তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীর ‘কুকথায়’ নাকি তাঁদের দলের কর্মীরাও হতভম্ব (বর্তমান, ২৯/৪)৷ দেশ জুডে রাজনৈতিক নেতা–নেত্রীদের কুকথায় লাগাম টানতে সুপ্রিম কোর্টকে ইদানীং হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা–নেত্রীর মধ্যে এ রাজ্যে কৃষ্ণনগরের বিজেপি নেতার প্রচারেও সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে৷ কিন্তু কুকথার স্রোত যেন কোনও বাধাই মানছে না৷ গত ২৬ এপ্রিল দুপুরে তমলুক লোকসভা এলাকার কাঁকটিয়া দুর্গামণ্ডপ লাগোয়া মাঠের সভায় বিজেপি প্রার্থী সিদ্ধার্থ নস্করের কুকথায় সাধারণ মানুষ হতচকিত৷ মঞ্চে উপবিষ্ট নেতারা তখন মুখ নিচু করে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন৷ উপস্থিত দলের মহিলা কর্মীরাও সভাস্থলে লজ্জায় কোণঠাসা৷ প্রার্থীর রুচিবোধ ও মানসিকতার পরিচয় পেয়ে দলের কর্মীরাও হতবাক৷ এ জাতীয় ভাষাও যে প্রকাশ্যে ব্যবহার করা যায় তা সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেননি৷ যে বিজেপি একটা ভিন্ন জাতের দল হিসাবে, আদর্শনিষ্ঠ দল হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেছিল তার আজ এই অবস্থা ভোটে জিততে হবে, তাই যে কোনও রকম পথ অবলম্বন করা যেতে পারে– এই হল নেতাদের মূলমন্ত্র৷ তাই তাঁদের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলছেন, ‘ভদ্রতার কথা বলে কে কবে জিতেছেন’ (এই সময় ২৬/৪)৷ তাঁর সাফ কথা, ‘নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের ডায়লগ শুনছেন না৷ আমার ভাষাতেই কথা বলছেন তাঁরা৷ আগে বুঝলে বাংলায় এতদিনে পরিবর্তন হয়ে যেত৷ পাবলিক এটাই চায়৷ আমার থেকে বেশি অসংসদীয় কথা বলছে সিপিএম, তৃণমূল৷ এটাই বাংলার রাজনীতি৷ ভদ্রতার কথা বলে কে কবে জিততে পেরেছেন?’
এ সব বলে তিনি নিজের স্বরূপটিই কেবল জনসমক্ষে তুলে ধরলেন না, এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ সম্পর্কেও তাঁর বিকৃত ধারণা প্রকাশ করলেন, সাধারণ মানুষের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করলেন৷ এ ধারণা তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা বললে ভুল বলা হবে৷ দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর বক্তব্য হল, নীতির অনুসারী হওয়ার দরকার নেই, যেভাবে হোক ভোটে জেতাটাই বড় কথা৷ পশ্চিমবঙ্গের দলীয় নেতাদের তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কথা বলে যাঁদের প্রার্থী করা হয়েছিল তাঁরা কেউ জিততে পারেননি৷ ফলে এই লোকসভা ভোটে আর নীতি ও আদর্শ–স্বচ্ছতা এসব বিচারের দরকার নেই৷ এই নির্দেশ শিরোধার্য করে দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি জানিয়েছেন, যে কোনও লোককে গ্রহণ করতে তাঁদের অসুবিধা নেই৷ প্রার্থীর গায়ে দুর্নীতির দাগ থাকলেও অসুবিধা নেই৷ তাঁদের কিছুতেই কিছু আসে যায় না৷ বিজেপি সাদরে তাঁদের গ্রহণ করে নেবে, জেতাটাই আসল (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩/৩)৷
বিজেপি নেতাদের বক্তব্য শুনে যাঁরা আঁতকে উঠছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলি, বিজেপি তাদের বর্তমানের ঘোষিত নীতিই অনুসরণ করে চলছে৷ সিদ্ধার্থবাবু, দিলীপবাবুরা ঘোষিত এই নীতিরই অনুসারী৷ যাঁরা রাজনীতিকে বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিকে বিশ্লেষণধর্মী মন নিয়ে দেখেছেন তাঁরা জানেন, বিজেপির রাজনীতিতে কোনও দিনই নীতি–নৈতিকতা–আদর্শে বালাই ছিল না৷ নীতি–আদর্শের যে কথাগুলি তারা বলত, সেগুলিও ছিল ভোট–রাজনীতিকে পুষ্ট করার কৌশলগত লাইন৷ ভোট কুড়োতে পাঁচ বছর আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা কেন রক্ষা হয়নি, তার জবাব দিতে তাই এখন সর্বভারতীয় সভাপতিকে পর্যন্ত বলতে হচ্ছে, এসব ‘জুমলা’ অর্থাৎ কথার কথা৷ বলতে হয় তাই বলা, না হলে ভোট পাওয়া যায় না৷
নীতিহীনতার এই কদর্য স্রোত কেবল বিজেপির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নয়৷ ক্ষমতালোভী সমস্ত রাজনৈতিক দল ভোট–রাজনীতিকে মুখ্য করতে গিয়ে আজ এই পথ বেছে নিয়েছে৷ গদিলিপ্সা আজ বিজেপির মতো কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম প্রমুখ রাজনৈতিক দলগুলিকেও এই রাস্তায় নামিয়েছে৷ সে কারণে এই দলগুলির মধ্যে নিজেদের অবস্থান বদলে নেওয়ার ব্যাপারটাও দিনের পর দিন খুব সাধারণ ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে৷ দু’দিন আগেও যারা ছিল কংগ্রেসে বা সিপিএমে, ভোটের আগে আজকে তাদের অনেকেই তৃণমূল বা বিজেপিতে৷ হাওয়া বুঝে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে আকছার৷ রাজনীতির এই হাল দেখে বহু সাধারণ মানুষ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়েছেন৷ এর ফলে এদের এমন ধরনের রাজনীতি করতে খুব বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না৷ এই রাজনৈতিক আবহে সহজেই পুষ্ট হচ্ছে ধনিক শ্রেণির স্বার্থ, যারা তথাকথিত চৌকিদারদের ছত্রছায়ায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে শোষণের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে তুলছে৷
গৌরীশংকর দাস
সাঁজোয়াল, খডগপুর