বেড়েই চলেছে শিশু ও নারী নির্যাতন৷ সংবাদপত্রে চোখ রাখলে মনে হয় যেন ঘটনার স্রোত চলছে৷ প্রত্যেকটি ঘটনা আগেরটির থেকে আরও নৃশংস৷ শুধু ভয়াবহ ধর্ষণ–নির্যাতনই নয়, কোথাও ছিন্নভিন্ন উলঙ্গ নারীদেহ, কোথাও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নির্যাতিতাকে খুন করে প্রমাণ লোপাটে মত্ত লম্পটের দল৷ দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়ায়৷
ক’দিন আগেই বানতলার চামড়া পট্টিতে কাজ করে ফিরছিলেন গড়িয়ার এক মহিলা৷ রাত ১১টায় কয়েকজন দুষ্কৃতী তাঁর উপরে নারকীয় অত্যাচার চালায়৷ প্রমাণ লোপাট করতে বিবস্ত্র অবস্থায় ফেলে রেখে তাঁর উপর দিয়ে লরি চালিয়ে দেয়৷ অত্যন্ত দরিদ্র এই মহিলার পরিবারে বৃদ্ধ শ্বশুর ও ক্যান্সার আক্রান্ত শাশুড়ী আর অসহায় চারটি সন্তান৷ একমাত্র রোজগেরে এই মহিলার মৃত্যুতে পরিবারটি অথৈ জলে৷ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে স্থানীয় মহিলারা অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি জানালে পুলিশের শাসানির মুখে পড়তে হয় তাঁদের৷
৪ মে গল্ফ গার্ডেনের রাস্তায় ১৫ বছরের এক স্কুল ছাত্রীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ আগের দিন স্কুলে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়ে যায় সে৷ হাসপাতালের আইসিইউ–এ মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে৷ এত দিন পরেও অভিযুক্তরা অধরা৷ পুলিশের ডিসি বলছেন, ‘মেয়েটির উপর নির্যাতন হয়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না৷’ তার দেহে নাকি আঘাতের চিহ্ণ খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ৷
দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিষ্ণুপুরে পাশের বাড়িতে টিভি দেখতে গিয়ে ধর্ষিতা হয় সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী৷ প্রতিবেশী ‘দাদা’ মেয়েটির হাত–পা–মুখ বেঁধে অত্যাচার করে, প্রকাশ করলে খুনের হুমকি দেয়৷
প্রশ্ন উঠেছে, এই গরিব পরিবারগুলির যদি অর্থবল কিংবা সরকারি হোমরাচোমরাদের সাথে যোগাযোগ থাকত, তাহলে পুলিশের এই ভূমিকা দেখা যেত কি? নারী নির্যাতনকারীদের ধরতে গা নেই যে পুলিশের, মদের দোকানের সামনে লাইন ঠিক করতে তাদেরই তৎপর হতে দেখা যায়, নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নামলে পিটিয়ে তাদের অবরোধ ভাঙতে দেখা যায়৷
গড়িয়া, গল্ফ গার্ডেন, বিষ্ণুপুরের মতো নিত্যদিনের অসংখ্য ঘটনা দেখিয়ে দেয় নারীরা আজ সমাজে কতটা নিরাপত্তাহীন, পুলিশ–প্রশাসন কতটা নিষ্ক্রিয়৷ দোষীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠবে, উঠছেও৷
ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এক শ্রেণির সাংসদ–বিধায়ক–মন্ত্রী-নেতারা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে, সাধারণ মানুষকে অনুগত রাখতে, ভোটে জিততে দুষ্কৃতীদের ভিড় বাড়ান দলে৷ এদের ব্যবহার করে নরমে–গরমে আমজনতাকে দাবিয়ে রাখার কৌশল নেন নেতারা৷ যে দল ক্ষমতায় থাকে, দুষ্কৃতীবাহিনী পুলিশি গ্রেপ্তারি এড়াতে তারই অনুগত থাকে৷ বিনিময়ে নানা নেশা এবং অপকর্ম করার ঢালাও ছাড়পত্র পায় এই দুষ্কৃতীরা৷ ফলে, মদ ও মাদকের নেশা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন মহামারীর আকার ধারণ করেছে৷ একের পর এক নৃশংস ঘটনায় শিউরে উঠে এর প্রতিকার চাইছেন সর্বস্তরের মানুষ৷ প্রতিবাদ হচ্ছেও দেশের সর্বত্র৷ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লেখালেখিও হচ্ছে৷ অনেকেই মনে করেন, শিশু এবং মহিলাদের যদি অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন করা যায়, বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তাদের যৌন সম্বন্ধজনিত পাঠ দেওয়া যায়, তাহলে এই ঘটনার নিবারণ সম্ভব৷ কিন্তু শুধু এই পাঠেই এইসব ঘটনা বন্ধ হবে না৷ এমন ঘটনা ঘটে কেন? মহিলাদের সম্পর্কে বিকৃত ধারণার অধিকারী এক অংশের ‘অমানুষ’ পরিকল্পিতভাবেই এই ঘটনা ঘটান৷ পারিবারিক বা সামাজিক বিবাদেও অন্য পক্ষকে শায়েস্তা করতে নারী নিগ্রহের ‘সহজ পথ’ বেছে নেওয়া হয়৷ মহিলাদের সচেতন থাকা না থাকার উপর তখন এমন ঘটনা ঘটা না ঘটা নির্ভর করে না৷
