বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বলে দিয়েছেন, নীতির বালাই রাখার দরকার নেই, যে ভাবে হোক জেতাটাই বড় কথা৷ পশ্চিমবঙ্গের দলীয় নেতাদের তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কথা বলে যাদের প্রার্থী করা হয়েছিল তারা কেউ জিততে পারেননি৷ ফলে এই লোকসভা ভোটে আর নীতি ও আদর্শ–স্বচ্ছতা এসব বিচারের দরকার নেই৷
সর্বভারতীয় সভাপতির নির্দেশ শিরোধার্য করে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ জানিয়েছেন, হৃদয় এবং দলের দরজা তাঁরা এত বড় করে ফেলেছেন, যেকোনও লোককে গ্রহণ করতে তাঁদের অসুবিধা নেই৷ প্রার্থীর গায়ে দুর্নীতির দাগ থাকলেও অসুবিধা নেই, (পড়ুন, চোর ডাকাত হলেই বা কী)৷ তাঁদের কিছুতেই কিছু আসে যায় না৷ বিজেপি তাকে সাদরে গ্রহণ করে নেবে, জেতাটাই আসল (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ মার্চ)৷
নীতির বালাই রাখব না বলেও অমিত শাহ কথা রাখেননি, এমন অভিযোগ বিজেপির অতিবড় শত্রুতেও তুলতে পারবে না৷ আসলে বিজেপির রাজনীতিতে নীতি–নৈতিকতা–আদর্শ এসবের বালাই কোনও দিনই ছিল না৷ কিন্তু এমন জোর গলায় সে কথা প্রকাশ্যে বলতে হয়নি৷ এখন পাঁচ বছর সরকার চালিয়েই দেশের মানুষের যে ক্ষোভের ঝড়ের মুখে তাঁরা পড়েছেন, তাতে রাখ–ঢাক বজায় রাখাই মুশকিল হয়ে পড়েছে৷ এখন জিততে গেলে চোখের চামড়াটুকু বজায় রাখলেও যে চলবে না, তা বুঝেই এমন কথা বলতে হচ্ছে৷
শুধু তাঁরা নন, ভোট রাজনীতির পুরো পরিসর জুড়ে বয়ে চলেছে নীতিহীনতার এক কদর্য স্রোত৷ এই পশ্চিমবঙ্গেই ক’দিন আগে কংগ্রেসের তিন বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দিয়েও পুরনো দল থেকে পদত্যাগ করেননি৷ কারণ দলত্যাগ বিরোধী আইনে তাঁদের এমএলএ পদটা চলে যেতে পারে৷ কিন্তু তৃণমূল তাঁদের লোকসভার ভোটের টিকিট দিতেই তাঁরা রাতারাতি কংগ্রেস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করে তৃণমূল হয়ে গেলেন৷ কংগ্রেসের এক প্রাক্তন রাজ্য সভাপতির ডিগবাজিও দেখেছে পশ্চিমবঙ্গবাসী৷ তিনি ২০১১ থেকে কয়েক বছর তৃণমূলের বিরুদ্ধে অনেক গলা ফাটিয়ে অবশেষে গদির আশায় তৃণমূলেই নিজেকে সঁপে দিয়ে রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন৷ এখন আবার লোকসভা ভোটে ‘অনুপ্রেরণা’ লাভ করেছেন৷ মাঝখানে ২০১৬ তে রাহুল গান্ধী–বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে একত্রে পরানো বিশাল মালার ফাঁকে তাঁর মুখটিও শোভা পেয়েছিল৷ এদিকে, উত্তর মালদার বিজয়ী কংগ্রেস সাংসদ এবার একই জায়গা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী৷ চমক আরও বাকি, তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে যাঁর নাম শোনা যাচ্ছে, তিনি গতবারে সিপিএম প্রার্থী হিসাবে লড়েছিলেন একই কেন্দ্রে৷ তিনি আবার সিপিএম বিধায়কও বটে৷ অর্থাৎ এমনটি ঘটলে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী একই থাকলেও, পাল্টে যাবে তাঁদের সাইনবোর্ড দুটি৷ তৃণমূলের বাহুবলী নেতা বলে খ্যাত উত্তর চব্বিশ পরগণার এক বিধায়কও টিকিট না পেয়েই সোজা বিজেপির পায়ে পড়েছেন৷ বিজেপি কয়েকমাস আগেও তাঁর বিরুদ্ধে যে সব বাছা বাছা বিশেষণ দিয়েছিল, সেগুলি গিলে ফেলে এখন তৈরি তাঁকেই টিকিট দিতে৷ তিনি আবার দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরেই পঞ্চায়েত ভোটে গণতন্ত্র হত্যার চিত্রগুলি এতদিনে দেখতে পাচ্ছেন৷ শুধু এখন ভুলে গেছেন যে, এর অনেকগুলি অভিযোগ তাঁর নামেই৷ কিন্তু ক্ষমতার মধু এতটাই লোভনীয় যে, তখন প্রতিবাদ করে উঠতে পারেননি চিটফান্ড কেলেঙ্কোরির অন্যতম নায়ক এক প্রাক্তন তৃণমূল নেতার ভরসায় বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে কিছু আসন জেতার কথা ভাবছে৷ তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় সভাপতি, এমনকী প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত কেমন করে ভাগানোর স্লোগান দিয়েছিলেন, তা আজও এ রাজ্যের মানুষ ভোলেনি৷ কিন্তু এখন বিজেপির ছোঁয়ায় তিনি ‘শুদ্ধ’ হয়ে গেছেন৷ বিজেপির রাজ্য সভাপতি এমনও বলেছেন, বিজেপিতে প্রার্থী হওয়ার উপযুক্ত লোক নেই৷ তাই তাঁরা অন্য দল ভাঙানোর চেষ্টায় রত৷ মানুষ জিজ্ঞাসা করতেই পারে, যে দলে উপযুক্ত প্রার্থীই নেই, সেই দলটির ভোট চাইবার অধিকারই বা থাকবে কেন?
