স্বশাসিত সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও শাসক দলের হয়ে কাজ করার অভিযোগ আগেও উঠেছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে৷ কিন্তু এবারের লোকসভা নির্বাচনে এই সংস্থার যে চরম নির্লজ্জ দলদাসত্বের পরিচয় পাওয়া গেল, তা সত্যিই ব্যতিক্রমী৷ নির্বাচন চলাকালীনই শাসক বিজেপির হয়ে কমিশনের অত্যন্ত নগ্ন পক্ষপাতিত্বের গুরুতর অভিযোগ উঠতে শুরু করে সংবাদমাধ্যমে, জনমনেও৷
ব্যতিক্রমী কেন? কারণ, দেশের ৭২ বছরের ইতিহাসে এমন খোলাখুলি পক্ষপাতিত্ব ইতিপূর্বে ঘটেনি– এমন ভয়ঙ্কর অভিযোগ তুলেছেন দেশেরই অবসরপ্রাপ্ত আমলা, শিক্ষাবিদ সহ ১৪৫ জন বিশিষ্ট মানুষ৷ খোদ কমিশনের কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁরা৷ স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন জহর সরকার, অভিজিৎ সেনগুপ্ত, ওয়াজাহাত হাবিবুল্লাহ, হর্ষ মান্দার, অরুণা রায়, অ্যাডমিরাল বিষ্ণু ভাগবত, প্রবাল দাশগুপ্ত, লীলা শাসমলের মতো অবসরপ্রাপ্ত আইএএস, সেনাবাহিনীর প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি, খ্যাতনামা অধ্যাপক ও গবেষকরা৷
চিঠির মূল বিষয়বস্তু, ২০১৯ সালের নির্বাচন স্বাধীন দেশের ৭২ বছরের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা কম মুক্ত ও নিরপেক্ষ (ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার) হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ পদ্ধতিগত প্রশ্নে নিয়মভঙ্গ করেছে কমিশন৷ আদর্শ আচরণবিধি প্রকাশিত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়নি, অথবা বেমালুম চেপে গিয়েছে৷ নিয়ম ভাঙা বা আদর্শ আচরণবিধি লঙঘন করা সত্ত্বেও প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন৷ গোচরে আনা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থেকেছে৷ শাসক বিজেপির স্বার্থে নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণ থেকে শুরু করে বিজেপির নেতা–মন্ত্রীদের আদর্শ নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ, সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক বক্তব্য প্রচার, সেনাবাহিনীর নামে ভোট চাওয়া, জাত–পাত নিয়ে বিদ্বেষমূলক প্রচার, নমো টিভি থেকে নির্বাচনী বন্ড, সর্বোপরি ই ভি এম বিতর্ক– সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা৷ তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি যাতে নানা সরকারি প্রকল্প ঘোষণার সময় হাতে পান, সেই কারণেই কি এ বছর মার্চ মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষার পর নির্বাচনী নির্ঘণ্ঢ প্রকাশ করা হল?
চিঠিতে তাঁরা অভিযোগ করেছেন, তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানার মতো রাজ্যে যেখানে বিজেপির জেতার সম্ভাবনা কম ছিল সেখানে এক দফায় ভোট হয়েছে৷ আবার অপেক্ষাকৃত কম আসন বিশিষ্ট রাজ্য যেখানেই তাদের জেতার সম্ভাবনা বেশি মনে করেছে, সেখানেই বেশ কয়েক দফায় ভোট করা হয়েছে৷ এ ছাড়াও সংখ্যালঘুদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, নির্বাচনী প্রচারে উস্কানিমূলক মন্তব্য করা ও আদর্শ নির্বাচনী বিধি লঙঘনের মতো গুরুতর অভিযোগ বিজেপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা সত্ত্বেও কমিশনের পক্ষপাতিত্বমূলক বদান্যতায় তাঁদের ছাড় দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে৷
লোকসভা নির্বাচনে কর্ণাটক, রাজস্থানের মতো রাজ্যে বিপুল জয়লাভের পরে পরেই ওই সব রাজ্যেরই পুরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির শোচনীয় পরাজয় প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি সত্য ছিল৷ বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ চিঠির শেষে কমিশনের এই পক্ষপাতমূলক আচরণ ও কার্যকলাপের জবাব চেয়েছেন খোদ কমিশনের কাছেই৷
দেশের সমস্ত নির্বাচন যাতে নিরপেক্ষ ও মুক্তভাবে পরিচালিত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রে সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হল নির্বাচন কমিশন৷ অথচ তার বিরুদ্ধেই উঠেছে নির্বাচনে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের গুরুতর অভিযোগ৷ আসলে পুঁজিবাদী সংসদীয় ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে৷ তথাকথিত গণতন্ত্র, নিরপেক্ষতা আজ সোনার পাথরবাটি৷ এই ব্যবস্থায় নির্বাচন আজ আর জনমতের যথার্থ প্রতিফলন নয়৷ তার একমাত্র উদ্দেশ্য, যে কোনও ভাবে পুঁজিপতিদের সেবাদাস দলগুলিকে জিতিয়ে আনা৷ নামে যতই ‘স্বশাসিত’ হোক, এই পচা–গলা ব্যবস্থার অভ্যন্তরে থেকে কোনও সংস্থারই নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করা দিনে দিনে যে কঠিন হয়ে পড়ছে তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ নির্বাচন কমিশনের এই লজ্জাজনক আচরণ তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ৷