নির্বাচনী বন্ডের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে এক মামলা উপলক্ষে বিজেপির নির্বাচনী-দুনীর্তির যে বিরাট কারবারের কথা প্রকাশ্যে উঠে এল তা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে রীতিমতো নজিরবিহীন।
নির্বাচনে খরচ করার নামে পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের অনুগত দলগুলিকে যে বিপুল পরিমাণ টাকা দেয় তাকে আইনের চোখে বৈধ হিসাবে দেখাতে বিজেপি সরকার নির্বাচনী বন্ড নামে এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। ভোটে কালো টাকার খেলা বন্ধ করার কথা বলে ২০১৮-য় নির্বাচনী বন্ড চালু করে মোদি সরকার। এর ফলে কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিতে চাইলে বন্ড কিনে সংশ্লিষ্ট দলকে দিতে হবে। ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লক্ষ, ১০ লক্ষ এবং ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড আছে। রাজনৈতিক দলগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে সেই বন্ড ভাঙিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এই বন্ড কোন পুঁজিপতি কোন রাজনৈতিক দলকে দিচ্ছে এবং তা কত টাকার বন্ড, তা যাতে অন্য কেউ জানতে না পারে এই বন্ড সিস্টেমে তারও বন্দোবস্ত রয়েছে। এমনকী বন্ড ক্রেতা সংস্থাগুলোকেও এই দানের কোনও রকম হিসাব দিতে হয় না। অর্থাৎ আয়কর কর্তৃপক্ষ যাতে এ ব্যাপারে দাতাদের কোনও প্রশ্ন করতে না পারে, সরকার তারও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, ‘বৈদেশিক অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১০’ সংশোধন করা হয়েছে এমনভাবে যাতে ভারতে রেজিস্ট্রিকৃত বিদেশি কোম্পানিগুলি রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যত খুশি টাকা দিতে পারে।
২০১৪ সাল থেকেই বিজেপি নির্বাচনে যে বিপুল পরিমাণে টাকা উড়িয়ে চলেছে, তার উৎস যে দেশীয় ধনকুবেরদের সঙ্গে তাদের গোপন বোঝাপড়া, সেটিকে দেশের জনসাধারণের চোখ থেকে আড়াল করতেই বন্ডের এই সুচতুর ধাপ্পাটি তারা আমদানি করেছে। পুঁজিপতিরা এই বন্ডের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ টাকা রাজনৈতিক দলগুলিকে দিয়েছে তার বেশির ভাগটাই ঢুকেছে শাসক বিজেপির ভাঁড়ারে। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ অর্থবর্ষ পর্যন্ত বন্ডে বিজেপি পেয়েছে ৫,২৭১ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা।
কারা দিল বিজেপিকে এই বিপুল পরিমাণ টাকা? কেন দিল? কীসের বিনিময়ে দিল? এই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে স্বভাবতই বিজেপি নেতাদের মহা আপত্তি। উল্লেখ করা দরকার, কংগ্রেস সহ অন্য সব শাসক দলই পরিমাণে বিজেপির থেকে কম হলেও এই চাঁদা পেয়ে থাকে।
সুপ্রিম কোর্টে এই সংক্রান্ত একটি মামলা শুরু হয়েছে। শুরুর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল আর ভেঙ্কটরামানি শীর্ষ আদালতে হলফনামা দিয়ে দাবি করেছেন, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের আর্থিক অনুদানের উৎস জানার অধিকার নাগরিকদের নেই, থাকতে পারে না। বলেছেন, কোন রাজনৈতিক দলের ভাঁড়ারে কোন পুঁজিপতির থেকে কত টাকা এসেছে, এই তথ্য না জানানোটা কোনও বিদ্যমান অধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে না এবং সংবিধানের দেওয়া মৌলিক অধিকারের পরিপন্থীও নয়। বলেছেন, সাংবিধানিক আদালত সরকারের কোনও পদক্ষেপের পুনর্মূল্যায়ন তখনই করতে পারে, যখন তা কোনও বিদ্যমান অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। বলেছেন, যদি কোনও বিষয়কে প্রথম বার অধিকারের আওতায় আনার প্রশ্ন ওঠে, সে ক্ষেত্রে বিষয়টি সাধারণ্যে এবং সংসদীয় বিতর্কেই নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।
