যথার্থই স্ফূলিঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা। উত্তাল বাংলা, উত্তাল সমগ্র দেশ। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ ইউরোপে, আমেরিকায়। একটাই দাবি, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। আর জি কর হাসপাতালের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ছাত্রীর নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের বিচার চাই। নেপথ্যে থাকা প্রকৃত দোষীদের আড়াল করা চলবে না। তদন্তের নামে খুনের প্রমাণ লোপাট করা চলবে না।
শুধু ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীই নয়, প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ-স্কুলের হাজারে হাজারে ছাত্রছাত্রী, আইনজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, আর্টিস্ট, সকল পেশার নাগরিক, কর্মরত শ্রমিক, গ্রামের কৃষক, এমনকি প্রথম সারির ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকরা। বোঝা যায় রাজ্যে পর পর ক্ষমতাসীন শাসকরা পশ্চিমবঙ্গের সংগ্রামী প্রাণসত্তাকে আজও সম্পূর্ণ ধবংস করতে পারেনি। এটাই আশা জাগায়, প্রেরণা সঞ্চারিত করে।
সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় ১৪ আগস্ট মধ্যরাত। সামান্য বিজ্ঞপ্তির আহ্বানে অসামান্য সমাবেশ। পুরুষ শাসিত সমাজে অপশাসিত, লাঞ্ছিত, দমিত, দুর্বল বলে গণ্য কয়েক লক্ষ নারীশক্তি প্রবল বলিষ্ঠতায়, অদম্য তেজে মধ্যরাতে শহরে, গ্রামে গঞ্জে প্রতিবাদে গর্জে উঠল। এ চিত্র অভূতপূর্ব, অসাধারণ। ভারতে স্বদেশি আন্দোলনের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এটা দেখা যায়নি। গণআন্দোলনের ইতিহাসে এ এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। এ যেন বিপ্লবী কবি নজরুলের ‘জাগো নারী, জাগো বহ্নিশিখা’ মূর্ত হয়ে উঠেছিল সে দিন পশ্চিমবঙ্গে। দিল্লির সিংহাসনে, পশ্চিমবঙ্গে ও অন্যান্য রাজ্যের কুর্সিতে আসীন ক্ষমতা মদমত্ত শাসকরা এই জাগ্রত নারীশক্তির প্রতিবাদের ভাষা হয়তো অগ্রাহ্য করতে পারে, কিন্তু এটা আগামী দিনের গণআন্দোলনে প্রবল প্রেরণা যোগাবে। একের পর এক এইসব সংগ্রামী কর্মসূচিতে সামিল সকলকেই আমরা সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি।
এই নারকীয় বীভৎস ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে কী না করেছে সরকার এবং তার পুলিশ প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আত্মহত্যা বলেছিল এবং প্রমাণ লোপাট করার সব রকম ষড়যন্ত্র করেছিল। ১৪ আগস্ট গভীর রাতে রাস্তায় যখন গণ প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছে, ঠিক সেই সময় দুষ্কৃতীরা আর জি করের এমার্জেন্সি বিভাগে হামলা চালাল। ভেঙে দিল দামি দামি মেসিন, যন্ত্রপাতি। চলে যাওয়ার সময় ডিউটিরত নার্সদের নোংরা ইঙ্গিত করে হুমকি দিয়ে গেল, ‘এখন গেলেও আবার ফিরে আসছি, তখন দেখে নেব।’
বিচার করে দেখুন, কারা এই হামলা করতে পারে? শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া আর কারও স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে কি এসবের দ্বারা? এই হামলার বিরুদ্ধে আমাদের দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) সেই দিন মধ্য রাতেই ১৬ আগস্ট সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করে। মাঝে প্রচারের একটাই দিন–১৫ আগস্ট। সেদিন আবার পুরো ছুটি। এত অল্প সময়ের প্রচারেও জনগণ যে ব্যাপক ভাবে সাড়া দিয়েছেন, তার জন্য আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন– এই রাজ্যে ধর্মঘট চলবে