১১ এপ্রিল কলকাতা প্রেস ক্লাবে শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মী বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সভাপতি বিভাস চক্রবর্তী এবং সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তী ও সান্টু গুপ্ত এক লিখিত বিবৃতিতে রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ তাঁরা বলেন, রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাকপর্বে মনোনয়পত্র জমা দেওয়া নিয়ে হিংসার যে ঘটনা ঘটছে তা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে গৌরবজনক নয়৷ কয়েকটি মাত্র ব্যতিক্রম বাদ দিলে এই রাজ্যের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটেছে তা আমাদের দেশবাসী এমনকী বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে আমাদের হেয় করে তুলেছে৷ নির্বাচনের উদ্যোগপর্ব থেকে এ ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীদের হাতে চলে গিয়েছে৷ এই দুষ্কৃতীদের রাজনীতির অ–আ–ক–খ জ্ঞান আছে কিনা জানা নেই, কিন্তু তারা যে অনেকাংশেই রাজ্যে বিশালতম নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করতে চলেছে সেটা স্পষ্ট৷ গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরে যারা গণতন্ত্রের সব থেকে বড় উৎসবকে একটা দুঃশীল কার্যক্রমে পর্যবসিত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সময় এসেছে৷ আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি কোনও কোনও নেতা বিরোধীশূন্য রাজ্য এবং বিরোধীশূন্য দেশ গড়ার কথা বলছেন৷ এটি গণতান্ত্রিক ভাবনার বিরোধী ও স্বৈরাচারী ভাবনার জন্ম দেয়৷ বর্তমান পঞ্চায়েত নির্বাচনের উদ্যোগপর্বে দুষ্কৃতীদের কাজ কতটা রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট, প্রশাসনের কাছে কতটা ছাড়প্রাপ্ত সেটা মানুষ নিজ অভিজ্ঞতাবলে অনুভব করবে৷ মনোনয়নপর্বের এই ভয়ঙ্কর অবস্থা প্রকৃত নির্বাচনের সময় আরও ভয়ঙ্করতম হবে বলে আমাদের আশঙ্কা হয়৷ জনসাধারণের সজাগ দৃষ্টির সাথে সরকারি প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন যদি যথাযথ ভূমিকা পালন করে তাহলে এই অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব৷
আমরা আর একটি দাবি উত্থাপন করব৷ বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্য সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রচুর বাক–বিতন্ডা লক্ষ করা গিয়েছিল৷ বিষয়টা শেষ অবধি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়৷ সুপ্রিম কোর্ট কমিশনের পক্ষে রায় দিয়ে নির্বাচনের দিন বা দফা নির্ধারণ করেন, এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের আদেশ দেন৷ কিন্তু বিবাদের মূল কারণ যা ছিল, অর্থাৎ ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত আইনের বিশেষ কয়েকটি ধারা (৪১/৪২/৪৩) অনুযায়ী রাজ্য সরকার ও কমিশনের ক্ষমতা ও উক্ত আইনটি প্রণয়নের সময় অনেকগুলি নির্ণায়ক ক্ষমতা রাজ্য সরকারের হাতে রেখে দিয়েছিল, নিরপেক্ষ কমিশনের হাতে সেসব ক্ষমতা ছাড়েনি৷ আমরা গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিক সমাজ আশা করব জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মডেলে রাজ্যে এমন একটি নির্বাচন কমিশন পরিচালিত হোক, যারা সর্বার্থে স্বাধীন এবং সার্বভৌম– খণ্ডিত অধিকার নিয়ে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যাদের পদে পদে বিড়ম্বিত হতে না হয়৷ বর্তমান আইনটির ধারা পরিবর্তনের জন্য রাজ্য বিধানসভার সকল সদস্যর কাছে আমাদের এই আবেদনটি বিবেচনার জন্য রইল৷
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে দলত্যাগ বা দল পরিবর্তন বিষয়ক যে আইনটি বলবৎ আছে সেটি পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছি আমরা৷ আজ একটি দলের হয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করার পরমুহূর্তে অন্য একটি দলে চলে যাওয়ার যে অসাধু ও অনৈতিক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে সেটি রোধ করার জন্য কঠোর নতুন আইনের প্রবর্তন করা চাই৷ বর্তমানে এ বিষয়ে যে আইন বা প্রয়োগ পদ্ধতি রয়েছে সেটি ‘হাস্যকর’ প্রমাণিত হয়েছে৷ নির্বাচকমণ্ডলী এতে প্রতারিত বোধ করছেন৷ নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করার এ জাতীয় যথেচ্ছাচার অবিলম্বে বাতিল করা প্রয়োজন৷
সাম্প্রতিককালে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যার ফলে দেশের মানুষ বিপন্ন বোধ করছেন, দেশের সংবিধান এবং তার মৌলিক নীতিরীতি বা নির্দেশ অহরহ লঙিঘত হচ্ছে৷ শান্তিকামী গণতন্ত্রপ্রিয় যুক্তিবাদী মানুষ আজ অসহায় দর্শকমাত্র– তাঁরা প্রত্যক্ষ করছেন ধর্মক্ষেত্রে, রাজনীতিক্ষেত্রে ভেদনীতির আস্ফালন, শাস্ত্রের নামে অনাচার–ত্যাচার, অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানি, মানুষে মানুষে অকারণ হানাহানি, রাজনৈতিক মদতে সুযোগসন্ধানী দুষ্কৃতীদের অবাধ রাজত্ব৷ মানবিকতা, মানবাধিকার আজ বিপর্যস্ত৷ প্রশাসন দ্বিধাগ্রস্ত, দিশেহারা৷ এই ব্যাধি মহামারীর আকার ধারণ করেছে এবং আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকেও গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে৷ আমরা সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সমস্ত রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং প্রশাসনের কাছে এই আবেদন রাখব, দেশের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে এই সর্বনাশা ভেদাভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে আমরা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারি এবং অশুভ শক্তিগুলিকে পরাস্ত করতে পারি৷
(৭০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২০ এপ্রিল, ২০১৮)