৫ আগস্ট, সর্বহারার মহান নেতা, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী দেশব্যাপী যথাযোগ্য শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় পালন করার আহ্বান জানিয়েছে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি। তাঁর জীবনসংগ্রাম ও শিক্ষাগুলি উপলব্ধি করে নিজ নিজ বিপ্লবী চরিত্র গড়ে তোলার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করার দ্বারাই মহান নেতার প্রতি আমরা যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারি। এই লক্ষ্য থেকেই বিপ্লবী কর্মীদের আচার-আচরণ সংক্রান্ত তাঁর মূল্যবান কিছু শিক্ষা ‘শ্রমিক আন্দোলন প্রসঙ্গে’ পুস্তিকা থেকে আমরা এখানে তুলে ধরলাম। – সম্পাদক, গণদাবী
‘‘শুধু স্লোগান দিয়ে কোনও দেশে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লবের জন্য মানুষের একটা সুস্থ এবং সুষ্ঠু নৈতিক ভিত্তির প্রয়োজন আছে। মানুষগুলো যদি স্লোগানসর্বস্ব হয়, যদি দলবদ্ধ থাকলে সাহসী, দলবদ্ধ না থাকলে কুঁকড়ে যায়, কুকুর বেড়ালের মত লাঠি দেখলেই পালায়, আবার নিজের হাতে লাঠি থাকলে মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না – তাদের ওপর হামলা করে, তা হলে এই মানুষগুলোর দ্বারা বিপ্লব হয় নাকি? এই যে রক্তলোলুপ প্রবণতা, এতো বিপ্লবের বিরুদ্ধ শক্তি। এর দ্বারা সমাজ পরিবেশের মধ্যে ফ্যাসিস্ট মানসিকতা তৈরি হয়। মজুর আন্দোলনে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নামে আজ এই সমস্ত বিভ্রান্তিকর আচরণ চলছে। শুধু বাইরের লোকের বিরুদ্ধে নয়, দলের অভ্যন্তরে দলের বাইরে যা কিছু কুৎসিত, যা মানুষকে বড় করতে, মহৎ করতে সাহায্য করে না, সেগুলির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম হওয়া উচিত এবং এই সংগ্রাম শুধু বাইরের লোকের বিরুদ্ধেই নয়, আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও।
নেতা হওয়ার প্রয়োজনটা কোথায়? নেতা একটি প্রয়োজনীয় উপাদান যে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই আপনাদের আন্দোলনে আপনারা যত বেশি সংখ্যক নেতা তৈরি করতে পারবেন, আপনাদের কাজের অগ্রগতি তত দ্রুত হবে।
কিন্তু, দেখা গেল নেতৃত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই নেতা কতকগুলি মারাত্মক দোষের শিকার বনে গেল। নানা রকম ব্যক্তিবাদের শিকার, লোকপ্রিয় আচরণের শিকার বনে গেল। এই কথাগুলির মানে আপনাদের বুঝতে হবে। লোকপ্রিয়তা মানে এমন সব আচরণ যা করলে সহজে নাম করা যায়– অর্থাৎ ঢং, চলাফেরা, ওঠা-বসা, কথা বলা, ঢিলেঢালা কায়দা প্রভৃতি সবকিছুর মধ্য দিয়ে সে সাধারণ লোকের কাছ থেকে সহজে প্রশংসা আদায় করে। এগুলোর দ্বারা সে কী করে? সে যেমন তার নিজের ক্ষতি করে, তেমনই আন্দোলনের মধ্যে নেতার যে কাজটি করা দরকার ঠিক তাঁর বিরুদ্ধ জিনিসটি করে। অর্থাৎ, লোকে যদি তাঁর সংস্পর্শে আকৃষ্ট হয় তা হলে তা ভুল ভাবে হয়। সাধারণভাবে সমাজ পরিবেশের যে নিম্ন মানসিকতা ও রুচির শিকার বনে যায় জনতা, তার সঙ্গে নেতার আচরণ-চলাফেরার মধ্যে খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও একটা মিল খুঁজে পায় বলে তারা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে, জনতার মধ্যেও ঢিলেঢালা ভাব আসে। তাদের নেতাদের তারিফ করাটাও হয় বাজে ধরনের। তার ফলে এইসব নেতার সংস্পর্শে থাকার মধ্য দিয়ে জনতার রাজনৈতিক চেতনার মান ওঠার বদলে আরও নিচের দিকে নামতে থাকে।
ফলে, নেতা আমাদের চাই। কিন্তু, এমন নেতা চাই, যে নেতার মতো আচরণ করে, যার দায়িত্ববোধ আছে, যে যেকোন অবস্থায় নিজেকে সামাল দিতে পারে এবং অপরকে পথ দেখাতে পারে। যে নিজের আচরণের দ্বারা অন্যকে এই শিক্ষা দেয় যে, অসুবিধা হলেও, অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হলেও নেতার দায়িত্ববোধ আছে; একজন সাধারণ লোকের মতো অসুবিধার দোহাই দিয়ে সমস্যা আছে বলে সে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। তাকে বুঝতে হবে, সে একজন সাধারণ মানুষ নয়। সে জানে কীভাবে সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হয়। সেজন্য নেতা বলতে শুধু নাম বোঝায় না– নেতা মানে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা অর্জন করার সংগ্রাম প্রতিনিয়ত চালিয়ে যেতে হয়, নেতা মাত্রকেই তা জীবনভোর করতে হয়। এমনি এমনি যে তা অর্জিত হয় না, সেটা অনেকে ধরতেই পারে না।
