নগদের অভাবে চিকিৎসা সংকট দেখা দিল বহু সংকটাপন্ন রোগীর৷ ঝাঁপ বন্ধ হল হাজার হাজার ছোট শিল্প কারখানার৷ ছাঁটাই হলেন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক–কর্মচারী৷ তারপর আরও দু’বছর কেটে গেছে? কী দাঁড়িয়েছে নোট বাতিলের ফল? কালো টাকার কারবারিরা ধরা পড়েছে? গ্রেফতার হয়েছে তাদের একজনও? দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে? জাল নোট বন্ধ হয়েছে? সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম বন্ধ হয়েছে?
সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাদের ২০১৭–’১৮ বার্ষিক রিপোর্টে জানিয়েছে, বাতিল হওয়া নোটের ৯৯.৩ শতাংশই তাদের কাছে ফিরে এসেছে৷ যার মোট পরিমাণ ১৫.৩১ লক্ষ কোটি টাকা৷ বাতিলের সময়ে এই দুই নোটের পরিমাণ ছিল ১৫.৪১ লক্ষ কোটি টাকা৷ বাকি থাকল মাত্র ১০,৭২০ কোটি টাকা৷ এরও বেশিরভাগটা রয়েছে নেপাল এবং ভুটানে, যেখান থেকে বাতিল নোট ফেরত নেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার৷ নতুন নোট ছাপতেই সরকারের খরচ হয়ে গেছে ১২,৮৭৭ কোটি টাকা, যা আসলে জনগণেরই দেওয়া করের টাকা৷ তা হলে নোট বাতিলে লাভটা হল কী? কালো টাকা গেল কোথায়? এত দুর্ভোগের পর জনগণ কী পেল?
সরকার বলেছিল কালো টাকার মালিকেরা ব্যাঙ্কে তাদের কালো টাকা জমা দেওয়ার সাহসই দেখাবে না৷ বাস্তবে সমস্ত টাকাই ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে৷ অর্থাৎ নোট বাতিলের সুযোগে কালো টাকার মালিকরা তাদের কাছে নগদে থাকা সমস্ত কালো টাকাই সাদা করে নিয়েছে৷ এই সুযোগ করে দেওয়াই ছিল মোদি সরকারের আসল উদ্দেশ্য৷ সরকার জানিয়েছিল, অন্তত তিন লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় আর ফিরবে না৷ কীসের ভিত্তিতে সরকার এ কথা বলেছিল? দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসল উদ্দেশ্য ঢাকার জন্যই কি সরকার এই কথা প্রচার করেছিল? বিজেপি নেতারা যদি এই অভিযোগ অস্বীকার করেন তবে বলতে হয় এত বড় নিষ্ফলা একটি সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর খামখেয়ালেই নেওয়া হয়েছিল৷ যা তাঁর চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং অপরিণামদর্শিতার পরিচয়৷
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে কালো টাকা নেই, এ কথা তো সত্যি নয়৷ ইউপিএ সরকারের নির্দেশে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি ভারতের কালো অর্থনীতি বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল৷ ২০১৩ সালে সরকারের হাতে তা জমা পড়ে৷ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, কংগ্রেস কিংবা বিজেপি কেউই সেই রিপোর্টটি সংসদে পেশ করেনি৷ একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্র রিপোর্টটির ভিতরের খবর প্রকাশ করে বলে, ভারতের সামগ্রিক উৎপাদন যত দেশের কালো টাকার পরিমাণ তার চার ভাগের তিন ভাগ৷ তা হলে সেই কালো টাকা গেল কোথায়?