না। তিনি জেনে রাখুন, কংগ্রেস শাসনে এ রাজ্যে বিভিন্ন বামপন্থী দলের সাথে যুক্তভাবে আমাদের দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) জনগণের দাবিতে ধর্মঘট করেছে বহুবার। সিপিএম শাসনকালেও আমাদের দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) একক ভাবে নানা দাবিতে ও অত্যাচারের প্রতিবাদে ১১ বার ধর্মঘট করেছে। এ বারেও প্রয়োজনে হুমকি উপেক্ষা করেই জনস্বার্থে ১৬ আগস্ট় ধর্মঘট করার আবেদন জানাই। কারণ এটা স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকেই অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকারকে পদদলিত করে পুলিশ মিথ্যা মামলায় আটক করে রেখেছে ধর্মঘটের কর্মীদের।
আর জি করের ঘটনাও নতুন নয়। এ রাজ্যে তৃণমূল শাসনে পার্কস্ট্রিট, কামদুনি সহ আরও বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যার কোনও বিচার, শাস্তি হয়নি। ইতিপূর্বে সিপিএম শাসনকালে শুধু বানতলাই নয়, আরও বহু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষে সিঙ্গুরে ও নন্দীগ্রামে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ করিয়েছে। বিজেপি ও কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিতেও বহু ধর্ষণ ও খুনের খবর প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে পাওয়া যায়। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ নারী ধর্ষণে ও খুনে এবং পশ্চিমবঙ্গ নারী পাচারে দেশে শীর্ষস্থানে। সিপিএম শাসিত কেরালাতেও যৌন নির্যাতনের, ধর্ষণের অভিযোগ উঠছে। নিজ নিজ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তারা তো আন্দোলন করছে না!
এ বার গণআন্দোলনের চাপে হয়ত ধর্ষকরা, ষড়যন্ত্রকারীরা ধরা পড়বে, শাস্তি পাবে, আবার নাও হতে পারে। আমরা সকলের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি। সাথে সাথে আমরা এ কথাও বলতে চাই– এ দেশে প্রতি রাজ্যেই প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ইভটিজিং, কিডন্যাপিং, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুন চলছে এবং বেড়েই চলেছে।
কেন এসব হচ্ছে? কোনও শিশু তো ধর্ষক হয়ে জন্মায় না, জন্মলগ্ন থেকে মানবিক গুণাবলি নিয়েও আসে না। মানবিক গুণাবলি অর্জিত হয় সমাজ পরিবেশ থেকে। দেশের ছাত্র-যুবকরা একদিন ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়েছে, স্বাধীনতার দাবিতে লাঠি-গুলি খেয়েছে, ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছে। আজ স্বাধীন দেশের একদল কিশোর-যুবকের মধ্যে এই প্রবণতা এল কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে ১৯৭৪ সালে হুঁশিয়ারি দিয়ে গেছেন মহান মার্ক্সসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ। তিনি বলেছেন, ‘‘ভারতবর্ষের শাসক সম্প্রদায় জাতির নৈতিক চরিত্রটিকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলার ষড়যন্তে্র লিপ্ত। তারা অত্যন্ত ধুরন্ধর। তারা জানে, শত অত্যাচার ও দমনপীড়ন করেও, না খেতে দিয়েও একটা জাতিকে, একটা দেশের জনসাধারণকে শুধু পুলিশ ও মিলিটারির সাহায্যে বেশি দিন পদদলিত রাখা যায় না। …যদি জনশক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, যদি তারা সঠিক বিপ্লবী আদর্শের হদিশ পায় এবং তাদের নৈতিক বল অটুট থাকে । … ভারতবর্ষের বুর্জোয়ারা, শাসক সম্প্রদায়ের…শয়তান শাসক শোষক হিসাবে … কার্যকরী শিক্ষাটি কিন্তু ঠিক তারা নিয়েছে। সেটি হচ্ছে– জাতির নৈতিক বল খতম করে দাও, জাতির চরিত্রকে মেরে দাও। তা হলে তারা না খেতে পেয়েও … গুমরাতে থাকবে, ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকবে, … কিন্তু সংগঠিত বিপ্লবের রূপ দিতে পারবে না।’’ এই সতর্কবাণী আজ মর্মান্তিক বাস্তব হিসাবে দেখা দিয়েছে। ব্রিটিশ শাসিত মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, জ্যোতিরাও ফুলে, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রেমচাঁদ, নজরুল, সুব্রহ্মনিয়ম ভারতী, দেশবন্ধু, তিলক, লালা লাজপত, সুভাষচন্দ্র, ভগৎ সিং, সূর্য সেন, চন্দ্রশেখর আজাদেরা পর্যায়ক্রমে যুবশক্তিকে নূতন নৈতিক বলে বলীয়ান করেছেন। আজ শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি ও তার সেবক সরকারি দলগুলির ষড়যেন্ত্রে এইসব মহান চরিত্রগুলিকে বিস্মৃতির অতল তলে নিমজ্জিত করা হয়েছে, নৈতিক বল খতম করার হীন উদ্দেশ্যে। উৎসাহিত করার চেষ্টা হচ্ছে মদ্যপানে, ড্রাগ অ্যাডিকশনে, জুয়া-সাট্টা খেলায়, নারী দেহ নিয়ে নোংরা আলোচনায়, যৌনতা উত্তেজক ব্লু-ফিল্ম ও নানা অশ্লীল চিত্র দেখতে মত্ত রাখায়। এই ধরনের বিবেক-মনুষ্যত্বহীন একদল যুবক শাসক দলগুলির পৃষ্ঠপোষকতায় টাকার বিনিময়ে খুন করে, ভোটে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, পুলিশ টুঁ শব্দও করে না। এরাই শোষক পুঁজিবাদের সৃষ্টি, এরাই পুঁজিবাদের রক্ষক। তাই যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে, অন্যান্য সংকটের মতো এই ধর্ষণ ও খুনের সংকটও থাকবে।
তাই বলে কি অসহায় হয়ে চুপ করে থাকতে হবে? নিশ্চয়ই তা নয়। তাই এখন যে আন্দোলন চলছে, এ রকম আন্দোলন প্রয়োজনে বারবার করতে হবে। একই সাথে অত্যন্ত প্রয়োজন, পূর্বোক্ত মনীষী ও বিপ্লবীদের জীবন সংগ্রামের শিক্ষায় প্রতি শহরে ও গ্রামে কিশোর ও যুবকদের অনুপ্রাণিত করা, পাড়ায় পাড়ায় রবিবার ছুটির দিন কিশোরদের নিয়ে খেলাধূলা, গান, নাটক, মনীষী ও বিপ্লবীদের নিয়ে আলোচনা। এ ভাবে তাদের জীবন-প্রভাতে শিক্ষিত করা। আর অত্যন্ত প্রয়োজন প্রতিটি পাড়ায় দলমত নির্বিশেষে সৎ-সাহসী পুরুষ-নারীদের নিয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা ও ভলেন্টিয়ার বাহিনী গড়ে তোলা, যারা যে কোনও মুহূর্তে বিপন্ন নারীকে রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, যে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করবে। আমরা সর্বস্তরের নাগরিকের কাছে আবেদন করছি, সকল দলের সৎ কর্মী-সমর্থকদের কাছেও আবেদন করছি, আপনারা অবশ্যই এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসুন। না হলে কেউ কোনও দল করুন বা না করুন, আমাদের পরিবারের কন্যাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি নেই। আমাদের পরিবারের পুত্র সন্তান যে বিপথগামী হবে না, তারও গ্যারান্টি নেই।
এই মুহূর্তে আসুন স্মরণ করি, কবিগুরুর সেই বাণীটি ‘‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’’ এবং নেতাজির উক্তি, ‘‘স্কুলে-কলেজে, ঘরে বাইরে, পথে-ঘাটে-মাঠে, যেখানে অত্যাচার, অবিচার বা অনাচার দেখিবে, সেখানে বীরের মতো অগ্রসর হইয়া বাধা দাও, মুহূর্তের মধ্যে বীরত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হইবে। … আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে শক্তি কিছু যদি সংগ্রহ করিয়া থাকি তাহা শুধু এই উপায়েই করিয়াছি।’’ আমাদের শিক্ষক কমরেড শিবদাস ঘোষ বারবার বলতেন, ‘‘ব্যক্তি হিসাবে তুমি যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে পার, তা হলে তুমি মানুষ নামেরই যোগ্য নয়।’’ এই মহৎ শিক্ষাগুলির ভিত্তিতেই আমাদের কর্তব্য নির্ধারিত হোক, এই আমাদের আবেদন।