বর্তমান সমাজে বুর্জোয়া-প্রলেটারিয়েটের যে শ্রেণিসংগ্রাম চলছে সেই শ্রেণিসংগ্রাম বা শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রভাব আমাদের চিন্তাভাবনা-মানসিকতার ক্ষেত্রে, রুচি-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিয়তই কাজ করে চলেছে। শ্রেণিসংগ্রাম কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, আন্দোলনের ময়দানে মজুর এবং মালিকের যে লড়াই চলছে শুধুমাত্র সেইখানেই নয়– ভাবগত ক্ষেত্রেও মজুর-মালিকের লড়াইটা হাজির হয়েছে এবং আপনারা চান বা না চান তা আপনাদের মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছে। সেই মনের একটা অংশ মালিকের, একটা মজুরের। নিয়ত মন কখনও আপনাকে মালিকের বুদ্ধি জোগায়, আবার কখনও বা আপনাকে মজুরের বুদ্ধি জোগায়! এইভাবে আমাদের সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম বাস্তবত অবস্থান করে। প্রচলিত বুর্জোয়া সমাজপরিবেশের ভাবনাধারণাগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই আপনাদের মধ্যে এসে বর্তায়। কোনও নেতা বা কর্মীই নিজেকে এই সামাজিক পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে পারে না। পারে না বলেই প্রতিনিয়ত যত বড় উঁচুদরের নেতাই হোন না কেন তাঁকে সচেতন থাকতে হয়। নিজেকে রক্ষা করতে হলে তাঁকে সবসময় বুঝতে হয় যে, তাঁর মধ্যে যে মানসিকতা, চালচলন, স্টাইল ইত্যাদি প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে সেগুলো বিপ্লবী জনসাধারণের বিপ্লবী উদ্দেশ্য এবং বিপ্লবী আকাঙক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, কিংবা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এই সাবধানতা সত্ত্বেও আপনাদের মধ্যে অবিপ্লবী বুর্জোয়া চিন্তাভাবনা আসতে পারে এবং এলেই যে একেবারে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল তাও নয়। কিন্তু, আসল কথা হচ্ছে, আপনারা ঠিক সময়ে তা ধরতে পারলেন কি না এবং সময়মত তা শোধরাতে সক্ষম হলেন কি না। এটাই আসল কথা। আপনাদের নিজেদের মধ্যেকার অবিপ্লবী চিন্তাভাবনাকে যদি আপনারা নিজেরা ধরতে পারেন তবে সেইটাই সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি। ধরতে পেরে হয়তো নিজেকেই নিজে ছি ছি করলেন এবং তার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাও করলেন। কারণ, বাইরের লোকলজ্জা একজন বিপ্লবীর কাছে বড় হয়ে দেখা দেয় না। নিজের ভেতর থেকে লজ্জাটাই আসল কথা। এটাই একজন বিপ্লবীর প্রধান শিক্ষা হওয়া উচিত। তা না হলে বাইরের লোক বড় করলে আমরা বড় হব, বাইরের লোক লজ্জা দিলে আমরা মাটির সঙ্গে মিশে যাব। এ হলে একজন বিপ্লবী এক পা-ও চলতে পারবেন না। কারণ, বিরুদ্ধ পরিবেশে একজন বড় বিপ্লবীর গায়েও সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়ে, অপরের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে থুথু ছেটাতে পারে। তার জন্য বিপ্লবী ছোট হয়ে যায় কি? এমনকী মানুষ তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে, রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, মেরে ফেলতে পারে সেই মানুষগুলো যাদের জন্য সে সর্বস্ব দিতে বদ্ধপরিকর। তার দ্বারা বিপ্লবীর বেইজ্জতি এবং অসম্ভ্রম হয় কি? না। পুলিশ যদি একজন সত্যিকারের বিপ্লবীর মত বড় মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে থানা লক-আপে পেটায় তাতে যেমন তাঁর বেইজ্জত হয় না, আবার পুলিশ যদি তাঁকে ‘স্যার’ও বলে তাহলেও তাঁর সম্মান বেড়ে যায় না। যেসব বিপ্লবীরা এগুলোকেই মান-অপমানের ক্ষেত্রে বড় কথা বলে মনে করেন, তাঁদের ধারণা ভ্রান্ত। তাঁরা হয়ত জানেন না যে, এরই মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদ এবং বুর্জোয়া সমাজের ‘অহম’ যা নানা মূর্তি ধরে ভোল পাল্টে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। আমরা তো প্রফেসর হতে চাইনি, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি, পয়সা কামাতে চাইনি, নাম করতে চাইনি– আমরা বিপ্লবী হতেই চেয়েছি। কিন্তু, বিপ্লবী হতে চেয়েও ‘স্যার’ শুনলে একটু গর্ব হয়, আর পুলিশ লক-আপে পেটালেই বেইজ্জত হয়– বিপ্লবীর ইজ্জত, বেইজ্জতের ধারণা এরকম নয়। তাঁর ইজ্জত, বেইজ্জত তাঁর নিজের মধ্যে। তা না হলে তো মানুষ ওপরে তুললেই তাঁরা উপরে উঠবেন এবং মইটা কেড়ে নিলেই ধুপ করে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে ফেলবেন। এই করে কোনও বিপ্লবীর চলতে পারে না। এইসব চেতনা এবং উপলব্ধিগুলো কর্মীদের মধ্যে এনে দিতে হবে। এনে দিলেই তারা সমস্ত প্রতিকূলতা এবং বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার প্রেরণা পাবে।
তাই বিপ্লবী হিসাবে, একজন কমিউনিস্ট হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রাম একটি কঠিন এবং জটিল সংগ্রাম। যেমন, সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হলে জনগণকে, শ্রমিকশ্রেণিকে অর্থনীতিবাদ থেকে মুক্ত করতে হবে এবং রাজনৈতিক দিক থেকে জনতাকে সচেতন করে জনতার রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিগুলি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদকে বিপ্লবের আঘাতে ভাঙতে হবে– এত কথা একজন বিপ্লবী কর্মী জানার পরেও দেখা গেল যে, যখন তাঁর নিজের চাকরি চলে গেল তখন উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করেছেন। বিপ্লব, পার্টি, ইউনিয়ন তখন তাঁর সব গোলমাল হয়ে গেল। অর্থাৎ, যতক্ষণ নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তাঁর একটা চাকরি ছিল ততক্ষণ তাঁর সঙ্গে বিপ্লবটাও ছিল। এ কথাটা তিনি একবারও ভাবেননি যে, পার্টি ও বিপ্লবের প্রয়োজনে কখনও তাঁর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নও তো আসতে পারে। শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তাঁর চাকরি যদি যায়ও তা হলেও তিনি শ্রমিক ইউনিয়নই করবেন এবং শ্রমিকরা তাঁকে যে ভাবে রাখবে তিনি সেইভাবেই থাকবেন। এত কথা কর্মীটি এর আগে ভাবেননি। অনেকে অনেক কথা জানেন কিন্তু ভাবেন না যে, কোনও একজন কর্মী যদি ইঞ্জিনিয়ারও হন তা হলেও শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য, মেলামেশার সুবিধার জন্য দরকার হলে তিনি একটা কুলির কাজ বা বদলি শ্রমিকের কাজ নিয়েও কারখানায় ঢুকবেন।
অথচ, আমাদের এখানে কী দেখা যায়? শ্রমিক সংগঠনের প্রয়োজনে কোনও ইঞ্জিনিয়ার কর্মীকে একটি চাকরি করতে হবে বললে তিনি হয়তো তার পেশার উপযুক্ত কোনও কাজ পাবার চেষ্টা করেন। আর না পেলে বারবার এসে বলেন, ‘কী করব, কাজ পাওয়া যাচ্ছে না।’ অর্থাৎ, কায়িক শ্রমের কাজ না করার যে মানসিক গঠন তাঁর রয়েছে তিনি তার শিকার। তাঁর অবস্থা হচ্ছে একটা লেখাপড়া জানা লোক হয়ে কী করে তিনি কায়িক শ্রমের কাজ করেন? তাঁর পেশার সঙ্গে খাপ খায় এরকম একটা কাজের বন্দোবস্ত যদি করে দেওয়া যায়, তা হলে সেটা তিনি করবেন। অর্থাৎ, কাজটা করে তিনি বিপ্লবই করবেন, কিন্তু সে কাজটাও তার একটু মনোমতো হওয়া দরকার। কাজটা মনোমতো যদি না হয়, তা হলে বিপ্লবের জন্য যা করা দরকার তা তিনি করতে পারেন না। এই যে মানসিকতা, যুক্তি এবং দেখবার ভঙ্গি– এসব যুক্তিধারা এবং ধারণাগুলি আসছে কোত্থেকে? বিপ্লবের এত কথা জানলেও এই চিন্তাগুলো তাঁর মধ্যে বিপ্লবী চিন্তার পাশাপাশি এই কারণে চলছে যে, এই বুর্জোয়া সমাজে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত সেকেলে ভাবনাধারণাগুলি জীবনযাত্রার মধ্যে বাসা বেঁধে আছে তার প্রতিও তাঁর আগ্রহ কম নয়। এইভাবেই শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রভাব ভাবগত ক্ষেত্রেও প্রতিটি ব্যক্তির জীবনেই বর্তাচ্ছে। ফলে, একটি বিপ্লবী কর্মীকে এ সম্পর্কে সবসময়ই সচেতন থাকতে হয় এবং বিপ্লবী হিসাবে জীবনকে গড়ে তোলার জন্য নিয়ত সচেতন সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়।”