নোট বাতিলের সময়েই এস ইউ সি আই (সি) বলেছিল, যারা কালো টাকার কারবারি, বড় বড় শিল্পপতি, পুঁজিপতি, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক দলের নেতা, তারা কেউ কালো টাকা বাড়িতে নগদে জমিয়ে রাখে না৷ জমি–বাড়ির ব্যবসায় খাটায়, বাড়ি–গাড়ি, সোনা কিনে রাখে, শেয়ার বাজারে খাটায়, ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থায় বিনিয়োগ করে৷ বিরাট একটা অংশ ব্যাংক কিংবা হাওয়ালার মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে দেয়৷ প্রোমোটার, ব্যবসাদার, ঘুষখোর, কালোবাজারিদের নগদ টাকা যা থাকে তাও তারা দ্রুত সরিয়ে ফেলার তথা অন্য মাধ্যমে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে৷ তখনই সংবাদে প্রকাশ পেয়েছিল, নোট বাতিলের ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা হাওয়ালায় বুকিং হয়ে গেছে৷ সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত সোনার দোকানগুলিতে ভিড় করে এরা সোনা কিনেছে৷ সোনার দোকানদাররা আগের দিনের তারিখে বিল কেটেও সোনা বিক্রি করেছে৷ দেশ জুড়ে সেদিন কয়েক ঘন্টায় শত শত কোটি টাকার সোনা এবং সোনার গহনা বিক্রি হয়েছে৷ এই ভাবেই মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সাদা হয়েছে৷ এ সব কোনও কিছুই তো সরকারের অজানা নয়৷ কালো টাকা ধরাই যদি সরকারের সত্যিকারের উদ্দেশ্য হত তা হলে তো এদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিত৷ কেন তা নেওয়া হল না? এর বাইরেও কালো টাকা যা ছিল তা নানা ভাবে ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছে কালো টাকার মালিকরা৷ দেখা গেছে, গুজরাটের সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে– যেগুলির বেশির ভাগেরই ডিরেক্টর বিজেপি নেতারা, সেখানে জমা পড়েছে বিপুল পরিমাণ বাতিল নোট৷ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ যে ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর সেই সমবায় ব্যাঙ্কে জমা পড়া বাতিল নোটের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা৷
নকল নোট বন্ধের যে উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন স্বাভাবিক ভাবেই তা–ও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, ২০১৭–’১৮ তে নতুন পাঁচশো টাকার জাল নোট আটক হয়েছে ৯৮৯২টি, নতুন দু’হাজার টাকার জাল আটক হয়েছে ১৭,৯২৯টি৷ ধরা যায়নি এমন নোটের সংখ্যাও নিশ্চয় অনেক বেশিই হবে৷ এস ইউ সি আই (সি) সেদিনই বলেছিল, ‘‘নোট তৈরির নকশা ও প্রযুক্তি যেভাবে সরকারি দপ্তর থেকে পাচার হয়ে জাল নোটের কারবারিদের হাতে চলে যাচ্ছে তাকে আটকানো এবং প্রশাসন ও গোয়েন্দা বিভাগের একাংশের সাথে জাল নোটের কারবারিদের যে যোগাযোগ এটা বন্ধ না করে, শুধু নোট বাতিল করে জাল নোট আটকানো যাবে না৷’’ (গণদাবী, ৬৯ বর্ষ ১৫ সংখ্যা, ১৮ নভেম্বর ২০১৬)৷ সে কথাই সত্য প্রমাণ হল৷
নোট বাতিলের পর দেশের মানুষ যখন চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তখন প্রধানমন্ত্রী কালো টাকা উদ্ধারের কথা চেপে গিয়ে হঠাৎ দেশকে ক্যাশলেস করার কথা বলতে শুরু করেন৷ তাঁকে দু’হাত তুলে সমর্থন করে দেশি–বিদেশি ডিজিটাল কার্ডের একচেটিয়া কোম্পানিগুলি৷ কারণ, টাটাদের ডোকোমো, আম্বানিদের রিলায়েন্স, জিও, মিত্তালদের এয়ারটেল, ব্রিটেনের ভোডাফোন সকলেরই ইন্টারনেটের ব্যবসা৷ বিল গেটসের কোম্পানি মাইক্রোসফটের কম্পিউটার আর মোবাইলের ব্যবসা৷ নগদবিহীন লেনদেনের জন্য দরকার এইসব কম্পিউটার, স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ৷ যত নগদবিহীন লেনদেন বাড়বে তত এদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠবে৷ এ অভিযোগ তখনই উঠেছিল, কার্ডের ব্যবসায় যুক্ত একচেটিয়া পুঁজির একটি অংশের মুনাফার কথা ভেবেই প্রধানমন্ত্রী এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ কিন্তু যে দেশে বেশির ভাগ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সে দেশে শুধু সরকারি হুইপ জারি করে ভুখা মানুষকে ডিজিটাল করা যে যায় না, গত এক বছরে বাজারে নগদ ৩৭.