এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) মার্ক্সবাদের শিক্ষাকে তুলে ধরে একটা কথা প্রথম থেকেই বলে আসছে যে, বর্তমান রাষ্ট্রটি একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং তা চলছে সম্পূর্ণরূপে পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের আইন, রীতিনীতি, পদক্ষেপ সবই তৈরি হয় পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থকে লক্ষ রেখে। কিন্তু এই সত্যটা যাতে সাধারণ মানুষ ধরতে না পারে তার জন্য বাইরে তারা একটি গণতান্ত্রিক ধাঁচা বজায় রাখে, এই স্বার্থরক্ষার কাজটা তারা পর্দার আড়ালে সারে। নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি সেই পর্দাটাকেই যেন এক টানে সরিয়ে দিয়ে গোপন যোগসাজশটাকে একেবারে বেআব্রু করে দিল।
রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে সামনে রেখে পুঁজিপতিদের শ্রেণি-স্বার্থ দেখার কাজটি করে ক্ষমতাসীন দল তথা তার সাংসদ-মন্ত্রীরা। বিনিময়ে সংসদীয় দলগুলির এবং তাদের সাংসদ-নেতা-মন্ত্রীদের পকেট ভরে দেয় পুঁজিপতিরা। সংসদীয় দলগুলি প্রায় প্রত্যেকটিই মুখে নিজেদের জনগণের সেবক বললেও, আসলে এই দলগুলি পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থে কাজ করে। তাই দলের খরচ, ভোটের খরচ, নেতা-সাংসদ-মন্ত্রীদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য তারা পুঁজিপতিদেরই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। পুঁজিপতিরাও খুশি মনে তাদের টাকা দেয়। আর এই টাকার বিনিময়ে পুঁজিপতিরা নিজেদের অনুকূলে একের পর এক আইন তৈরি করিয়ে নেয়, যা দেশের মানুষ দেখেছে তিনটি কৃষি আইনের ক্ষেত্রে কিংবা শ্রমিকদের থেকে সমস্ত অধিকার-সুযোগসুবিধা কেড়ে নেওয়া নতুন শ্রমকোড তৈরির ক্ষেত্রে। আবার ব্যক্তিগত ভাবে পুঁজিপতিরা এই সব মন্ত্রী-সাংসদদের কাজে লাগিয়ে অন্য পুঁজিপতিদের তুলনায় কিছু বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেয়। যেমন দেখা গেল, অন্য পুঁজিপতিদের টেক্কা দিয়ে আদানি গোষ্ঠী দেশের বেশির ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি হাতিয়ে নিয়েছে। সবটাই হয়েছে গোপন লেনদেনের মাধ্যমে, যে লেনদেনের এক ভগ্নাংশ মাত্রই নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ্যে এল। এমন হাজারটা ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে জনগণের স্বার্থকে বলি দিয়ে এ ভাবে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করা হয়েছে। বন্ড দুর্নীতিতে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির নাম যে ভাবে বন্ড কেনার তালিকায় প্রকাশ পেয়েছে তাতে এই যোগসাজশটাই প্রকাশ্যে এসেছে।
নরেন্দ্র মোদিরা ক্ষমতায় বসে পুঁজিপতিদের সঙ্গে এই যোগসাজশটিকে জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে নির্বাচনী বন্ড নাম দিয়ে তাকে একটা আইনি মুখোশ পরায়। সেই সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, নির্বাচন কমিশন সহ নানা মহলের প্রবল আপত্তিকে কার্যত গায়ের জোরে উড়িয়ে দেন নরেন্দ্র মোদিরা। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট সেই গোটা প্রক্রিয়াটিকেই বেআইনি তথা সংবিধান বিরোধী বলে বাতিল করেছে। নির্দেশ দিয়েছে, এই বন্ডে কারা কারা টাকা ঢেলেছে এবং কোন কোন দল সেই টাকা পেয়েছে তার সমস্ত তথ্য স্টেট ব্যাঙ্ককে জানাতে হবে। বিজেপির পাশাপাশি এই নির্দেশের বিরোধিতা করে দেশের পুঁজিপতিদের তিনটি প্রধান বণিকসভা সিআইআই, ফিকি, অ্যাসোচেম। তাঁদের আইনজীবী বলেন, কারা চাঁদা দিয়েছেন তা গোপন রাখাটা জরুরি।
