70 Year 29 Issue 9 March 2018
‘নোটবন্দির ফলেই অর্থনীতির ইঞ্জিন বিগড়ে গিয়েছিল’– ২০১৭–১৮ সালের আর্থিক সমীক্ষা পেশ করতে গিয়ে এ কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি৷ নোট বাতিল হয়েছিল ২০১৬ সালের নভেম্বরে৷ এই বোধোদয় হতে তাঁর ১৫ মাস লেগে গেল অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, নোট বাতিলে দেশের সাধারণ মানুষের দুর্দশাই শুধু বেড়েছে৷ কালো টাকার মালিক শিল্পপতিদের গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি৷ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন মার খেয়েছে৷ অর্থনীতি–বিজ্ঞানের অআকখ বুঝলেই এটা বোঝা যেত, যে এমনটাই ঘটবে৷
তাঁরা সে সময় জোরের সাথে বলেছিলেন নোট বাতিলের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে৷ বলেছিলেন, কালো টাকা উদ্ধার হবে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেপাপিদের শায়েস্তা করা হবে, দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ এর সুফল পাবেন– এমন নানা শ্রুতিমধুর প্রতিশ্রুতিতে মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করেছিল৷ নোট বাতিলের ফলে তৈরি হওয়া সংকটে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ এই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ভেবেছিলেন, নিশ্চয় কিছু একটা হবে কী হল? ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু আর গোটা দেশের জনগণের চূড়ান্ত হয়রানি ছাড়া আর কী হয়েছে? নোট বাতিলের পর বছর ঘুরে গেছে, কত কালো টাকা উদ্ধার হল, দেশের মানুষকে তা জানাতেই পারেনি সরকার৷ একজন কালো টাকার কারবারিকেও চিহ্ণিত করতে পারেনি– গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা৷ নোট বাতিলের কোনও সুফলই পেল না ‘ধনী’ সাধারণ মানুষেরা৷ পেল ‘গরিব’ কালো টাকার কারবারিরা৷ তারা তাদের সমস্ত কালো টাকাকে সাদা করে ফেলল৷ উপরন্তু, বাজেটে আড়াইশো কোটি টাকা পর্যন্ত কারবারি কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে করছাড় দেওয়ার ঘোষণা করল সরকার৷ আগে তাদের দিতে হত ৩০ শতাংশ কর, ‘গরিব পুঁজিপতিদের’ দুঃখে সরকার কমিয়ে করল ২৫ শতাংশ৷
কালো টাকা সাদা করার সাম্প্রতিক উদাহরণ গুজরাটের হিরে ব্যবসায়ী নীরব মোদি৷ আম্বানির জামাই বিজেপি ঘনিষ্ঠ এই ব্যবসায়ী পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা লুঠ করে বিজেপি সাংসদ বিজয় মাল্যের মতো অনায়াসে বিদেশে গা ঢাকা দিয়েছেন পরিবার–পরিজন নিয়ে৷ এর আগে তিনি বিজেপি সরকারের নোট বাতিলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সোনা–রুপোর বাট কিনে সমস্ত কালো টাকাই সাদা করেছেন৷ এই সত্য কি অস্বীকার করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও বিজেপির অন্য নেতা–মন্ত্রীরা?
জিএসটি চালুও সাধারণ মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে নয়– এটাও অর্থমন্ত্রী বুঝলেন দেরিতে৷ বলেছেন, ‘জি এস টি চালু হওয়ায় আরও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷’ কিন্তু অনিশ্চয়তা কেন, সরকার সেই অনিশ্চয়তা দূর করতে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? এর কোনও উত্তর অর্থমন্ত্রীর কাছে নেই৷ জিএসটি চালু করতে গিয়ে ‘এক দেশ এক কর নীতি’র স্লোগান তুলেছিল বিজেপি সরকার৷ বলা হয়েছিল, সমস্ত মানুষ একটাই কর দেবে, আগের মতো তাদের নানা রকমের কর গুনতে হবে না৷ বাস্তবে কী হল? কয়েকদিন যেতে না যেতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে শুরু করলেন, জিএসটি একটি অত্যন্ত জটিল করব্যবস্থা৷ বহু ক্ষেত্রেই জিএসটি–র ফলে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চেপেছে মানুষের ঘাড়ে৷ এর মারাত্মক ফল ভুগতে হচ্ছে তাদেরই৷ অর্থনীতিবিদরা বলতে শুরু করেছেন, এ এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত৷
নোট বাতিল ও জিএসটি চালুর ফলে এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে, সাধারণ মানুষের দুর্দশা আরও বাড়বে, এটা কি সরকার ও তাদের মাইনে করা অর্থনীতির পণ্ডিতরা জানতেন না? জানতেন, কিন্তু খোলসা করেননি৷ এস ইউ সি আই (সি) তখনই বলেছিল, নোট বাতিলের দ্বারা কোনও কালো টাকা উদ্ধার হবে না, একজন কালো টাকার মালিকও গ্রেপ্তার হবে না৷ সরকার সত্যিই তা চাইলে এমনিতেই তা করতে পারত, তার জন্য নোট বাতিলের দরকার ছিল না৷
শ্রেণিবিভক্ত এই বুর্জোয়া রাষ্ট্রে যে কোনও আর্থিক সংস্কারই বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে হয়৷ সোজা কথায়, মালিক শ্রেণির সেবাদাস সরকার আর্থিক সংস্কারের মাধ্যমে মালিকদের স্বার্থই রক্ষা করে৷ কিন্তু তা তারা করে জনগণের স্বার্থরক্ষার ঢাক বাজিয়েই৷ দেশের কর্পোরেট পুঁজিপতিদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল জিএসটি চালুর৷ বিজেপিও সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় বসেছিল৷ ফলে নোট বাতিল ও জিএসটি চালুতে লাভ হয়েছে দেশের একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজিপতিদের৷ নোট বাতিলের জেরে গরিব–মধ্যবিত্তদের ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু ও জিএসটি চালুর ফলে করের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ছাড়া কিছুই হয়নি৷ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকে থাকবে, আর তা থেকে উদ্ভূত কালো টাকার দুর্নীতি ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যাবে এমন অসম্ভব কাণ্ড যে ঘটতে পারে না, তা বোঝার জন্য অর্থনীতির পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই৷ নোটবাতিল ও জিএসটি মোদি সরকারের কর্পোরেট স্বার্থরক্ষার কর্মসূচি এবং জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়, তা আজ দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার৷