বিক্ষোভ দমাতে নৃশংস বর্বরতা, নিজের জাত চেনাল বিজেপি
উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্পষ্ট করে দিলেন, তাঁর সরকার এবং দল আসলে ফ্যাসিস্ট মানসিকতার ক্ষমতাদর্পী বর্বর একটা দল যারা গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা তোয়াক্কাও করে না৷ পরপর দু’টি টুইটে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে যোগী মন্তব্য করেছেন, ‘এনআরসি–সিএএ বিরোধী বিক্ষোভকারীদের (যোগীর ভাষায় ‘দাঙ্গাকারীদের’) বিরুদ্ধে সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে, গোটা দেশের সামনে তা উদাহরণ হয়ে থাকবে৷’ বলেছেন, ‘সমস্ত বিক্ষোভকারীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ যোগী আদিত্যনাথের সরকার এমন কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে যে প্রত্যেককে চুপ করিয়ে দেওয়া গেছে৷’
এই টুইট যোগী করেছেন এমন একটা সময়ে যখন উত্তরপ্রদেশে পুলিশ–প্রশাসনের নৃশংস বর্বরতার, থানায় উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক অত্যাচারের একটার পর একটা খবরে নিন্দার ঝড় বইছে দেশে৷ মুজফফরনগরের সাদাত মাদ্রাসার শিক্ষক ও অনাথাশ্রমের ভারপ্রাপ্ত এলাকার অত্যন্ত সম্মানীয় ৬৬ বছরের প্রবীণ ব্যক্তিত্ত্ব মৌলানা আসাদ রাজা হুসেইনিকে পুলিশের হাতে নির্মম ভাবে মার খেতে হয়েছে, অসহ্য অবমাননার কথা ভুলতে না পেরে ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন তিনি৷ আর তাঁর পড়শিদের কাটাতে হচ্ছে আতঙ্কের দিনরাত– কখন পুলিশ এসে ঘরবাড়ি তছনছ করে দেয়, ধরে নিয়ে চলে যায় পুরুষ আর বাচ্চাদের৷ জেলায় পুলিশের বড়কর্তাদের কাছে গিয়েছিলেন কি না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্ণে আতঙ্ক আর বিস্ময় মেশা জবাব তাঁদের– ‘যখন পুলিশ আর সরকার নিজেরাই উৎপীড়ক হয়ে যায়, তখন কার কাছে সাহায্যের জন্য যাব আমরা’
উত্তরপ্রদেশে পুলিশি রাজের নিন্দাএনআরসি এবং সিএএ বিরোধী আন্দোলনে বিজেপিশাসিত রাজ্য সরকারগুলি, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার যে বর্বর দমন–পীড়ন নামিয়ে এনেছে তার তীব্র বিরোধিতা করে এস ইউ সি আই (সি) সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ২৯ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেছেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের আনা এনআরসি এবং সিএএ–এর অশুভ উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের প্রায় সব রাজ্যের জনগণ যখন প্রতিবাদে সোচ্চার, ঠিক সেই সময়ে বিজেপিশাসিত রাজ্য সরকারগুলি আন্দোলনের উপর দানবীয় বর্বর অত্যাচার নামিয়ে এনেছে, যার ফলে শুধু উত্তরপ্রদেশেই ১৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন৷ উত্তরপ্রদেশ সরকার পুলিশের এই গুলিচালনার কথা অস্বীকার করে দাবি করেছে আন্দোলনকারীরাই নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্রে নিহত হয়েছে৷ কিন্তু তাদের এই মিথ্যাচার প্রকাশিত হয়ে পড়তেই তারা তৎক্ষণাৎ ডিগবাজি খেয়ে বলে একমাত্র একটি ক্ষেত্রেই পুলিশ গুলি চালিয়েছে, তা–ও আত্মরক্ষার্থে৷ ফলে একজন নিহত হয়েছে৷ সরকার আন্দোলনকারীদের উপরে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগে লাখ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন সরকার আন্দোলনকারীদের এমন শাস্তি দেবে যেটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, যা দেখে ভারতের কোনও রাজ্যে কেউ আন্দোলন করার সাহস পাবে না৷ এক মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল বলে, সেখানকার একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে জেলের ভিতরে নগ্নে করে অপমানিত করা হয়৷ এইভাবে উত্তরপ্রদেশে এক নগ্ন সন্ত্রাসের পরিস্থিতি কায়েম করা হয়েছে৷ আমরা উত্তরপ্রদেশ সরকারের পুলিশের এই রক্তপিপাসু মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানাই৷ আমরা এ কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, অন্যায়–ত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণের কণ্ঠরোধ করতে ইতিহাসে অত্যাচারী শাসকরা কোনওদিনই সফল হয়নি৷ |
