১১-১২ ডিসেম্বর ঘাটশিলায় অনুষ্ঠিত এআইডিওয়াইও-র সর্বভারতীয় সম্মেলনে প্রতিনিধিদের উদ্দেশে এসইউসিআই(সি)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ নিচের বার্তাটি পাঠান।
সর্বপ্রথমে আমি, এ যুগের অগ্রগণ্য মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রতিষ্ঠিত এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পক্ষ থেকে আপনাদের বিপ্লবী অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই বিশাল দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে বহু বাধা অতিক্রম করে আপনারা এখানে উপস্থিত হয়েছেন, যুবসমাজ যে সব সমস্যার সম্মুখীন তা নিয়ে আলোচনা করতে এবং দেশজোড়া যুব আন্দোলন গড়ে তোলার উপযুক্ত কর্মসূচিগুলির পরিকল্পনা গ্রহণ করতে।
নদীর জলে কাউকে ডুবে যেতে দেখলে, কে তাকে বাঁচাতে জলে ঝাঁপ দেয়? সকলেই জানেন, একমাত্র সাহসী যৌবনই তা করে। কোথাও জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা যখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এলাকাবাসীকে বিপন্ন করে তোলে, তখন যৌবনের অদম্য চেতনাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করে। আবারও যখন বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানব জীবনের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে, তখনও কেবলমাত্র সাহসী যুবকরাই আক্রান্তদের উদ্ধারে উদ্যোগ নেয়।
একইভাবে, ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে সমাজ যখন ক্রমবর্ধমান হারে গভীরতর সঙ্কটের মুখোমুখি হয় এবং পরিণামে খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন যখন অশেষ জ্বলন্ত সমস্যায় আক্রান্ত হয়, সেই যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি থেকে মানুষকে রক্ষা করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাদের? চিরদিনই এ দায়িত্ব পালন করে এসেছে একমাত্র সেইসব যুবক যারা যথার্থই ‘যুবক’ নামের যোগ্য। শুধুমাত্র বয়সের দ্বারাই কেউ ‘যুবক’ নামের যোগ্য হয় না, যুবক নামের যোগ্য একমাত্র সে-ই, যার সমাজ ও বিপ্লবী মতাদর্শের প্রতি দৃঢ় দায়বদ্ধতা আছে। সমস্ত বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে যাবতীয় নিপীড়ন, শোষণ, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে অদম্য সাহস, অপ্রতিরোধ্য চেতনা, নৈতিকতার উচ্চ মান নিয়ে যারা সংগ্রাম গড়ে তোলে, তারাই একমাত্র যুবক নামের যোগ্য।
আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন, আর যুবসমাজের অবশ্যকরণীয় কর্তব্যই বা কী হওয়া উচিত,তা এআইডিওয়াইও-র সর্বভারতীয় সম্মেলন বিশ্লেষণ করে স্থির করবে।
আমরা লক্ষ করছি, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের অংশ হিসাবে আমাদের দেশের শাসক-শোষক পুঁজিপতি শ্রেণি নিজেদেরই তৈরি যে সমস্যার সামনে পড়েছে, সেটি হল বাজার সঙ্কট। একচেটিয়া পুঁজিবাদ সর্বোচ্চ মুনাফা লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে সর্বাধিক শোষণ চালানোয় জনগণের ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত হারে কমে যাচ্ছে। এর পরিণামে বাজার সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে এবং হাজার হাজার কলকারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। দেশের কোটি কোটি মানুষ যখন কর্মহীন, তখন আরও কোটি কোটি শ্রমিক-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। আমরা জানি, একচেটিয়া পুঁজিবাদের নিয়ম অনুযায়ী, প্রান্তিক ও গড় মুনাফা নয়, বহুজাতিক ও একচেটিয়া সংস্থাগুলির প্রয়োজন সর্বোচ্চ মুনাফা। সর্বোচ্চ মুনাফার লোভে একচেটিয়া কারবারিরা সর্বোচ্চ শোষণ চালিয়ে যায়। মুনাফার তৃষ্ণা মেটাতে তারা শ্রমিকদের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও নিংড়ে নেয়। জাতীয় ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রের শাসক বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারগুলির সকলেই একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির অনুগত ভৃত্য এবং সেই কারণে প্রভুদের সেবায় তারা সর্বদাই অত্যন্ত ব্যস্ত। স্থায়ী চাকরি বিলোপ করা হচ্ছে, অত্যন্ত কম মজুরিতে চুক্তি প্রথা চালু করা হয়েছে। আউটসোর্সিং চলছে, শ্রমিকের সংখ্যা কমানোর জন্য ডাউন সাইজিং করছে এমন সময়ে, যখন শুধুমাত্র কোনওক্রমে বেঁচে থাকার জন্য যে কোনওভাবে কিছু অর্থ রোজগারের আশায় হাজার হাজার বেকার যুবক, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার যুবকরা পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়ে অমানুষিক শোষণের শিকার হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ পদ শূন্য পড়ে রয়েছে। বহুজাতিক ও একচেটিয়া কারবারিদের সর্বোচ্চ মুনাফার লালসা পূরণ করতে অসংখ্য কারখানা, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, রাস্তা, রেলপথ, বিমানবন্দরের মতো সংস্থাগুলিকে সস্তায় তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
জানলে অবাক হবেন যে, ভারতের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষের হাতে যে সম্পদ রয়েছে তার পরিমাণ দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ৭০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের সমান। এরই পরিণামে ৮৩ কোটি ভারতীয় দৈনিক ২০ টাকার কম খরচে জীবনধারণ করতে বাধ্য হয়। করোনা অতিমারির সময়ে শতকোটিপতিরা আরও বহু শত কোটি টাকা সম্পদের মালিক হয়েছে। অন্যদিকে গরিব মানুষ হয়েছে আরও গরিব। এই সময়ে এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যাও ৯.৯ কোটি থেকে কমে ৬.৬ কোটি হয়েছে। অর্থাৎ ৩.৩ কোটি মধ্যবিত্ত মানুষ সর্বহারা কিংবা আধা-সর্বহারার দলে যোগ দিয়েছে।
গভীর ব্যথার সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ অনাহারে এবং চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে মারা যাচ্ছে। আরও হাজার হাজার মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। শত শত শিশু ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁজে খাচ্ছে। পথেই তাদের জন্ম, পথেই তাদের মৃত্যু। অনেকে এ-ও জানে না, কে তাদের বাবা-মা। রাতের অন্ধকারে আরও এক বেদনাদায়ক অন্ধকারের ছবি দেখা যায়। ক্ষুধাতুর সন্তান ও শয্যাশায়ী পরিজনদের মুখে যে ভাবে হোক দু-মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার তাড়নায় গৃহবধূ ও ঘরের মেয়েরা শরীর বিক্রি করতে বাধ্য হন। নারী-পাচার এখন এক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এই ভারতের জন্যই কি আমাদের শ্রদ্ধেয় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা শহিদের মৃত্যু বরণ করেছিলেন?
পুঁজিপতিদের অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে জনগণকে শোষণ করার, পুরোপুরি ক্রীতদাসে পরিণত করার এবং শোষণযন্ত্রে পিষে ফেলার। সংসদীয় নির্বাচন হল স্রেফ একটি প্রতারণা, যেখানে পুঁজিপতিরা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেবাদাসদের সরকারি ক্ষমতায় বসায় অথবা পরিবর্তন করে। বহুদিন আগেই ‘গণতন্ত্র’-এর আলখাল্লার আড়ালে সংসদীয় গণতন্ত্র ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তি মতবিরোধ ও প্রতিবাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করছে, বিক্ষোভ ও আন্দোলনগুলিকে নির্মমভাবে দমন করছে। বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রতারক। মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে জনগণকে তারা ঠকায়। জনগণের সম্পদ লুঠ করে, ঘুষ নিয়ে এবং বুর্জোয়া প্রভুদের থেকে গোপনে বেতন নিয়ে তারা নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করে। সকলেই জানেন কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের ক্রিমিনালসুলভ অবহেলায় কোভিড অতিমারিতে কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হল। শত শত মৃতদেহ এমনকি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, দাহ না করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। এই সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাজেট ক্রমাগত ছাঁটাই করে চলেছে, বাড়িয়ে চলেছে সামরিক বাজেট। এই কি সেই স্বাধীনতা যার আকাঙক্ষা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশবাসীর ছিল?