এমন জামা বদলানোর মতো দল পাল্টানোর খেলা বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতিতে অবশ্য নতুন কিছু নয়৷ তথাকথিত নির্বাচনী গণতন্ত্র আজ কত বড় প্রহসনে পরিণত হয়েছে তা এই খেলা দেখলেই অনেকটা বোঝা যায়৷ নীতি–আদর্শের বালাই রাখা তো অনেক পরের কথা, যে দুর্নীতি নিয়ে এই সমস্ত দলগুলির নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে গলা ফাটায় তারা নিজেরা প্রায় প্রত্যেকেই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে একেবারে ডুবে আছে৷ এই দল–বদলের কৌশলের সাথে নীতি–আদর্শের, জনকল্যাণের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই৷ এই সব নেতারা যে এক দল ছেড়ে আর এক দলে যাচ্ছেন, তা এজন্য নয় যে, পুরনো দলটির নীতি আদর্শ সঠিক মনে না হওয়ায় তিনি আরও উন্নত নীতি–আদর্শের খোঁজে অপর একটি দলে যোগ দিচ্ছেন৷ কিংবা এক দলে থেকে জনগণের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছেন না বলে অন্য একটি দলে গিয়ে সেই কাজ তিনি করতে চান৷ বাস্তবে এর কোনওটিই যে সত্য নয়, তা মানুষ হাড়ে হাড়ে জানে৷ এই সব নেতার দলবদলের একমাত্র কারণ ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা৷ সাংসদ–এমএলএ–মন্ত্রী হয়ে জনগণের সম্পত্তির উপর লুঠপাঠ চালানো, দাদাগিরির অধিকার অর্জন, প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হওয়া, দুর্নীতি করে আখের গুছিয়ে নেওয়া– এর বাইরে কংগ্রেস–বিজেপি–তৃণমূলের মতো জাতীয় বা আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলির নেতাদের দলবদলের অন্য কোনও কারণ নেই৷ স্বাভাবিকভাবেই জনগণের জন্য লড়াই, তাদের দাবিদাওয়া, প্রয়োজনকে সংসদীয় মঞ্চে তুলে ধরা এগুলি সবই পিছনে চলে যাচ্ছে৷ আর যেহেতু গোটা বুর্জোয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই দুর্নীতির পাঁকে ডুবে গেছে, তাই এই রাজনীতির পক্ষে থেকে দুর্নীতির বিপক্ষে যাওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়৷ বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমগুলি এই রাজনীতির চূড়ান্ত নীতিহীনতাকে আড়াল করতে ভোটে কে জিতবে, সেই ছদ্ম–লড়াইটাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সামনে নিয়ে আসে৷
একটা বিষয় অনেককেই ভাবিয়েছে, চিহ্ণিত বুর্জোয়া দলগুলির নেতাদের সুযোগসন্ধানী চরিত্র না হয় বোঝা গেল৷ কিন্তু বামপন্থী দল সিপিএমের নানা স্তরের বহু নেতা, কর্মী, বিধায়ক এমনকী দু’একজন সাংসদ পর্যন্ত তৃণমূল কিংবা বিজেপির দরজায় লাইন দিচ্ছেন কী করে? বামপন্থী একটি দলে থেকে এতটুকু বামপন্থার চর্চা করলে এমনটি তো হওয়ার কথা নয় দেখা গেছে কোনও আদর্শগত প্রশ্ন নয়, আখের গোছানোটাই আসল কারণ৷ অবশ্য এটা যে খুব অস্বাভাবিক নয়, তা সিপিএম দলের নেতাদের কার্যকলাপ দেখলেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়৷ দেশ জুড়ে যখন মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের বারুদ ফেটে পড়তে চাইছে, যে সময় দরকার ছিল বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঝড় তোলা৷ যার মধ্য দিয়েই