নিপীড়িত মানুষের ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে আমেরিকা

 

আগুন জ্বলছে আমেরিকায়। ২৫ মে শ্বেতাঙ্গ এক মার্কিন পুলিশের হাতে নৃশংস ভাবে খুন হন একজন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার গরিব-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গ জনসাধারণের বুকে জমে থাকা দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার জ্বালা প্রবল ভাবে ফুঁসে উঠেছে।

ওই দিন মিনিয়াপোলিসে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে মাটিতে ফেলে তাঁর গলা হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছিল শ্বেতাঙ্গ পুলিশ ডেরেক শাভিন। দম বন্ধ হয়ে আসছিল ফ্লয়েডের। বার বার আর্ত স্বরে তা বলার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কান দেয়নি খুনি পুলিশটি। টানা ন’মিনিট ওইভাবে ফ্লয়েডের গলা চেপে ধরে রেখেছিল সে। শেষ পর্যন্ত শ্বাস রুদ্ধ হয়ে মারা যান ফ্লয়েড।

এই ঘটনায় প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েন আমেরিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী মানুষ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের উত্তাল বিক্ষোভে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আমেরিকার প্রায় প্রতিটি শহরের রাজপথ। আতঙ্কিত শাসক ৪০টি শহরে কারফিউ জারি করে। গোটা দেশ জুড়ে নামানো হয় সেনা। কিন্তু পরোয়া নেই মানুষের। লাঠি চালিয়ে, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়ে, ঘোড়সওয়ার পুলিশ লেলিয়ে, লঙ্কা গুঁড়ো স্প্রে করে, এমনকি গুলি চালিয়েও মার্কিন পুলিশ ও সেনা থামাতে পারছে না বিক্ষোভকারীদের উদ্দাম স্রোত। সমস্ত বাধা অগ্রাহ্য করে বিক্ষোভকারীরা এমনকি প্রেসিডেন্টের দপ্তর হোয়াইট হাউসের দিকেও ধেয়ে আসেন গত ২৯ মে। প্রতি মুহূর্তে যাঁর রণহুঙ্কারে গোটা বিশ্ব কাঁপে, স্বয়ং সেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আতঙ্কিত হয়ে মাটির নিচে বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হয়। বাইরে রাজপথে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষরত বিক্ষোভকারীরা চিৎকার করে বলতে থাকেন– ‘আমাদেরও শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে’, ‘এই প্রজন্ম আর পড়ে পড়ে মার খেতে রাজি নয়’।

সারা বিশ্বকে গণতন্ত্রের পাঠ শেখানোর স্বঘোষিত গুরুমশাই মার্কিন প্রশাসন বর্ণবিদ্বেষের বিষে ছেয়ে আছে। মাঝে মাঝেই অকারণে বা তুচ্ছ কারণে কালো মানুষের ওপর সাদা পুলিশের বর্বর অত্যাচারের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রতি বছরই বেশ কিছু মার্কিন অশ্বেতাঙ্গ মানুষের মৃত্যু ঘটে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে। এক সময় আমেরিকা স্ট্যাচু অফ লিবার্টি তৈরি করেছিল। ডাক দিয়ে বলেছিল– দুনিয়ার শ্রান্ত শ্রমিক, আমার কাছে এস, আমি তোমায় আশ্রয় দেব। আজ সেই আমেরিকার মারাত্মক সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী শাসকরা উগ্র দেশপ্রেম, ছদ্ম জাতীয়তাবাদের ঢেউ তুলে খেটে-খাওয়া মানুষের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করতে চাইছে। মার্কিন কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাতে ইন্ধন দিচ্ছেন। আজ তাই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে। মার্কিন শাসকরা যত বেশি করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনাকে হত্যা করছে, এই বিষ তত বাড়ছে। ট্রাম্প প্রশাসন দেশের ভয়াবহ বেকার সমস্যা সহ সমস্ত সংকটের দায় কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিক, অভিবাসী মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাইছে। দিনে দিনে তাই এই মানুষগুলির বুকে জমে উঠেছে বিক্ষোভের বারুদ। দেশের শ্বেতাঙ্গ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও এই অন্যায় মেনে নিতে পারছেন না। গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকা তাই বার বার উত্তাল হয়েছে বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস হত্যা সেই আন্দোলনে নতুন করে জ্বালানি জুগিয়েছে।

বাস্তবে, একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই বিক্ষোভ, শাসকের বিরুদ্ধে এই প্রবল ক্রোধের পিছনে শুধু বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতা আছে, তা নয়। এর পিছনে রয়েছে চলমান শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অত্যাচারিত, শোষিত সাধারণ মানুষের অসহ্য জীবনযন্ত্রণার জ্বালা। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার শিরোমণি আমেরিকা অর্থ ও অস্তে্রর জোরে গোটা দুনিয়ার ওপর যতই ছড়ি ঘোরাক, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অমোঘ নিয়মে ভিতরে ভিতরে তার ক্ষয় ধরেছে। পুঁজিমালিকদের শোষণে শোষণে জর্জরিত মার্কিন জনগণের একটা বিরাট অংশ আজ হতদরিদ্র। তাদের পেটের খাবার নেই, থাকার ঘর নেই, জিনিসপত্র কেনার সঙ্গতি নেই। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটনের মতো বড় শহরগুলিতে অসংখ্য মানুষ অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে বাস করেন। এঁদের একটা বড় অংশ কৃষ্ণাঙ্গ। সম্প্রতি করোনা মহামারির আক্রমণ নগ্ন করে দিয়ে গেল আমেরিকার ভিতরকার অন্ধকার চেহারাটা। দেখা গেল, বিমানির্ভর বেসরকারি চিকিৎসার বিরাট খরচ বহন করার ক্ষমতা নেই বেশিরভাগ মানুষের। ফলে করোনার আক্রমণে প্রায় বিনা চিকিৎসায় ইতিমধ্যেই মরতে হয়েছে লক্ষাধিক মানুষকে। সরকারের হেলদোল নেই। করোনা মোকাবিলায় লকডাউন জারি করেই ট্রাম্প সাহেব হাত তুলে নিয়েছেন। এদিকে এমনিতেই বেকারত্বের জ্বালায় জেরবার মার্কিন যুবসমাজের ওপর নেমে এসেছে বেকারির আরও ভয়ঙ্কর আঘাত। সব মিলিয়ে অসহনীয় দুর্দশায় জীবন জেরবার হয়ে যাচ্ছে আমেরিকার সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের। তাদের বুকের ভিতরে ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিলই, ফ্লয়েডের নৃশংস হত্যায় সেই আগুন দাউদাউ জ্বলে উঠেছে। তাদের এই বিক্ষোভ বাস্তবে এই পচা গলা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিরই বিরুদ্ধে যা তাদের জীবনকে সমস্ত দিক থেকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

এই ঘটনায় মনে পড়ে যায়, এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী দার্শনিক, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা। তিনি দেখিয়েছেন, জীবনযন্ত্রণায় জেরবার মানুষ বার বার আন্দোলনের ময়দানে ছুটে আসবে, বার বার বিক্ষোভে তারা ফেটে পড়বে। কিন্তু যতক্ষণ না সেই বিক্ষোভ সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথে হাঁটবে, ততক্ষণ শত সংগ্রাম, হাজারো প্রাণদান ব্যর্থ হবে। বিক্ষুব্ধ মার্কিন জনসাধারণকেও আজ বুঝতে হবে এই কথা।