এক প্রত্যক্ষদর্শী মহম্মদ সাত্তার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ২০ ডিসেম্বর দুপুরে নমাজের পরে মুজফফরনগরের মীনাক্ষি চকে সিএএ–র বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ চলছিল৷ হঠাৎ বিকেল চারটে নাগাদ, আন্দোলনকারীরা যখন চলে যেতে শুরু করেছেন, হঠাৎ ইটবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷ কেউ জানে না, কারা এটা শুরু করল৷ এরপরই পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে৷ সাত্তার বলেছেন, পুলিশের গাড়িতে কে বা কারা আগুন লাগাল, তাও আমরা জানি না৷ তার পরেই পুলিশ মুসলিম মহল্লাগুলিতে বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর শুরু করে৷ কয়েকজন বিক্ষোভকারী কাছের সাদাত মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ একদল পুলিশ সেখানে হানা দিয়ে ছাত্রদের নির্দয়ভাবে মারতে মারতে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়৷ শিক্ষক মৌলানা আসাদকে বাইরে টেনে বের করে থানায় নিয়ে যায় এবং সেখানে তাঁকে নগ্ণ করে বর্বর অত্যাচার চালায় (সূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ, ২৯ ডিসেম্বর, ’১৯)৷
কার কাছে বিচার চাইবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না ৮৬ বছরের বৃদ্ধ হাবিব হাসানও৷ রুটি কারখানা থেকে কাজ সেরে ফেরার পথে তাঁর ২৪ বছরের ছেলে আলিম আনসারিকে বুকে গুলি করে মেরেছে যোগী সরকারের পুলিশ, উত্তরপ্রদেশের মিরাটে৷ আতঙ্ক আর বিস্ময় হাবিবের চোখে৷ একটি তদন্তকারী টিমের সদস্যদের তিনি বলেছেন, আমার ছেলেমেয়েরা তো হিন্দু পড়শিদের কোলেপিঠেই বড় হল, কই কোনওদিন তো কারওর চোখে ঘৃণা দেখিনি আর এখন হিন্দুরাও নয়, খোদ সরকারই এমন সর্বনাশ করল আমার
বাস্তবিকই আসাম থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ কিংবা কর্ণাটকের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে এনআরসি–সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ দমানোর নামে পুলিশের যে বর্বর চেহারা দেশবাসী চাক্ষুষ করলেন, তাতে তাদের আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর নয়, গুণ্ডাবাজের চরিত্রই প্রকট হয়ে উঠল৷ শীর্ষ স্তরের রাজনৈতিক নির্দেশেই যে এসব ঘটেছে তা বোঝার ক্ষেত্রে এতটুকু অস্পষ্টতা রাখার সুযোগই দেননি উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ৷ গণতন্ত্রের গালে থাপ্পড় মেরে তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেছেন, যারা সিএএ–র বিরোধিতা করছে, তিনি তাদের উপর ‘বদলা’ নেবেন৷
মুখ্যমন্ত্রীর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ–প্রশাসন৷ শুধু এই একটি রাজ্যেই মারা গেছেন ১৯ জন প্রতিবাদী (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭ ডিসেম্বর, ’১৯)৷ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে বেধড়ক লাঠি চালিয়েছে পুলিশ৷ হামলা থেকে বাঁচতে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে গুলি করেছে মাথা, বুক লক্ষ্য করে৷ রাজ্য জুড়ে এলাকায় এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঢুকে ভাঙচুর লুটপাট চালিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে৷ চলেছে ব্যাপক ধরপাকড়৷ বিজনৌরে নাবালকদের থানায় আটকে রেখে ব্যাপক অত্যাচার করেছে পুলিশ৷ মারের চোটে হাত ভেঙে গেছে এক নাবালকের৷ লক্ষ্ণৌয়ে দরগায় আশ্রয় নেওয়া মানুষের উপর পুলিশ নির্মম হামলা চালিয়েছে৷ খুন করেও ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ– মিরাটে কেস দিয়েছে মৃতদের নামেই৷ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে মোমবাতি মিছিল করেছিলেন ১২০০ ছাত্রছাত্রী৷ পুলিশ তাঁদের নামে এফআইআর করেছে৷ বারাণসীতে ‘দাঙ্গাকারী’ তকমা দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছবি–দেওয়া পোস্টার লাগিয়েছে পুলিশ৷
