কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির সর্বভারতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক পয়গম্বর হজরত মহম্মদ সম্পর্কে অত্যন্ত কদর্য মন্তব্য করেছেন। তা নিয়ে দেশ-বিদেশে বিশেষত আরবীয় ইসলামিক দেশগুলিতে প্রবল আলোড়ন শুরু হয়েছে। উপসাগরীয় ইসলামিক দেশগুলি ভারতের সাথে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছে। পরিণামে বিজেপি নূপুর শর্মাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করেছে দল থেকে। এটা নেহাতই ড্যামেজ কন্ট্রোলের আশু কৌশল। সংঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র নেত্রী হিসেবে নূপুরের আত্মপ্রকাশ। ২০০৮ সালে সংসদ হামলায় অভিযুক্ত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এ আর গিলানির মুখে থুতু ছিটিয়ে প্রচারের আলোয় আসেন নূপুর। পরে অধ্যাপক গিলানি আদালতে বেকসুর খালাস পেয়ে যান, কিন্তু নূপুরের পদোন্নতি ঘটতে থাকে।
নূপুর শর্মা বা তার আপত্তিকর কটূক্তি কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং বিভাজনের যে রাজনীতি বিজেপি সযত্নে অনুশীলন করে, নূপুর তারই অনিবার্য ফসল। যে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং মুসলিমদের উইপোকার মতো টিপে মারার এবং এনআরসির মাধ্যমে দেশছাড়া করার প্রকাশ্য হুমকি দেন, যে দলের নেতা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ‘গোলি মারো শালোকো’ বলে পুলিশের উপস্থিতিতে নির্বিবাদে দাঙ্গা সংগঠিত করেন, সেই দলের নেত্রীর কাছে এর কম কী আর আশা করা যায়! গোল বাধিয়েছে সমাজমাধ্যম। ইসলামিক দেশগুলির আমজনতা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র প্রধানদের উপরে চাপ সৃষ্টি করায় তারা নড়েচড়ে বসেছেন। তাই বিজেপির এই লোকদেখানো ‘ব্যবস্থা গ্রহণ’! পরবর্তীকালে অবস্থা স্বাভাবিক হলে এই নূপুরের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে আরও উঁচুপদে বসানো হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর আগে আমরা উত্তরপ্রদেশে দেখেছি সাংসদ যোগী আদিত্যনাথের উপস্থিতিতে বিজেপির এক যুব নেতা মুসলিম নারীকে কবর থেকে তুলে ধর্ষণের নিদান দেওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীর পদ পেয়ে যোগী পুরস্কৃত হয়েছেন! তখন অবশ্য উপসাগরীয় মুসলিম দেশগুলোর কানে কোনও বার্তা পৌছয়নি!
২০১৪ সালে দ্বেষপ্রিয় বিজেপির দাঙ্গাখ্যাত নরেন্দ্র মোদি এ দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নির্বাচিত হওয়ার পরই সারা দেশ জুড়ে ধর্মীয় ঘৃণা ও হিংসার চাষাবাদ শুরু হয় নতুন উদ্যমে। এক বছরের মধ্যেই ইসলামি জঙ্গি আইসিস উপদ্রুত সিরিয়া, নাইজেরিয়া ও ইরাকের পাশেই জায়গা করে নেয় ‘আচ্ছে দিন’-এর মোদি-ভারত। আন্তর্জাতিক সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা অনুযায়ী ১০ নম্বরের মধ্যে ৯.২ নম্বর পেয়ে সিরিয়া এক নম্বরে, ৯.১ নম্বর পেয়ে নাইজেরিয়া দ্বিতীয় এবং ৮.৯ নম্বর পেয়ে ইরাক তৃতীয় স্থান অধিকার করে। আর মোদিজির ভারত ৮.৭ নম্বর পেয়ে তালিকায় চতুর্থ স্থানাধিকারী হয়। ‘চিরশত্রু’ পাকিস্তান এ ব্যাপারে ভারতের চেয়ে খানিকটা পিছিয়ে পড়ে। দশের মধ্যে ৭.২ নম্বর পেয়ে তাদের স্থান হয় ১০ নম্বরে।
মোদিজি প্রথমবার দিল্লির কুর্সিতে বসার ঠিক চার মাসের মাথায় উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে ফ্রিজে গোমাংস রাখার কাল্পনিক অভিযোগে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় মহম্মদ আখলাককে। বিজেপি নেতার পুত্র সহ ১৫ জন অভিযুক্ত হয় ওই ঘটনায়। ঘটনার তদন্তকারী অফিসার আইসি পদমর্যাদার সুবোধ কুমার সিংকে ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর বুলন্দশহরে পুলিশের সামনেই গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যা করে উন্মত্ত গো-সন্তানরা। আখলাকের পর নিরীহ কিশোর ছাত্র জুনায়েদ থেকে শুরু করে পেহলু খান, আফরাজুল, তাবরেজ আনসারি একের পর এক নাম যুক্ত হয় মবলিঞ্চিং-এর তালিকায়। এসব নিয়ে অবশ্য কোনও উচ্চবাচ্য করেনি ইসলামিক দেশগুলি। এমনকি ভারতের মুসলিমদের নির্মূল করার হুঙ্কারেও নির্লিপ্ত থেকেছে তারা।
