বিজেপির দ্বিতীয় দফায় কেন্দ্রীয় সরকারি ক্ষমতা দখল এমন একটা সময়ে যখন গোটা দেশ অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত৷ অর্থনীতির বেহাল দশার পাশাপাশি ভোটের আগে চেপে রাখা খোদ সরকারি রিপোর্টেই বেরিয়ে এসেছে– দেশে বর্তমান বেকারির হার গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ খরায় জ্বলছে চাষির জীবন৷ শিক্ষা–স্বাস্থ্যের ব্যাপক অভাব, প্রশাসনিক অকর্মণ্যতা, চুরি–দুর্নীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং জাতপাত–সম্প্রদায়গত বিভেদকে কেন্দ্র করে হানাহানির মতো হাজারো সমস্যায় জনজীবন বিপর্যস্ত৷ এই অবস্থায় দ্বিতীয় দফার নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রথম সর্বদলীয় বৈঠকে এই জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষকে রেহাই দেওয়ার রাস্তা দ্রুত খুঁজে বের করার চেষ্টা হওয়াটাই ছিল বাঞ্ছনীয়৷ অথচ দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী আলোচনার প্রধান বিষয় হিসাবে বেছে নিলেন ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি, যার সাথে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রধান সমস্যাগুলির কোনও সম্পর্কই নেই৷ শুধু তাই নয়, পরদিন, নতুন সরকার গঠনের পর রাষ্ট্রপতির প্রথম ভাষণেও উঠে এল এই ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির কথাই৷ যা থেকে স্পষ্ট, দ্বিতীয় দফার মোদি সরকার এই নীতি দ্রুত চালু করাকেই প্রধান লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিয়েছে৷ প্রথম দফায় সরকারে থাকার সময় থেকেই এটি মোদি সরকারের লক্ষ্যে ছিল৷
কী এই ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি? এর অর্থ, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনগুলি একসঙ্গে করা৷ কেন এই ব্যবস্থা চালু করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদিরা? তাঁদের বক্তব্য, এই নীতি চালু হলে ভোটের খরচ অনেক কমানো যাবে৷ তাছাড়া বছরে একাধিকবার ভোট হওয়ার কারণে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজকর্মে বাধা পড়ে৷ এগুলি থেকে রেহাই পেতেই নাকি ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করতে এত ব্যগ্র বিজেপি৷
সত্যিই কি তাই? নাকি এর পিছনে রয়েছে বিরোধিতা মুছে ফেলে সমস্ত রাজনৈতিক–প্রশাসন ক্ষমতা নিজেদের হাতে কেন্দ্রীভূত করার অন্য হিসেব? কারণ, একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট হলে আঞ্চলিক দলগুলির অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে৷ দেখা গেছে, একসঙ্গে ভোট হলে ভোটারদের কাছে জাতীয় দলই প্রাধান্য পায়, আঞ্চলিক দলগুলি নয়৷ এমনকি সমীক্ষা রিপোর্টও দেখাচ্ছে, কোনও রাজ্যে লোকসভা ও বিধানসভা একসঙ্গে হলে, প্রায় ৮০ শতাংশ ভোটার একটি দলকেই ভোট দেন৷ স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাপক আর্থিক শক্তি, যা পুঁজিপতিরা তাদের ঢেলে দেয়, প্রশাসনিক সমর্থন এবং প্রচার মাধ্যমের জোরে সেটি হয় প্রধান কোনও জাতীয় তথা শাসক দল, ছোট কোনও আঞ্চলিক দল নয়৷ বিজেপির মতো আধিপত্যবাদী দলগুলির তো এটাই প্রয়োজন বিজেপি যে একচেটিয়া পুঁজিপতি প্রভুদের ম্যানেজার হিসাবে সরাকার চালায়, তাদের স্বার্থই এখানে প্রধান৷ কারণ বাজারসংকটে জর্জরিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে এদেশের বুকে টিকিয়ে রাখতে গেলে, ক্রমাগত অধিক মুনাফা অটুট রাখতে গেলে সমস্ত বিরোধিতাকে নির্মূল করে সাধারণ জনগণ এবং শ্রমিক শ্রেণির যেটুকু অধিকার এখনও বজায় আছে, শ্রম–সংস্কার সহ অন্যান্য সংস্কারের নামে সেটুকুও বাতিল করে আরও নির্মম, আরও দানবীয় শোষণের রাস্তা খুলে দিতে হবে৷ সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকারে পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্বস্ত সেবাদাস দলগুলি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতাতেই শুধু হবে না, রাজ্যের সরকারগুলিও কব্জায় রাখা দরকার৷ ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি চালু হলে বিধানসভাগুলি দখল করার সুবিধা হবে৷
‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি চালু করতে নরেন্দ্র মোদিদের উদগ্র আগ্রহ আরও একটি প্রশ্ন তুলেছে৷ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জানে, জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানের ঘোষণা নয়, বিজেপির মতো দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন দলটির ভোটে লড়ার প্রধান হাতিয়ার মানুষে মানুষে সম্প্রদায়গত বিভেদ বাধিয়ে সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি অথবা দেশের প্রতি দেশবাসীর আবেগকে কাজে লাগিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া তোলা৷ সব মহল থেকেই অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে এই নীতি চালু করে ২০২৪–এর বদলে আগামী লোকসভা ভোট স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির ঐতিহাসিক বছর ২০২২–এ এগিয়ে এনে নরেন্দ্র মোদিরা আবার উগ্র জাতীয়তার ঝড় তুলে ভোটের আসর মাত করতে চাইছেন৷
প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রে বা রাজ্যে মেয়াদ ফুরানোর আগে সরকার পড়ে গেলে কী হবে, তা নিয়েও৷ ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি সমর্থনে নীতি আয়োগের একটি আলোচনাপত্রে এ সমস্যা সমাধানে ইতিমধ্যেই একটি সুপারিশ করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, যদি সরকার ভেঙে দেওয়া অবধারিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভা গঠন করে প্রশাসন চালাবেন৷ অর্থাৎ ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যত এককেন্দ্রিক তথা রাষ্ট্রপতি–কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের পথ সুগম করে দেবে, যা এ দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর একান্ত পরিপন্থী৷
‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির সপক্ষে যে প্রধান দুটি যুক্তি মোদিজিরা দিয়েছেন, তা কত অসার দেখা যাক৷ তাঁরা এই নীতির সপক্ষে ভোটের খরচ কমার যুক্তি তুলেছেন৷ সম্প্রতি একাধিক সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে, ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যে পরিমাণ টাকা খরচ করেছে, আজ পর্যন্ত এদেশের কোনও নির্বাচনে অন্য কোনও দল এত বেশি পরিমাণ টাকা খরচ করেনি৷ এর পরও কি বুঝতে অসুবিধা হয় যে খরচ কমানো আসলে এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য নয়৷ হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাট বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে হওয়ার কথা ছিল৷ অথচ তা না করে তারা আলাদা আলাদা সময়সূচি ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করেছিল৷ সম্প্রতি খালি হওয়া গুজরাটের দুটি আসনের ভোটও আলাদা দিনে করা হচ্ছে৷ খরচ কমানো উদ্দেশ্য হলে সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচন প্রায় দু’মাস ধরে সাত দফায় অনুষ্ঠিত করা হল কেন?
‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির পক্ষে দাঁড়াতে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় যে যুক্তিটি এনেছেন, সেটিও নিতান্ত হাস্যকর৷ তিনি বলেছেন, বার বার ভোট হওয়ার ফলে আদর্শ আচরণবিধি মানতে গিয়ে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ রাখতে হয়৷ জনজীবনের উন্নয়ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল কত উদ্বিগ্ণ গত পাঁচ বছরের বিজেপি শাসনের অভিজ্ঞতায় মানুষ তা জানে৷ ৪৫ বছরে বেকারের সংখ্যাকে সর্বোচ্চ জায়গায় নিয়ে যাওয়া, লক্ষ লক্ষ চাষিকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া, ‘ফসল বিমা যোজনা’, ‘উজ্জ্বলা যোজনা’র মতো ধোঁকাবাজিতে গরিব পরিবারগুলিকে ঠকালো৷ রাজ্যে রাজ্যে কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা বিরোধী মানুষকে খুন করানো, সম্প্রদায়–জাত–পাতে বিরোধ বাধিয়ে একের পর এক হত্যা করে সন্ত্রাস ছড়িয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ করা– মোদি সরকারের গত পাঁচ বছরের ইতিহাসে ‘উন্নয়নের’ অসংখ্য নজির ছড়িয়ে আছে৷ ভোট ঘোষণার গন্ধ পেলে শিলান্যাসের ধূম পড়ে৷ এর নাম উন্নয়ন ফলে বোঝাই যায়, একদিকে প্রতিটি রাজ্য সহ গোটা দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রপতিপ্রধান শাসনব্যবস্থা, কিংবা দ্বিদলীয় ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনাই রয়েছে ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি প্রণয়নে মোদিজিদের এই অতি তৎপরতার পিছনে৷ এ যদি বিজেপি কার্যকর করতে পারে জনগণের উপর দেশি–বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির শোষণ–লুন্ঠনের স্টিমরোলার আরও নির্মম ভাবে চলবে জনগণের উপর৷