একমাত্র বিজেপির সর্বনাশা সাম্প্রদায়িক ও করপোরেট মালিকদের স্বার্থবাহী রাজনীতির বিরুদ্ধে যথার্থ প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব ছিল৷ এই কাজ করতে হলে কংগ্রেসেরও একচেটিয়া মালিকদের স্বার্থে পরিচালিত তথাকথিত নরম হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখোশ খোলা দরকার ছিল৷ এস ইউ সি আই (সি) দল বারবার এই আন্দোলনের জন্য সিপিএম নেতৃত্বের কাছে আবেদন করলেও তাঁরা কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়ে কত ভোট বাড়তে পারে, দু–একটি আসন পাওয়া যায় কি না, এইসব হিসাব–নিকাশেই মশগুল থাকলেন৷ দীর্ঘদিন ধরে বিশেষত ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় বসার পর থেকে সিপিএম বামপন্থার চর্চা দূরে থাক, কী করে আরও বেশি ভোট জোগাড় করা যায়, কী করে, কাকে ম্যানেজ করে বা ধমক–চমক দিয়ে কিছু পঞ্চায়েত–এমএলএ–এমপি আসন বাড়ানো যায় এর মধ্যেই দলের পুরো শক্তি নিয়োজিত করেছিল৷ ক্ষমতার মধুভাণ্ডের চারপাশে ভিড় করা ক্ষমতালোভীদেরই দলের ‘সম্পদ’ বলে তুলে ধরে বামপন্থাকে কার্যত ভুলেই থাকতে চেয়েছিল তারা৷ তাই আজ যেখানে সুবিধা পাচ্ছে দলের নেতা–কর্মীরা সেখানেই ঘুরঘুর করছে৷ দলীয় নেতৃত্বও যেভাবে কংগ্রেস নেতৃত্বের পিছনে কয়েকটা সিটের জন্য উমেদারের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাও বামপন্থাকে দুর্বলই করছে৷ তাঁদের সাথে আর পাঁচটা বুর্জোয়া দলের সাইনবোর্ড আর কিছু বুকনি ছাড়া অন্য পার্থক্য থাকছে না৷ এর ফল সিপিএমকে ভোগ করতে হচ্ছে৷ কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বামপন্থা যেভাবে কলঙ্কিত হচ্ছে তার বিষময় ফল আরও গভীর৷ এর ফলে ভোটে যেই জিতুক বিজেপির রোপন করা সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষকে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলার কাজটা আরও কঠিন হবে৷ যেমন কঠিন হবে, একচেটিয়া মালিকদের স্বার্থে বেপরোয়া আক্রমণের মোকাবিলায় দেশব্যাপী শ্রমিক–কৃষক–খেটেখাওয়া সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলন গড়ে তোলা৷
তাই এস ইউ সি আই (সি) দল এযুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে হাতিয়ার করে নির্বাচনী সংগ্রামকে গণআন্দোলনের পরিপূরক সংগ্রামে পরিণত করার লড়াইয়ের ডাক দিয়েছে৷ এই লড়াইয়ে আজ সামিল হতে হবে সমস্ত স্তরের খেটেখাওয়া মানুষকে৷ করপোরেট পুঁজি পরিচালিত সংবাদমাধ্যমের প্রচারে ভেসে যাওয়া নয়৷ বিচার করতে হবে প্রার্থীকে, তার দল, তার রাজনীতিকে খুঁটিয়ে বিচার করতে হবে৷ কে জিতবে কে হারবে –এর হিসাব কষে রাজা–উজির তৈরির মোহ নয়, ভোটের সময় খোলা মনে বিচার করতে হবে জনজীবনের সমস্যাগুলি সমাধানে প্রার্থী এবং তাঁর দল কী উদ্যোগ নিয়েছেন? এই কাজটি না করলে বিগত ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জনগণ যেমন ঠকে এসেছেন, এবারও একইভাবে ঠকতে হবে৷ এই দল বিচারের যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে তা এস ইউ সি আই (সি) জনগণের সামনে তুলে ধরেছে৷ তাকে গভীরভাবে চর্চা করতে হবে৷ এটাই আজ সময়ের দাবি৷