দেখা যাক, বিজেপির দেওয়া যুক্তির আদৌ কোনও সারবত্তা আছে কি না। প্রথম কথা, একটি ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রে ‘গণ’ মানে তো দেশের জনগণ। অন্য যে কোনও রাজনৈতিক দলের মতো বিজেপি নেতারাও তো দাবি করেন যে, তাঁরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তা হলে, দল পরিচালনার জন্য, নির্বাচনে খরচের জন্য টাকাও জনগণেরই দেওয়ার কথা এবং দলেরও জনগণের সামনে তাদের দল পরিচালনা ও নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য টাকা কোথা থেকে আসছে তা খোলামেলা ভাবেই রাখার কথা। বিজেপি নেতাদের সেই সত্য জনগণকে জানাতে ঘোরতর আপত্তি। কেন? তবে কি তাঁদের দলের টাকার উৎসটি এমন, যে তা প্রকাশ্যে আনা যায় না? না হলে যে জনগণের ভোটে তাঁরা নির্বাচিত হচ্ছেন, বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হচ্ছেন, সরকার চালাচ্ছেন, সেই জনগণকে এ ব্যাপারে অন্ধকারে রাখতে চাইছেন কেন? এমনকি সংবিধান অনুযায়ীও একজন নাগরিকের রাজনৈতিক দলগুলির আয় সম্পর্কে জানার অধিকার রয়েছে। এই যে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ধনকুবেরদের দেওয়া টাকা বিজেপির ভাঁড়ারেই সবচেয়ে বেশি ঢুকছে, তা তো এমনি এমনি নয়। যে পুঁজিপতিরা শ্রমিক-কৃষক-জনগণের ঘাম-রক্ত-জীবন লুট করে মুনাফা কামায়, তারা এমনি এমনি কোনও রাজনৈতিক দলকে ‘চাঁদা’ দিচ্ছে, এটা নিশ্চয় কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন কোনও মানুষ বিশ্বাস করবে না। তা হলে তারা বিজেপিকে এই বিপুল পরিমাণ টাকা কীসের বিনিময়ে দিচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, তা বিজেপি নেতারা যতই সেই অধিকারকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করুন।
এ কথা আজ আর কারও অজানা নয় যে, বিজেপি সরকার ক্ষমতার বসার সময় থেকেই অতি নগ্ন ভাবে দেশের একচেটিয়া পুঁজির সেবা করে চলেছে। ধনকুবেরদের স্বার্থেই একের পর এক যেমন আইন নিয়ে এসেছে, তেমনই নিয়ে চলেছে প্রশাসনিক পদক্ষেপ। একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে আনা কৃষি আইনের কথা আজ আর কারও অজানা নয়। গত প্রায় আট দশক ধরে দেশের জনগণের অর্থে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে পাইকারি হারে তারা এই পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। ফলে তেল, রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, বন্দর, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি সব কিছু, যা কিছুই জনগণের সম্পত্তি, তা আজ একচেটিয়া পুঁজির দখলে। তাদের সেবায় এ ভাবে জনস্বার্থকে বলি দেওয়ার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি ধনকুবেরদের সবচেয়ে আস্থাভাজন দলে পরিণত হয়েছে।
জনগণের স্বার্থে কাজের সাফল্যের নিরিখে সমর্থন চাওয়া নয়, টাকা ছড়িয়ে প্রচারের জৌলুসে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া, ভোট কিনে ক্ষমতার গদি দখল করা এবং তাতে টিকে থাকা। অর্থাৎ জনস্বার্থকে পদদলিত করেও টাকা ছড়িয়ে এবং প্রচারের জোরে ক্ষমতা দখল করে আবার আরও বেপরোয়া ভাবে জনস্বার্থকে পদদলিত করা এবং পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা করা। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিজেপি নেতারা স্বীকার না করলেও, নির্বাচনী বন্ডের দ্বারা অবৈধ ভাবে পাওয়া টাকার জোরে বাস্তবে তারা স্বচ্ছ এবং মুক্ত ভোটের যে গণতান্ত্রিক অধিকার তাকেই হরণ করছেন। আর প্রিয় দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে তারা এ ভাবে তাদের পিছনে টাকা ঢেলে যাবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিজেপি নেতারা এই টাকার ‘সদ্ব্যবহার’ও সেভাবেই করছেন।
শাসক দলগুলির নেতারা যেমন পুঁজিপতিদের নানা নামে দেওয়া এই টাকায় হেলিকপ্টার চড়ে, দামি গাড়ি চড়ে, বিপুল বৈভবে জীবন কাটায়, টাকা ছড়িয়ে অনুগত বাহিনী তৈরি করে, নির্বাচনে যথেচ্ছ খরচ করে, উল্টোদিকে পুঁজিপতিরা তাদের পছন্দমতো রাজনৈতিক দলকে ‘পলিটিকাল ম্যানেজার’ হিসাবে সরকারি গদিতে বসায়। ঠিক করে দেয় ভোটে কে প্রার্থী হবে, জিতে কে মন্ত্রী হবে, কোন বিষয়ে আইন তৈরি করতে হবে, কোন আইনকে বদলাতে হবে। অনেকেরই মনে আছে, টু-জি কেলেঙ্কারির তদন্তের সময়ে বেরিয়ে এসেছিল যে, ডি রাজাকে টেলিকম মন্ত্রী করার পিছনে টাটার সুপারিশ ছিল। পরবর্তী কালে গোপনীয়তার ফাঁক গলে বারে বারে বেরিয়ে এসেছে যে, তেলমন্ত্রী ঠিক করার পিছনে আম্বানি সহ তেল লবির হাত কী ভাবে কাজ করে। জনবিরোধী কৃষি আইন তৈরির পিছনে যে আদানিদের হাত ছিল তা প্রকাশ্যে এসে গেছে।
কাজেই নির্বাচনী বন্ডের আড়ালে যতই বিজেপি নেতারা পুঁজিপতিদের সাথে তাদের আঁতাত আড়াল করার চেষ্টা করুক, এই বন্ডের দুর্নীতি আজ দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। দেশের জনসাধারণ দাবি করছে, সুপ্রিম কোর্ট এই বন্ড ব্যবস্থাকে বাতিল করুক।