নিয়োগ দুর্নীতিতে সংকটে স্কুলশিক্ষা দায়ী রাজ্য সরকার

সুপ্রিম কোর্টে আপাতত পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীর চাকরি রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। একই সাথে কাটেনি শিক্ষার প্রাঙ্গনে শিক্ষকদের ঘিরে যোগ্য-অযোগ্য তরজা। এর বিষময় ফল শুধু স্কুল শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের চাকরি জীবনে পড়ছে না, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ সাধারণ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ঘরের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবনের উপরেও বর্তাচ্ছে।একই সাথে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরির যে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা সরকার এবং পুঁজিমালিকরা বেশ কিছু বছর ধরে করে চলেছে তাও অনেকটা জোর পাচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায় কার? সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টাকে ‘সিস্টেমিক ফ্রড’ অর্থাৎ গোটা ব্যবস্থাপনার মধ্যেই দুর্নীতি থাকার কথা বলেছে। সবচেয়ে অদ্ভূত অবস্থান নিয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)। তারা কখনও বলছে যোগ্য-অযোগ্য কর্মীদের আলাদা করা সম্ভব, কখনও বলছে যারা চাকরি করছে তাদের মধ্যে অযোগ্য কেউ আছে কি না তা বলা সম্ভব নয়। আবার অযোগ্য শিক্ষকদের সংখ্যা কত তা নিয়েও আছে ধোঁয়াশা।২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার মূল ওএমআর শিট নষ্ট করে ফেললেও তার স্ক্যান করা কপি আছে কি না তাও ঠিক করে বলা যাচ্ছে না।যদিও শোনা যাচ্ছে কিছুদিন আগেও আরটিআই করা পরীক্ষার্থীদের স্ক্যান করা ওএমআর শিটের কপি দিয়েছে এসএসসি। সবচেয়ে বড় কথা, অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার জন যে পিছনের দরজা দিয়ে অবৈধভাবে চাকরি পেয়েছে তা এসএসসি মেনে নিয়েছে। যদিও সিবিআই বলছে সংখ্যাটা আট হাজারের বেশি।বিষয়টির আইনি নানা খুঁটিনাটি, সাড়ে পাঁচ হাজার অবৈধ নিয়োগের জন্য সকলের চাকরি যাওয়া ন্যায় বিচার কি না ইত্যাদি প্রশ্ন ছেড়ে দিলেও একটা কথা এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই, এই গোটা পরিস্থিতির জন্য মূল দায়ী রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার।

তারা এই ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি চলতে দিয়েছে।তৃণমূলের মন্ত্রী থেকে শুরু করে এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মতো সংস্থার মাথায় যে সব দলীয় লোককে বসিয়েছে তারাও সারা গায়ে দুর্নীতির কালি মেখেছে।স্কুলে নিয়োগের কোনও একটি ক্ষেত্রও যে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ তা তৃণমূলের অতি বড় নেতারাও হলফ করে বলতে পারবেন না। বহু শূন্য পদ থাকা সত্ত্বেও স্কুলে প্রত্যেক বছর নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া কিংবা নিয়োগ করা এ রাজ্যে বন্ধ রয়েছে। ফলে প্যানেলে থাকা, টেট পাশ করা, ওয়েটিং লিস্টে থাকা অসংখ্য চাকরিপ্রার্থী এক বছরের বেশি সময় ধরে ধরনা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজ্য সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এই চাকরিপ্রার্থীদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেনি। অথচ মন্ত্রীর কন্যা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের প্রভাবে পিছনের দরজা দিয়ে চাকরি পাওয়া প্রার্থীদের রক্ষায় রাজ্য সরকার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। অভিযোগ উঠেছে, ঘুষ দিয়ে পাওয়া অযোগ্যদের চাকরি বাঁচাতে রাজ্য সরকারের মন্ত্রীসভা অতিরিক্ত পদ তৈরি করার সুপারিশ করেছে।

সিবিআই-ইডির অপদার্থতা

একই সাথে সিবিআই, ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির অপদার্থতাও সমগ্র বিষয়টিকে জটিল করতে সাহায্য করেছে। স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত বিগত দুই বছরে কার্যত কিছুই এগোয়নি। তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করার তেমন উদ্যোগ মানুষের চোখে পড়েনি। কেন্দ্রীয় শাসকদলের নির্বাচনী স্বার্থে বিষয়টিকে দীর্ঘায়িত করে ইস্যুটাকে জিইয়ে রাখাটাই একমাত্র লক্ষ্য কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন ২০২২-এর ২৩ জুলাই। এখনও সেই মামলার বিচারই পুরোপুরি শুরু হয়নি। অন্যান্য মামলাগুলির অবস্থাও তাই।স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বিচারক হঠাৎ করে বিজেপির ভোটপ্রার্থী হয়ে যাওয়া যেমন বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে নানা প্রশ্ন-সন্দেহের জন্ম দিয়েছে, তেমনই তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনকে দুর্বল করেছে।

রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলিতে এমনিতেই শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর অভাব।তার জন্য বহু স্কুলই কার্যত চলছে আংশিক সময়ের শিক্ষক, চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী দিয়ে।এর ওপর যোগ্য অযোগ্য এই নিয়ে স্কুলে টানাপোড়েন ইত্যাদির কারণে স্কুলগুলিতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কই নড়বড়ে হতে বসেছে।ফলে ইতিমধ্যে জনগণের আস্থা হারানো সরকারি স্কুল-শিক্ষাব্যবস্থা আরও আস্থা হারাচ্ছে।এর সুযোগে গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত গজিয়ে উঠছে নানা বেসরকারি স্কুল। একেবারে নার্সারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক সব স্তরেই এখন বেসরকারি স্কুলের রমরমা বাড়ছে।সাম্প্রতিক স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় দেশের প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন, ‘সরকারি চাকরি এমনিতেই দুর্লভ’। কথাটা অতি বাস্তব। দেশে মোটামুটি স্থায়ী এবং সম্মানজনক বেতনের কর্মক্ষেত্র আজ এতটাই দুর্লভ যে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী নিজের সবকিছু সঁপে দিয়েও সরকারি বা এডেড স্কুলে একটা কাজ জোগাড়ে মরিয়া হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে চাকরি বেচে অসাধু উপায়ে পয়সা কামানোর শক্তিশালী চক্র।আজ কোনও সরকারি দপ্তরের নিয়োগই দুর্নীতিমুক্ত নয়।নার্স, পুলিশ, পুরসভার নিয়োগ সব ক্ষেত্রেই সীমাহীন দুর্নীতির খবর সামনে আসছে।এই প্রতিটি চক্রের সঙ্গেই সরকারি দলের নেতারা যুক্ত হয়ে আছেন।

নিয়োগ দুর্নীতি বিজেপি শাসিত রাজ্যেও

তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে দলগুলো ভোটের বাজার গরম করছে তাদের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে কোনও মতেই স্বচ্ছ নয়। ভারতে নিয়োগ দুর্নীততে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হল মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকারের ব্যাপম কেলেঙ্কারি।এই কেলেঙ্কারিতে বছরের পর বছর ধরে টাকার বিনিময়ে ভর্তির পরীক্ষায় জাল পরীক্ষার্থী বসানো, রেজাল্ট বদলে দিয়ে নিয়োগ ইত্যাদি চলেছে।একেকটা নিয়োগে লক্ষ লক্ষ টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। সিবিআই এবং মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট নিযুক্ত সিটের হিসাবেই তাদের তালিকায় থাকা সাক্ষীদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন খুন হয়ে গেছেন।এই কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছিল রাজ্যের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী থেকে একেবারে রাজ্যপাল পর্যন্ত। সুপ্রিম কোর্ট এই মামলায় প্রায় সাড়ে ছ’শো চিকিৎসকের ডিগ্রিকে অবৈধ ঘোষণা করলেও দোষীদের কোনও শাস্তিই হয়নি।

গত বছর মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকার পরিচালিত পাটোয়ারি নিয়োগ পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে যে, তাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কোন কোন বিষয়ে পরীক্ষা দিলেন’? প্রশ্ন শুনে সে হতভম্ব হয়ে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।এই পরীক্ষার প্রথম দশজনের সাত জনই বিজেপি এমএলএ-র মালিকানাধীন একটি বেসরকারি কলেজের পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে যেটুকু আসছে তাতেই বলা হচ্ছে এই কেলেঙ্কারি ব্যাপমকেও ছাপিয়ে যাবে (ইন্ডিয়া টুডে, ১৮ জুলাই, ২৩)।সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের ফার্মাসি পরীক্ষায় খাতায় শুধু ‘জয় শ্রী রাম’ লিখে ৫০ শতাংশের ওপর নম্বর পাওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড় হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা উত্তরপ্রদেশে একটা নয় অসংখ্য ঘটছে বলে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন (এই সময়, ২৭ এপ্রিল ’২৪)। ২০২০ তে উত্তরপ্রদেশে ৬৯ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করেছিলেন আইপিএস অফিসার সত্যর্থ অনিরুদ্ধ পঙ্কজ। এই তদন্তে কয়েকজন গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই এই অফিসারকে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সরকার মাঝরাতে নির্দেশ দিয়ে প্রয়াগরাজ পুলিশের বড়কর্তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়। তাঁকে দীর্ঘদিন কোনও পোস্টিংও দেওয়া হয়নি (এনডি টিভি, ১৬ জুন ’২০)।

নিয়োগ দুর্নীতি সিপিএম আমলেও

পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম আমলে এসএসসি তৈরির আগে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে স্কুলের চাকরি হয়েছে।দলবাজি, স্বজনপোষণের বহু অভিযোগ এসএসসি নিয়োগেও ছিল। চিরকুটে চাকরি পঞ্চায়েত থেকে নানা দপ্তরে ছিল ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা।১৯৯৩ এবং ১৯৯৬ অবিভক্ত মেদিনীপুরে ২২০০ জন প্রাথমিক শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এদের নিয়োগ করা হয়েছে।২০১৪-তে ত্রিপুরায় সিপিএম সরকারের নিযুক্ত ১০,৩২৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ বলে হাইকোর্ট বাতিল করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টও তা বহাল রাখে।

বিজেপি-তৃণমূল কংগ্রেস-সিপিএম সহ সমস্ত ভোটবাজ দল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে কানও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে তৈরি।তাদের নীতি-আদর্শহীন রাজনীতি যে কোনও উপায়ে গদি লাভের সাথে যে কোনও উপায়ে টাকা কামানোর পথ করে দেয়।পুঁজিবাদী সমাজের রক্ষক রাজনীতিই এই দুর্নীতির জন্মদাতা।এটাই এই সীমাহীন দুর্নীতির আসল কারণ।দুর্নীতি রুখতে হলে তাই সঠিক বামপন্থী আদর্শভিত্তিক রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে যত চিৎকারই করা হোক তাকে রোখা যাবে না।