অথচ তথ্যানুসন্ধানী টিমের কাছে এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন, বহু জায়গাতেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের মধ্যে হঠাৎ এসে হাজির হয় মুখে কাপড় বাঁধা কিছু লোক৷ তারা ভাঙচুর চালায়, আগুন লাগায়৷ এসব দেখেও নিশ্চুপ থাকে পুলিশ৷ এমনকি আন্দোলনকারীরা অনুরোধ করলেও পুলিশ মুখ–ঢাকাদের হঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি৷ কানপুরে আবার খোদ পুলিশের বিরুদ্ধেই ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠেছে৷ একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সেখানকার বেগমগঞ্জ অঞ্চলে বিক্ষোভ থেমে যাওয়ার পরেও প্রায় ১০০ জন পুলিশকর্মীর একটি বাহিনী দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করছে, বন্ধ দোকানের দরজা ভাঙছে৷ এদিকে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর বদলা নেওয়ার অভিপ্রায়কে বাস্তবায়িত করতে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন একের পর এক দোকানে তালা ঝুলিয়েছে, নোটিস ধরিয়েছে ক্ষতিপূরণের৷ পশ্চিমবঙ্গেও ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ৫ জন গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেখা গেছে, তারা ছদ্মবেশী আরএসএস–বিজেপি কর্মী৷
কর্ণাটকে বিজেপি সরকারের পুলিশ–প্রশাসনও একই আচরণ করেছে৷ সেখানে পুলিশের গুলিতে দু’জন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে শুধু তাই নয়, ম্যাঙ্গালুরুতে হাসপাতালে ঢুকে বর্বরের মতো হাঙ্গামা চালিয়েছে পুলিশ৷ হাসপাতালে উপস্থিত রোগীদের পরিজন কিংবা চিকিৎসাকর্মীরা তো বটেই, আইসিসিইউ–র রোগীদেরও রেহাই মেলেনি সেই তাণ্ডব থেকে৷ দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশ শুধু বিক্ষোভকারী সাধারণ নাগরিক ও ছাত্রছাত্রীদের উপর নির্মম হামলা চালিয়েছে তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, এমনকি লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ে বর্বর লাঠিচার্জ করেছে নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর৷
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০১৪ সালে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা কতখানি তা প্রমাণ করতে সংসদ ভবনের চৌকাঠে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলেছিলেন, এ হল গণতন্ত্রের মন্দির৷ সেদিন যে তিনি আদ্যোপান্ত একটি নাটক সাজিয়ে ছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রীত্বে সংশয়াতীত ভাবে তা প্রমাণ হয়ে গেল৷ রাজ্যে রাজ্যে নিরীহ নিরস্ত্র নাগরিক ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর বিজেপি সরকারগুলির প্রতিশোধমূলক হিংস্রতা এই দলটির ফ্যাসিস্ট চরিত্রটিকে চিনিয়ে দিল৷ দেখিয়ে দিল, এ দলের নেতা–মন্ত্রীরা আসলে ‘সভ্যতার ত্রাস’ হিটলারেরই উত্তরসূরি৷ এঁরা কথা বলেন ক্ষমতার ভাষায়৷ সে ভাষায় ‘প্রতিবাদ’ বা ‘প্রশ্ন’ শব্দগুলির অস্তিত্বই নেই৷ প্রতিবাদকারী বা সমালোচকরা তাঁদের চোখে শত্রু৷ আর শত্রুর বিরুদ্ধে ‘বদলা’–ই তাঁদের অস্ত্র৷ তাঁদের মদতে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি সরকারের পেটোয়া পুলিশ চরম স্পর্ধায় বিক্ষোভকারীদের গন্তব্য নির্দেশ করেছে– ‘হয় পাকিস্তান, নয় কবরিস্তান’৷ যে দেশে প্রধানমন্ত্রী দাঙ্গাকারীদের পোশাক দেখে চিনে নেওয়ার কথা বলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পুলিশ–প্রশাসনকে লেলিয়ে দেওয়ার ইশারা করেন, সে দেশে পুলিশের তো এমন আচরণই স্বাভাবিক
আসলে প্রবল আর্থিক সংকট, নারী নির্যাতন, বেকার সমস্যায় জর্জরিত এ দেশের মানুষকে দেওয়ার কিছু নেই বিজেপি সরকারের৷ তাই এসবের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা মানুষের ক্ষোভকে ভয় পাচ্ছে তারা৷ একদিকে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে, এনআরসি–সিএএ–র মতো বিভেদমূলক কানুন বানিয়ে, অন্যদিকে লাঠি–গুলির জোরে নারকীয় পরিবেশ তৈরি করে তারা দমিয়ে দিতে চায় মানুষের ক্রোধ, ক্ষোভ, আন্দোলনকে৷ জীবনযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষ যাতে আগামী দিনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পথে পা বাড়াতে ভয় পায়, সেই মতলবেই এবার সরকারি নিপীড়নের মহড়া এভাবে দিয়ে রাখল বিজেপি৷ কিন্তু ইতিহাস বার বার দেখিয়েছে, অত্যাচারীরা শেষ কথা বলে না৷ ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত আন্দোলনের পাল্টা দাপটে গণতন্ত্রের ভেকধারী এইসব ভণ্ড নেতা ও তাদের ক্ষমতাদম্ভী অপরাজনীতিকে নিশ্চিতভাবেই পরাস্ত করবে দেশের মানুষ৷