গত বছরের ১৭-২০ ডিসেম্বর উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে সাধুসন্তদের সম্মেলন বা ধর্মসংসদ অনুষ্ঠিত হয়। মঞ্চে দেখা যায় বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়কে। সেই মঞ্চ থেকে গণহত্যার মাধ্যমে মুসলিমদের নির্মূল করার ডাক দেওয়া হয়। ‘হিন্দু রক্ষা সেনা’র প্রবোধানন্দ গিরি এ দেশের পুলিশ, সেনা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রত্যেক হিন্দুকে মুসলমান নির্মূল অভিযানে নামার ডাক দেন। সাধ্বী অন্নপূর্ণা বলেন, ‘ওদের নিকেশ করতে হলে আমাদের একশো জন হিন্দু সেনা চাই, যারা ওদের বিশ লক্ষকে খতম করতে পারবে’ (বিবিসি বাংলা, দিল্লি, ২৯-১২-২১)। এ হেন মারাত্মক হিংসাত্মক সমাবেশের সাথে তাদের সম্পর্ক নেই বলে দায় এড়ায় বিজেপি। তাদের সরকারও তথাকথিত সাধুসন্তদের বিরুদ্ধে কোনও রকম কার্যকরী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। প্রথিতযশা আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ, দুষ্যন্ত দাভে, সলমন খুরশিদ সহ ৭৬ জন বর্ষীয়ান আইনজীবী সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে লেখা এক খোলা চিঠিতে বলেন, ‘এই গণহত্যার আহ্বানের বিরুদ্ধে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপ খুব জরুরি, কারণ প্রশাসন কিছুই করছে না।’ সে সময় গদি-মিডিয়া নীরব ছিল, যথারীতি নীরব ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। সমাজমাধ্যম সরব হওয়ার পর পুলিশ দায়সারা একটি এফআইআর করে মাত্র। তারপরে প্রশাসন বা বিচারবিভাগ কেউই এ নিয়ে কোনও রকম উচ্চবাচ্য করেছে বলে জানা নেই।
তা হলে এবারে দলের জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং আরেক খুচরো নেতা নবীন জিন্দালকে বহিষ্কার করা হল কেন? এই ব্যবস্থাটুকু গ্রহণ করা হল এই কারণে যে, নূপুরের কটূক্তিকে কেন্দ্র করে আরব দেশগুলির কড়া পদক্ষেপে ভারতের বাণিজ্যতরী টলমল হয়ে পড়েছে। ভারতের মোট পেট্রোলিয়াম আমদানির ৮০ শতাংশ আসে ইরাক-ইরান এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) সদস্যভুক্ত ছ’টি দেশ থেকে। ভারতে প্রতি বছর যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা হয় তার অর্ধেকই আসে কাতার থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ভারত যেসব পণ্য রপ্তানি করে তার বার্ষিক মূল্য ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিসিসির সদস্য ছ’টি উপসাগরীয় দেশে কর্মরত রয়েছেন ৮৫ লাখের বেশি ভারতীয়। অন্যান্য আরব দেশেও বহু ভারতীয় কর্মরত আছেন। আরব দেশগুলো থেকে বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে ভারত। ভারতের অর্জিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার তিন ভাগের দু’ভাগই আসে উপসাগরীয় মুসলিম দেশগুলো থেকে।
এই সমস্ত কারণেই দেশের বুকে লাগাতার মুসলিম বিদ্বেষে ইন্ধন যোগানোর পাশাপাশি উপসাগরীয় মুসলিম দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন কুশলী নরেন্দ্র মোদি সরকার। মোদিজির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা আদানি গোষ্ঠীর সাথে কাতারের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব নিবিড়। ৩২০০ কোটি টাকা দিয়ে আদানি ইলেকট্রিসিটির ২৫.১ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় কাতারের সরকারি লগ্নি সংস্থা ‘কাতার ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’। পাশাপাশি ওই ফান্ডের সাথে আদানি এয়ারপোর্ট হোল্ডিং লিমিটেডেরও বাণিজ্যিক বোঝাপড়ার কথা চলছে। কথা চলছে মুম্বাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লিমিটেডের অংশীদারি নিয়েও। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিজেপি মুসলিম দেশের সাথে ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’ নীতিতে বিশ্বাসী, কিন্তু দেশের বুকে মুসলিমদের সাথে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা!
পরিশেষে বলি, নূপুর-ধ্বনিতে বেসামাল হয়ে ঘরে-বাইরে কোণঠাসা বিজেপি এখন বিবৃতি দিয়ে বলছে, ‘বিজেপি সব ধর্মকে সম্মান করে।’ কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দে্যাপাধ্যায় বেঁচে থাকলে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বাঙাল ভাষায় বলতেন, ‘আস্তে কন কত্তা! শুনলে ঘুড়ায়ও হাসবো’। ধর্মীয় বিদ্বেষই যাদের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি, তারা বলে কিনা সব ধর্মকে সম্মান করে!
(মুর্শিদাবাদ জেলার ‘ঝড়’ পত্রিকা, ৫৪ বর্ষ ২৩ সংখ্যা থেকে)