সকলেই জানেন যে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সামনে শিক্ষার দরজা বন্ধ করে দিয়ে পুঁজিপতিদের মুনাফা লুটতে দেওয়ার উদ্দেশ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকিকরণ করা হচ্ছে। উপরন্তু, সিলেবাসে ইতিহাসের পরিবর্তে পৌরাণিক কাহিনী স্থান পাচ্ছে, বিজ্ঞানের পরিবর্তে পড়ানো হচ্ছে অধিবিদ্যা ও স্যুডো-সায়েন্স (ছদ্ম বিজ্ঞান) যাতে বিজ্ঞানভিত্তিক মানসিকতা ধ্বংস হয়ে যায়, যুক্তিবোধ নষ্ট হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির প্রসারের জন্য ধর্মীয় গোঁড়ামি, রহস্যবাদ, মধ্যযুগীয় মানসিকতাকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত, প্রাদেশিকতাকে উস্কানি দিচ্ছে শাসকরা যাতে জীবনের মূল সমস্যাগুলি থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ভাঙতে এবং দাঙ্গা বাধানোর ষড়যন্তে্র ব্যবহার করা যায়। নবজাগরণের অগ্রদূতরা কি আগামী ভারতের এই স্বপ্নই দেখেছিলেন?
নবজাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান অগ্রদূতদের জীবন ও সংগ্রাম বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দেওয়ার দূরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রও চলছে যাতে অনৈতিকতা, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ভোগবাদ, নোংরা যৌনতার প্রসার ঘটিয়ে, মদ-ড্রাগ-আফিংয়ের নেশায় ডুবিয়ে দিয়ে তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা দূষিত করে তুলে তাদের অমানুষ বানানো যায়। পরিণামে গোটা সমাজ আজ প্রায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন হয়ে নোংরা পচা-গলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্নেহ-মমতা-ভালবাসার মতো কোমল অনুভূতিগুলি মরে যাচ্ছে, পরিবারগুলোতে শান্তি নেই, ছেলেমেয়েরা বৃদ্ধ অসহায় মা-বাবাদের রাস্তায় বের করে দিচ্ছে, না হয় বড় জোর মৃত্যুর দিন গুনতে তাঁদের বৃদ্ধাবাসে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আরও একটি ভয়ঙ্কর চিত্র আছে। প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে শত শত মহিলা ধর্ষিতা, গণধর্ষিতা এমনকি খুন হয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে নাবালিকা, এমনকি নব্বই বছরের বৃদ্ধা কিংবা তিন বছরের শিশুকন্যা পর্যন্ত। পশুজগতেও এমন পাশবিকতা দেখা যায় না। ধর্ষণকারী হয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। মানবজাতির নিকৃষ্টতম শত্রু ভয়ঙ্কর পুঁজিবাদের সৃষ্টি হল এইসব ধর্ষণকারীরা। এই অমানুষিক পরিস্থিতি কি চলতে দেওয়া যায়? জীবনের এই সমস্ত অসহনীয় সমস্যার সমাধান কোথায়?
শোষিত মানুষকে রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে তুলে, তাদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে পুঁজিবাদ ও তার সেবক রাষ্ট্র ও সরকারগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামে তাদের যুক্ত করার পথেই রয়েছে এর সমাধান। বর্তমানে শোষিত মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কোনও রাজনৈতিক দল বা প্রখ্যাত নেতার নেতৃত্ব ছাড়াই নানা গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো উত্থিত হচ্ছে– যা অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক। যে কৃষকসমাজকে এতদিন অসচেতন, পিছিয়ে-পড়া, উদ্যোগহীন, নিষ্ক্রিয় বলে ভাবা হত, এক বছর ধরে নানা আক্রমণ, প্রবল শীত, প্রখর রোদ, বিপুল বর্ষা, ঘন কুয়াশা অগ্রাহ্য করে সাতশোটি জীবনের বিনিময়ে সেই কৃষকদের সাম্প্রতিক শক্তিশালী আন্দোলন ও তার মহিমান্বিত বিজয় প্রমাণ করে দিয়েছে দীর্ঘস্থায়ী দৃঢ় আন্দোলন কী বিস্ময়কর ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে। এই আন্দোলন একটি আত্মম্ভরী একগুঁয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারকে নত হয়ে কৃষকদের প্রধান দাবিগুলি মেনে নিতে বাধ্য করেছে।
সর্বত্রই জনগণের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তারা প্রতিবাদ করতে চাইছে, তারা আন্দোলন করতে চাইছে, তারা পরিবর্তন চাইছে। চারিপাশে বিক্ষোভের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ রয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে, যে কোনও জায়গায় এ থেকে সৃষ্টি হতে পারে প্রবল অগ্নিকাণ্ড।
আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কখনও কিছু আশু দাবিদাওয়া আংশিকভাবে অথবা পূর্ণ রূপে আদায় করা যেতে পারে। কিন্তু মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার বৈপ্লবিক হাতিয়ারে সজ্জিত শ্রমিক শ্রেণির পার্টির নেতৃত্বে সর্বহারা বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত জীবনের সমস্ত সমস্যার মূল কারণটির অস্তিত্ব বজায় থেকে যাবে এবং তা আরও তীব্র সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকবে। সেই কারণে, সর্বহারা শ্রেণির একটি দল যখন কোনও আন্দোলন সংগঠিত করে বা তাতে যোগ দেয়, শুধু কয়েকটি আশু দাবি আদায় করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে না। তার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে বিপ্লবী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো, সংঘবদ্ধভাবে লড়তে শেখানো, এবং যে মুহূর্তে আন্দোলনকারীদের চেতনায় প্রাথমিক সচেতনতার অস্পষ্ট আভাস দেখতে পাওয়া যায়, তখনই সেই আন্দোলনকে রাজনৈতিক শিক্ষার স্কুলে পরিণত করা–এই পথে বিপ্লবের জমি প্রস্তুত করা। মনে রাখতে হবে যে, শোষিত নিপীড়িত মানুষ নিজে নিজেই আন্দোলনের মধ্যে থেকে বিপ্লবী রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে না, বিপ্লবীদেরই তা জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হয়।
মানব সমাজের সবচেয়ে বড় শত্রু পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে বিপ্লবের আঘাতে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে শোষিত জনগণকে শিক্ষিত, রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ও সংগঠিত করার ঐতিহাসিক দায়িত্বটি কে বহন করতে পারে? এ দায়িত্ব বহন করতে পারে কেবলমাত্র যুবকরাই– সেই প্রকৃত যুবকরাই যারা সাহসী, নিঃস্বার্থ, উচ্চ নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন এবং মা’র্বাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার বৈপ্লবিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অদম্য ও শঙ্কাহীন চেতনার অধিকারী।
এখানে সমবেত হয়েছেন যে যুবকরা, বর্তমান সময়ের জন্য অতি-জরুরি এই প্রয়োজনে তাঁরা কি সাড়া দেবেন? এই সম্মেলনের সাফল্য নিহিত আছে এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে।
কমরেডরা, আপনারা মাথা উঁচু করে দাঁড়ান। পেটি-বুর্জোয়া মানসিকতা ও জীবনযাত্রা ত্যাগ করুন। বিচ্ছিন্নতার প্রাচীর সৃষ্টি করে নিপীড়িত জনগণ থেকে নিজেদের দূরে রাখবেন না।। তাদের সাথে মিশুন – তাদের চেতনার মান উন্নত করার জন্য, নিজেদের নিচু স্তরে নামিয়ে আনার জন্য নয়। এগিয়ে আসুন বলিষ্ঠভাবে, সাহসের সাথে, পূর্ণ তেজ নিয়ে। সমৃদ্ধ করুন নিজেদের জ্ঞানভান্ডার। নিজস্ব উদ্যোগ বাড়ান এবং বিপ্লবের প্রচারক হিসাবে, সংগঠক ও আন্দোলনকারী হিসেবে নিজের“নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন।
ছাত্র-যুবদের প্রতি মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক, সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ যে উদাত্ত আহ্বান রেখে গেছেন, আমি তা পুনরায় আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই। তিনি বলেছেন, ‘‘সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তরে, সমস্ত দেশে, বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছাত্র-যুবরাই নিজেদের সম্পূর্ণ রূপে উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসে। মানুষের কাছে যান, তাদের উদ্বুদ্ধ করুন, হাজারে হাজারে তাদের সংগঠিত করুন এবং নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টিতে তাদের সাহায্য করুন। তাহলেই সময় আসবে যখন জনগণ সক্রিয় হয়ে উঠবে– যাকে আমরা বলি বিপ্লব।”
এই ঐতিহাসিক আহ্বানে সাড়া দেওয়ার উপরেই নির্ভর করছে ডিওয়াইও-র এই সর্বভারতীয় সম্মেলনের প্রকৃত সাফল্য। আমি আশা করি, নিশ্চিত ভাবেই আপনারা এতে সাড়া দেবেন।
আপনাদের সকলকে আমার লাল সেলাম।