কেন জরুরি? আসলে তা না হলে এই পুঁজিপতি-শাসকদল যোগসাজশটা প্রকাশ্যে এসে যায় এবং জনসাধারণও সংসদীয় দলগুলির জনস্বার্থবিরোধী প্রতারক চরিত্র খানিকটা ধরতে পারে। যাদের তারা নিজেদের স্বার্থরক্ষাকারী দল মনে করে সমর্থন করে, ভোট দেয়, সেই দলগুলির জনস্বার্থবিরোধী প্রতারক চরিত্রও প্রকাশ্যে এসে যায়। এক কথায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মুখোশটাই খুলে যায়। ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন’– কথাটিও যে আজ নেহাত মিথ্যাচারে পরিণত হয়েছে, প্রকাশ্যে এসে যায় তা-ও। ভোটবাজ দলগুলি ভোট এলে প্রকাশ্যে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ছড়ায়, তার উৎস যে পুঁজিপতি শ্রেণি, তা সামনে আসার সাথে সাথে এটাও প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, পুঁজিপতি শ্রেণির টাকায় ভোট করে যে দলগুলি, তারা পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করবে, জনগণের স্বার্থ নয়। সঙ্গে সঙ্গে এটাও পরিষ্কার হয়ে পড়ে যে, স্বাধীনতার আট দশক হতে চললেও কেন আজও সাধারণ মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনগুলি মিটল না, অথচ ভারতীয় পুঁজিপতিরা সম্পদের নিরিখে বিশ্বের প্রথম সারিতে, এমনকি কেউ কেউ দ্বিতীয় ধনীতে পরিণত হয়ে যেতে পারল! আর এ সব গোপনীয় বিষয় ফাঁস হয়ে গেলে গণতন্ত্রের মূল কথা– সকলের সমান অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীন অধিকার ইত্যাদি কথাগুলিরও আর কোনও মূল্য থাকে না।
পুঁজিপতি শ্রেণি, তাদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম এবং তাদের অনুগৃহীত বিশেষজ্ঞরা নির্বাচনকে জনগণের একটি পবিত্র অধিকার হিসাবে প্রচার করে। বাস্তবে পবিত্রতা দূরের কথা, তাতে যে কত কালি মাখানো, নির্বাচনী বন্ড-কাণ্ড তা স্পষ্ট করে দিয়ে গেল। নির্বাচনী বন্ডের সিংহভাগ বিজেপির থলিতে গেলেও, বাকি দলগুলি প্রায় সবাই কমবেশি এই বন্ড থেকে লাভবান হয়েছে। সেই টাকা সব দলই জনমতকে প্রভাবিত করতে কাজে লাগিয়েছে। অর্থাৎ এই দলগুলি জনগণের কল্যাণে তথা স্বার্থে করা কাজের দ্বারা জনমতকে জয় করার পরিবর্তে টাকা ছড়িয়ে যে সমর্থন কেনার চেষ্টা করে চলেছে, তা আজ স্পষ্ট। এই টাকা খরচ করে দলগুলি যেমন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালায়, তেমনই অসচেতন মানুষকে নগদ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাদের ভোট কিনে নেয়। আবার কোনও দল এই টাকা খরচ করে ক্লাবের যুবকদের দলের অনুগত করে পাড়ার ভোটারদের নিয়ন্ত্রণে আনে, ঠিক যেমন নির্বাচনে সন্ত্রাস তৈরি করতে এই টাকার একটা অংশ তারা সমাজবিরোধীদের পিছনে খরচ করে। আবার এই টাকা খরচ করেই তারা কেউ স্মার্ট ফোন তো কেউ ট্যাব কিংবা টিভি উপহার দেয় ভোটারদের। অর্থাৎ চলতি নির্বাচন নামক ‘পবিত্র’ ব্যবস্থাটির দ্বারা বাস্তবে জনমতের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটে না। গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থাটা নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে অর্থবান শ্রেণির পক্ষেই কাজ করে। ফলে পুঁজিপতি শ্রেণি যাদের চায় তাদের দিকে প্রশাসন-পুলিশ চক্র পুরোপুরি হেলে পড়ে। হাওয়া বুঝে সমাজবিরোধীরাও তাদের পাশেই দাঁড়ায়।
তা ছাড়া এই বিপুল পরিমাণ টাকা পুঁজিপতিদের থেকে যারা নিচ্ছে আর যারা নিচ্ছে না– খরচের জন্য জনগণের সহায়তার উপর নির্ভর করছে, উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষমতা কখনওই সমান হয় না। সৎ, জনস্বার্থে লড়াকু সৈনিকও প্রতিপক্ষের প্রচারের বানে ভেসে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগও অসম হয়ে যায়, যা গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তকেই লঙ্ঘন করে। প্রচারের জৌলুসকেই শক্তি ভেবে জনগণ প্রতারিত হয়। সে জন্য দেখা যায় জনগণের বিপুল ক্ষোভ যে দলের বিরুদ্ধে তারাও নানা উপায়ে ভোট ম্যানেজ করে জিতে যায়। নির্বাচনের নামে এই জিনিসই চলে আসছে স্বাধীনতার পর থেকে। এ কথা আজ দেশের মানুষকে স্পষ্ট করে বুঝতে হবে যে, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুঁজিপতি শ্রেণিরই বিশ্বস্ত একটি দলের পরিবর্তে আর একটি বিশ্বস্ত দল নির্বাচিত হয়– যারা শাসক শ্রেণির স্বার্থেই কাজ করে। তাই এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে অটুট রেখে শুধু সরকার বদলে জনগণের স্বার্থ রক্ষা হয় না। জনগণের স্বার্থ রক্ষা হতে পারে একমাত্র প্রবল গণআন্দোলনের আঘাতে এই ব্যবস্থাটিকে বদলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার দ্বারাই।