৭ শতাংশ বেড়ে যাওয়াই তার প্রমাণ৷ শুধু এটিএমে ব্যাপক দুর্নীতিই নয়, ডেবিট ক্রেডিট কার্ডে, ইন্টারনেট লেনদেনে দুর্নীতি এত লাগামছাড়া যে, যাঁরা এইভাবে লেনদেন শুরু করেছিলেন তাঁরাও দ্রুত নগদ লেনদেনে ফিরে আসছেন৷
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ৬০ বছর ধরে মানুষ চাল, চিনি, খাবারের জন্য অনেক লাইন দিয়েছে, এবারে ব্যাঙ্কে বা এটিএমের সামনের লাইন হল ভারত থেকে সমস্ত রকম লাইন শেষ করার লক্ষ্যে শেষবারের লাইন৷ দেশের মানুষ আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বোকা বানিয়েছেন এবং এটিই ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য৷ সেই জন্যই তিনি এত লম্বা–চওড়া বক্তৃতা দিচ্ছিলেন৷
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর নোট বাতিলের পরেই ১৪ নভেম্বর এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–ই প্রথম রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছে, এই ধাপ্পাবাজির স্বরূপ জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরেছে৷ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরদিন ৯ নভেম্বর দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি এবং তার সেবকরাই কালো টাকার জন্ম দেয় এবং তারাই এর সুবিধাভোগী শ্রেণি৷ সরকার যেহেতু তাদেরই গোলামি করে, তাই তাদের বিরুদ্ধে কখনও কোনও পদক্ষেপ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না৷’’ তাতে বলা হয়েছে, ‘‘এই মূল দোষীদের না ধরে, না শাস্তি দিয়ে, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকার পাহাড় উদ্ধার না করে, রাতারাতি নোট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত আসলে সস্তা চমক দিয়ে জনসাধারণকে বোকা বানানো ছাড়া কিছু নয়৷ এর দ্বারা জনগণের একটা বড় অংশকে যেমন বিভ্রান্ত করা যাবে তেমনি সরকারের শয়তানিকে আড়াল করে নির্বাচনী ফায়দা ওঠানোর রাস্তা পরিষ্কার করে, খেটে খাওয়া মানুষকে আরও দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হবে৷’’ দলের এই বক্তব্য আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে৷
শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই প্রতি মুহূর্তে দুর্নীতি এবং কালো টাকার জন্ম দিচ্ছে৷ সেই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে কোনও পদক্ষেপই দুর্নীতি দূর করতে পারে না, কালো টাকার সৃষ্টি বন্ধ করতে পারে না৷ বরং এইসব পদক্ষেপ জনগণকে ধোঁকা দিয়ে শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে আরও বেশি দিন টিকে থাকতেই সাহায্য করবে৷ প্রধানমন্ত্রীর আচরণও দেখিয়ে দিল, এই সরকারগুলি নানা রকমের বাগাড়ম্বরের আড়ালে আসলে পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে তাদেরই স্বার্থরক্ষার কাজ করে চলেছে৷ জনগণ যত দ্রুত শাসক দলগুলির এই চালাকির রাজনীতি ধরতে পারবে ততই শোষণমূলক এই ব্যবস্থার যাঁতাকল থেকে তারা মুক্তি পাবে৷
(৭১ বর্ষ ৬ সংখ্যা ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)