এই নরপশুরা সমাজেরই ফসল৷ এদের দুষ্কর্মের মোকাবিলায় আইন–কানুনের প্রয়োগ চাই, চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, তেমনই চাই বিকৃতকাম মানুষ সমাজে তৈরি হওয়া বন্ধ করা৷ এই সমাজের ঘরে ঘরে যে ছেলেরা বেড়ে উঠছে, তারা যাতে নৈতিক বোধসম্পন্ন মানুষ হয়, নোংরা সংস্কৃতির শিকার না হয়– তেমন পরিবেশ তৈরি করা জরুরি৷ বাস্তবে স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতা, নীচতার অবিরাম চর্চাই তো সুস্থ সমাজবোধ গড়ে ওঠার পথে বাধা তৈরি করছে৷
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রবল জনমতের চাপে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আমরা নারীদের নিরাপত্তা দেব৷ কিন্তু বিজেপির বহু নেতা নারী ও শিশু ধর্ষণে মূল অভিযুক্ত৷ তাদের কোনও শাস্তি হচ্ছে কি? নাবালিকা ধর্ষণে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অর্ডিন্যান্স এনে কেন্দ্রীয় সরকার দায় সারতে চাইছে৷ দিল্লিতে নির্ভয়ার মতো ‘রেয়ারেস্ট অব রেয়ার ক্রাইম’–এর ঘটনা ঘটল কী করে? কাঠুয়া, উন্নাও, সুরাটের ঘটনা ঘটল কী করে? শুধু আইন করলে, অর্ডিন্যান্স জারি করলেই নারী নির্যাতনের সংখ্যা কমবে না৷
লোভ–লালসা ও অপরাধপ্রবণতা এই সমাজে ক্রমাগত বাড়ছে৷ কোথা থেকে এর জন্ম? ধর্ষণকারী অপরাধী হয়ে কোনও শিশুই জন্মায় না৷ ভবিষ্যতে মানুষ হওয়ার সমস্ত উপাদান ও সম্ভাবনা নিয়েই একটি শিশু দুনিয়ার বুকে আসে৷ সামাজিক আদর্শ, চিন্তাধারা ও নানা প্রবণতার ঘাত–প্রতিঘাতে মানুষের চরিত্রের কাঠামো গড়ে ওঠে৷ আজ শিশু বয়স থেকে কী শেখানো হচ্ছে? শেখানো হচ্ছে, যে কোনও উপায়ে অর্থ উপার্জনটাই জীবনের লক্ষ্য৷ ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি হল জীবনের চালিকাশক্তি, ভোগই হল জীবনের সাফল্য– তা সে যত নীতিহীনই হোক৷
কেন এমন শেখানো হচ্ছে? কারণ, এই নীতিহীন শিক্ষাই একচেটিয়া পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফার লালসাকে, দুর্নীতিকে, নির্মম শোষণকে যুক্তিসংগত এবং স্বাভাবিক বলে ভাবতে শেখায়৷ ভোগের হাজারো উপকরণের মধ্যে নারীদেহও অন্যতম৷ পণ্য বিপণনের অন্যতম হাতিয়ার বিজ্ঞাপনে নারীদেহ ব্যবহার করে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি৷ টিভিতে, সংবাদমাধ্যমে, সোস্যাল মিডিয়ায় খবর পরিবেশনের মাঝেই চলছে এই ধরনের কুরুচিকর প্রদর্শনী৷ তার সাথে চলছে মদের ঢালাও প্রসার৷ ফলে দুর্বৃত্তায়ন বেড়েই চলেছে৷ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রবল হলে, জনমত প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলে সরকার–প্রশাসন কখনও কখনও দুর্বৃত্তদের একটা দুটো চুনোপুঁটিকে ধরপাকড় করে৷ তারপর ছাড়াও পেয়ে যায়৷ কিন্তু কেন এই দুর্বৃত্তায়ন, কোথা থেকে এর জন্ম এ প্রশ্ন না তুললে পুঁজিবাদী সমাজকে আড়াল করে রেখে একে রোখা সম্ভব নয়৷
সর্বাগ্রে প্রয়োজন উন্নত নতুন সমাজের পত্তন, যেখানে উন্নত রুচি–সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ গড়ে উঠবে৷ উন্নত আদর্শে বলিয়ান হয়ে দেহে–মনে সুস্থ মানুষ হয়ে উঠবে৷ খাদ্য–বস্ত্র–শিক্ষা, এমনকী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে হবে না৷ সুস্থ দেহ, সুস্থ মনের শিশুরা যে সমাজের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে, সেই স্বপ্নের সমাজই দিতে পারে শিশু ও নারীর প্রকৃত নিরাপত্তা৷
(৭০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা ২৫ মে, ২০১৮)