সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের পক্ষ থেকে কলকাতায় ২৭ মার্চ এক সাংবাদিক সম্মেলনে যে বক্তব্য রাখা হয়, তা প্রকাশ করা হল। বড় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো কে কত কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে শাসকদলকে দিয়েছে তার একটি আংশিক তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের মনে দৃঢ় সন্দেহ, শাসকদলগুলিকে টাকা দেওয়ার কারণেই কি ওষুধের এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি?
সাধারণ মানুষ ওষুধের গুণমান নিয়ে হয়তো অতটা চিন্তিত নন, যতটা চিন্তা তাঁরা করেন ওষুধের দাম নিয়ে। কোন কোম্পানির কী ওষুধ, কী কাজ করে তা নিয়েও মানুষ হয়তো ততটা ভাবিত নয়। তারা অসুখে একটু ওষুধ পেলেই খুশি– তা সে হাসপাতালের বিনা পয়সার ওষুধই হোক, কিংবা ডাক্তার না দেখিয়ে দোকান থেকে কেনা ওষুধই হোক। কিন্তু অনেক ওষুধ খেয়েও রোগ না সারলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে কোনও না কোনও ডাক্তারের উপর। সচেতন কিছু মানুষ অবশ্যই ওষুধের গুণমান নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু তাদের অনেকেরই গাঁটের কড়ি খরচ করে নামী কোম্পানির ওষুধ কেনার ক্ষমতা থাকে না। ফলে তারা সরকারের জনমোহিনী বিভিন্ন জনঔষধি প্রকল্প কিংবা পিপিপি-তে চালু ন্যায্যমূল্যের দোকানের খপ্পরে গিয়ে পড়েন। সেখানে অনেক কম দামে ওষুধ মেলে, কিন্তু তার মান কে যাচাই করছে!
নির্বাচন কমিশনের ১৪ মার্চ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ইলেক্টোরাল বন্ডের মারফত ৩৫টি ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থা বিজেপি সহ কিছু রাজনৈতিক দলের তহবিলে অনুদান দিয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭টি বড় কোম্পানি তাদের ওষুধের গুণমান পরীক্ষায় ফেল করার পরই ওইসব বন্ড কিনে টাকা দিয়েছে এবং যথারীতি ফেল করা ওষুধগুলোও বাজারে রমরমিয়ে চলছে।
২০২২-এর নভেম্বরে ওষুধ কোম্পানি গ্লেনমার্ক ৯.৭৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। পেছনের ইতিহাসটা কী? তাদের তৈরি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ‘টেলমা’ বারবার ল্যাবরেটরিতে গুণমান পরীক্ষায় ফেল করেছে। এর জন্য ২০২২-২৩ সালে কমপক্ষে পাঁচ বার নোটিসও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ডের নীচে চাপা পড়ে গেছে গুণমান পরীক্ষার রিপোর্ট। ‘সিপলা’ কোম্পানির ওষুধ ব়্যামডিসিভির। কোভিড অতিমারির সময়ে গুণমান পরীক্ষায় ফেল করা সত্ত্বেও আতঙ্কিত মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই ওষুধ চড়া দামে কিনতে মানুষকে বাধ্য করা হয়েছিল। আজ প্রকাশ্যে এসেছে, কোম্পানিটি ২০২২-এর নভেম্বরে ২৫.২ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছিল। এর আগেও ওই কোম্পানির কফ সিরাপ ‘আরসি কফ’ ল্যাবরেটরি টেস্টে ফেল করেছিল। পরের বছরই কোম্পানিটি ১৪ কোটি টাকার বন্ড কেনে।
আরেকটি নামী কোম্পানি ‘টোরেন্ট ফার্মা’। এই কোম্পানি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটেই প্রধানত উৎপাদন করে। এই কোম্পানির ওষুধ স্যালিসাইলিক অ্যাসিড গুণমান পরীক্ষায় ফেল করে ২০১৮ সালে। ওই বছরই এই কোম্পানির আরেকটি ওষুধ ‘ডেপল্যাট ১৫০’-কেও নিম্নমানের বলে ঘোষণা করে মহারাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। আবার ২০১৯-এ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ‘লোসার এইচ’-কে নিম্নমানের বলে ঘোষণা করে গুজরাটেরই ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে হার্টের ওষুধ ‘নিকোরান এলডি’ মহারাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গুণমান পরীক্ষায় ফেল করে। ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে ওই কোম্পানির ডায়েরিয়ার ওষুধ ‘লোপামাইড’ও গুণমান পরীক্ষায় ডাহা ফেল করে। এতগুলো জীবনদায়ী ওষুধ গুণমান পরীক্ষায় ফেল করার পরেও বাজারে রমরমিয়ে চলতে পারছে কী করে? আসলে ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত এই কোম্পানিটি ৭৭.৫ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে।
এবার আইপিসিএ ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের কথা। তাদের তৈরি অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধ ‘ল্যারিয়াগো’-তে কম মাত্রায় ক্লোরোকুইন আছে বলে ২০১৮-য় মুম্বাই ড্রাগ রেগুলেটরের পরীক্ষায় ধরা পড়ে। অথচ এই রিপোর্ট পরে পাল্টে যায় উত্তরাখন্ডের ড্রাগ রেগুলেটরের হাতে। দেখা যাচ্ছে, ওই কোম্পানি ২০২২-২০২৩-এর অক্টোবরের মধ্যে ১৩.৫ কোটি টাকার বন্ড কিনে বিজেপিকে দিয়েছে।
‘জাইডাস হেলথকেয়ার’ মূলত গুজরাটের ওষুধ কোম্পানি। এর তৈরি ‘রেমডিসিভির’-এর একটা ব্যাচের ওষুধের মধ্যে ব্যাক্টেরিয়াজাত এন্ডোটক্সিন পায় বিহার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং একে নিম্নমানের বলে ঘোষণা করে। পরে এই ওষুধ ব্যবহারের ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ঘটে। অথচ গুজরাটের ড্রাগ রেগুলেটরি অথরিটি এই ওষুধের নমুনা পর্যন্ত সংগ্রহ করেনি। ফলে কোভিডের আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে কোম্পানিটি নিম্নমানের ও ক্ষতিকারক এই ওষুধটি চড়া দামে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা অর্জন করেছে। এখন জানা যাচ্ছে, কোম্পানিটি ২০২২-’২৩-এর মধ্যে ২৯ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে।
এ ছাড়াও, বড় কোম্পানিগুলির মধ্যে ডক্টর রেড্ডিজ ল্যাবরেটরি ৮৪ কোটি টাকা, সিরাম ইনস্টিটিউট ৫২ কোটি টাকা, সান ফার্মা ৩১.৫ কোটি টাকা সহ দেশের মোট ৩৫টি ওষুধ কোম্পানি ১ হাজার কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। আমাদের দেশে ওষুধ পরীক্ষার ল্যাবরেটরির বিপুল ঘাটতি থাকায় বেশিরভাগ ওষুধ টেস্ট করাই হয় না। আবার টেস্টে পাঠানোর পরে রিপোর্ট আসতে এতটাই দেরি হয়, যখন গুণমান পরীক্ষায় ফেল করা ওষুধও ওই সময়ের মধ্যে ব্যবহার হয়ে যায়। যতটুকু পরীক্ষায় ধরা পডে, তা কার্যত হিমশৈলের চূড়া মাত্র এবং শাসক দলের নির্বাচনী তহবিলে কয়েক কোটি ঢেলে দিলেই কালা রিপোর্ট সাদা হয়ে যায়। শাসকদল এবং সরকারের মদতে ওইসব কোম্পানি জনগণের পকেট কেটে বিপুল মুনাফা লুটছে শুধু নয়, তাদের মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিচ্ছে।
এবার আসা যাক কোভিড ভ্যাক্সিন কেলেঙ্কারির কথায়। সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বিপুল ঘাটতি এবং সরকারি উদাসীনতা ও ভ্রান্ত স্বাস্থ্য পরিকল্পনার ফলে কোভিডে আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ যখন কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে, রাজ্যে রাজ্যে গণচিতা জ্বলছে, লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মানুষ পরিত্রাণের পথ খুঁজছে, তখন মোদিজি মানুষকে থালা বাজাও, তালি বাজাওয়ের নিদান দিচ্ছেন। তাঁর অনুগামীরা মানুষকে গোমূত্র ও গোময় সেবনের নিদান দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য শুধু এতেই থেমে থাকেননি। ভারতবাসীর প্রাণ বাঁচানোর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিজ্ঞানকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে তিনি ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের আগেই ভ্যাক্সিন দেওয়ার দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেন। অথচ বিজ্ঞান বলছে, জরুরি ভিত্তিতেও ফাস্ট ট্র্যাক ট্রায়ালের মাধ্যমেও ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল শেষ করতে গেলে ন্যূনতম যে সময় লাগে তার অর্ধেক সময়ও তিনি নিলেন না। ফলে ট্রায়াল শেষের আগেই মোদিজির আশীর্বাদে সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি ভ্যাক্সিন ‘কোভিশিল্ড’ ছাড়পত্র পেয়ে গেল!
আজ প্রকাশ্যে আসছে, ২০২২-এর ১ আগস্ট, ২ আগস্ট ও ১৭ আগস্ট সিরাম ইনস্টিটিউটের মালিক ৫০ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে। তারপর ওই কোম্পানির মালিক আদার পুনাওয়ালা ২৩ আগস্ট ২০২২ সাক্ষাৎ করেছেন মোদিজির সাথে, আর ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই ছাড়পত্র পেয়ে গেছে ‘কোভিশিল্ড’। অতীতের সমস্ত নজির ছাড়িয়ে এর দাম ধার্য করা হল ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে। অতীতে ভ্যাক্সিন বিশ্ব জুড়েই বিনামূল্যে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সেখানে এই রকম একটা চড়া দাম ধার্য করা হল এবং মানুষকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এই দামে নিতে বাধ্যও করা হল। পরে দেশ জুড়ে আন্দোলনের চাপে সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করে চড়া দামে সিরাম ইনস্টিটিউটের থেকে কিনে নিয়ে বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতাল থেকে কিছু মানুষকে ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যবস্থা করল। পাশাপাশি ওই কোম্পানি বাজারে চড়াদামে কোভিশিল্ড বিক্রি করতে থাকল। বছর শেষে দেখা গেল ওই কোম্পানির মালিক পুনাওয়ালার ঘরে মুনাফা জমল ১ হাজার কোটি টাকা। আর ঘুরপথে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির ঘরে গেল ৫০ কোটি। সবটাই তো জনগণেরই টাকা। অথচ মানুষ এখনও জানতেও পারল না কোভিশিল্ডের ক্রিয়া এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া কী কী!
কেন্দ্রীয় সরকার বহুবার জাতীয় ওষুধ নীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে ভেষজ নীতিকে আজ চূড়ান্ত জনবিরোধী করে তুলেছে। ড্রাগ প্রাইসিং অথরিটিকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগিয়ে সরকার দফায় দফায় অত্যাবশ্যকীয় এবং জীবনদায়ী ওষুধের দাম বিনিয়ন্ত্রিত করে চলেছে। এমনিতেই ওষুধ কোম্পানিগুলো তার উৎপাদন খরচের উপর মোটামুটি ১ হাজার থেকে ৩ হাজার শতাংশ পর্যন্ত লাভ করে থাকে। তার উপরে ওষুধের বাজার দর বিনিয়ন্ত্রণের ফলে এবং ওষুধের গুণমান পরীক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামো দেশে না থাকার ফলে ইতিমধ্যেই ওষুধ কোম্পানিগুলো চড়া দামে অত্যন্ত নিম্নমানের ওষুধে বাজার ছেয়ে ফেলেছে। যতটুকু গুণমান পরীক্ষা হচ্ছে, তার ফলটাও ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে ইলেক্টোরাল বন্ডের তলায়। নির্বাচনের আগে কোম্পানিগুলো মোটা টাকা শাসক দলের নির্বাচনী তহবিলে ঢেলে দিচ্ছে আর সহস্র খুন মাফ হয়ে যাচ্ছে। এই সব বন্ডের টাকা বতর্মান শাসক দল বিজেপি এবং স্বাধীনতার পর থেকে সব থেকে বেশি সময় শাসন ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস সহ বিভিন্ন রাজ্যের শাসক আঞ্চলিক দলগুলোও পেয়েছে।
মানুষের চিকিৎসা খরচের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই খরচ হয়ে থাকে ওষুধ বাবদ। চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেশের ২৫ শতাংশের মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায়। আমাদের দেশের বাজার ইতিপূর্বেই নিম্নমানের এবং ক্ষতিকর ওষুধে ভর্তি হয়ে রয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে এইসব ক্ষতিকর ওষুধের বৃহত্তম বাজার হিসেবে ভারত চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। সেখানে নির্বাচনী তহবিলে ঘুরপথে ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের কমপক্ষে ৩৫টি বৃহৎ ওষুধ কোম্পানির অসাধু ব্যবসার লাইসেন্স আজ আরও পাকাপোক্ত হল। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ওষুধ সরবরাহ বিপুল ভাবে কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মানুষকে আজ বাধ্য করা হচ্ছে চড়া দামে বাজার থেকে নিম্নমানের ওষুধ কিনতে। যারা এভাবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তাদের ভোট দিলে এ জিনিসের পুনরাবৃত্তিই ঘটতে থাকবে। এটা হতে দেওয়া চলে কি?