মহিলাদের সামাজিক অবস্থা নিয়ে এ বছর ভারত সরকারের সমীক্ষায় উঠে এসেছে এক মর্মান্তিক রিপোর্ট। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলার মেয়েদের বড় অংশের এখন ঘরকন্নাই একমাত্র সম্বল। এ রাজ্যের কিশোরী তরুণী-যুবতীদের প্রায় ৫০ শতাংশই এই শ্রেণিভুক্ত, যারা স্রেফ বাড়ির কাজ করেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও লক্ষ্যণীয়ভাবে কম। নারীদিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে পড়াশোনা, প্রশিক্ষণ, রোজগার কোনও কিছুর মধ্যেই না থাকা মেয়েদের হার অধিকাংশ রাজ্যের তুলনায় বেশি। কন্যাশ্রী প্রকল্পে থোক টাকা মেলায় অনেক মেয়েরই কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েদের হার পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি। ৪৫ শতাংশ মেয়েরই ২১ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের ২৯.৩ শতাংশ কোনও রকম পড়াশোনা, প্রশিক্ষণ বা কাজকর্মের সাথে যুক্ত নয়। এদের মধ্যে মেয়েদের হার ৪৩.৮ শতাংশ, ছেলেদের হার ১৬.১ শতাংশ।
সম্প্রতি এক বিবাহিত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে শ্বশুরবাড়িতে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিল, যাতে সে পরীক্ষা দিতে না পারে। তার অ্যাডমিট কার্ডসহ বইয়ের ব্যাগ বাগানে ফেলে দেওয়া হয়। ওই পরীক্ষার্থী কোনও রকমে ঘর থেকে পালিয়ে থানায় যায় এবং পুলিশের সহায়তায় পরীক্ষা দেয়। আর একটি ঘটনা, এক বধূ পরপর দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে স্বামী। এ রকম ঘটনা আকছার ঘটে চলেছে রাজ্যে। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, অসম, ওড়িশার হাল আরও খারাপ।
নারী নির্যাতন, পণের জন্য চাপ এবং তার জেরে বধূহত্যা, ডাইনি সন্দেহে হত্যা, অ্যাসিড আক্রমণ, কন্যাভ্রূণ হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ এগুলি মারাত্মক ভাবে বেড়ে চলেছে। নারীদের অধিকার অর্জনের গৌরবময় লড়াইয়ের এত বছর পেরিয়ে এসেও ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারী আজও পূর্ণ মানুষের মর্যাদা পেল না। নারীর উপর সংঘটিত অপরাধের নিরপেক্ষ তদন্ত, অপরাধীর শাস্তি– আজও অধরা। বিচারের বাণী কেঁদে চলেছে নীরবে নিভৃতে। উত্তরপ্রদেশের হাথরসের ঘটনা তার নির্লজ্জ প্রমাণ। একটি দলিত তরুণীকে উচ্চবর্ণের চার দুষ্কৃতী ধর্ষণ করে এবং বীভৎস অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করে। তারপর পুলিশ রাতের অন্ধকারে বাড়ির লোকের অজান্তে মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয় কোনও তদন্ত ছাড়াই। প্রমাণের অভাবে আদালত তিনজন জঘন্য অপরাধীকে বেকসুর খালাস করে দেয়। গুজরাটে ২০০২ সালের গণহত্যার সময় বিলকিস বানোকে যারা গণধর্ষণ করেছিল, তার তিন বছরের শিশুকন্যাকে বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পাথরে আছড়ে হত্যা করেছিল, পরিবারের অন্য ৭ জনকেও হত্যা করেছিল, সেই ১১ জন নরপিশাচকে ২০২২-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’-এর সূচনার দিনে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, তাদের গলায় মালা পরিয়ে মিষ্টি খাইয়ে সংবর্ধিত করে শাসক বিজেপির লোকেরা! আজও আমাদের দেশে মেয়েরা কর্মস্থলে স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারেন না। তাদের নানা রকম যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়, যা তারা মুখ ফুটে বলতেও পারেন না কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে। একই কাজের জন্য বহু ক্ষেত্রে পুরুষের সমান মজুরি দেওয়া হয় না মেয়েদের। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মহিলা কর্মী যাঁরা আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কিংবা মিড-ডে মিল, পৌর স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের নামমাত্র পারিশ্রমিকে কঠোর পরিশ্রম করানো হয়। সেই স্বল্প পারিশ্রমিকও সময়মতো দেওয়া হয় না। চলে নানা জুলুম শোষণ।
এ শুধু ভারতের চিত্র নয়, বিশ্ব জুড়ে প্রায় সব পুঁজিবাদী দেশেই নারীর সমানাধিকারের দাবি, মানুষের মতো বাঁচার দাবি উপেক্ষিত। খোদ আমেরিকাতেও অভিজাত মহিলারা, সাংসদরা, অভিনেত্রীরা পর্যন্ত ‘মি টু’ আন্দোলনে সামিল হয়ে তাঁদের উপর অত্যাচারের কথা তুলে ধরেছেন। ‘নারীর নিরাপত্তা’ কথাটা নেহাতই ঠুনকো হয়ে পড়েছে আজকের পৃথিবীতে।
নারীদের উপর বীভৎস নির্যাতন চলছে আফগানিস্তান, ইরান সহ আরও কিছু দেশে। যেখানে এই একুশ শতকেও শাসকের ফতোয়া অনুযায়ী নারীর লেখাপড়া, চাকরির অধিকার তো নেই-ই, এমনকি ঘরের বাইরে একলা বেরোনোরও অধিকার নেই। শত অত্যাচারের পরও স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের অধিকার নেই। মাথার চুল হিজাবে পুরো ঢাকেনি এই অভিযোগে ইরানের ২১ বছরের তরুণী মাহশা আমিনিকে প্রশাসন কী পাশবিক নির্মমতায় হত্যা করেছে গোটা বিশ্ব তা দেখে শিউরে উঠেছে। দেশে দেশে সচেতন মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। ইরানের স্বৈরাচারী সরকার সে দেশের বহু প্রতিবাদীকেও গ্রেফতার করেছে, প্রাণদণ্ড দিয়েছে। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ ইরানের কায়ুম শহরে আইন পড়া মেয়েদের শরীরে বিষপ্রয়োগ করা হচ্ছে। এই ভাবে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি।
ভারতেও কেন্দ্রের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার মেয়েদের বহু লড়াইয়ে অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নিয়ে তাদের গৃহকর্মে আটকে রাখতে চাইছে। হিটলারের ‘গো ব্যাক টু কিচেন’ তত্ত্বের সার্থক রূপকার! কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক কূপমণ্ডুক চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটিয়ে তাদের শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত করতে চাইছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভসংস্কারের কর্মসূচি শুরু করে দিয়েছে। বলছে, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে পড়তে হবে রাম, হনুমান কিংবা শিবাজির সংগ্রামের কাহিনি। তার ফলে নাকি জন্মের আগে থেকেই গর্ভের সন্তান ভারতীয় সংস্কারে অভ্যস্ত ও দেশপ্রেমী হয়ে উঠবে! ভাবতে অবাক লাগে, আমরা কোন যুগে বাস করছি! জ্ঞান বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরও এ রকম অবৈজ্ঞানিক ভাবনা সমাজকে কোন অন্ধকারে ঠেলে নিয়ে চলেছে! ‘গরব সে কহো হম হিন্দু হ্যায়’ স্লোগান চিৎকার করে আওড়াচ্ছেন যাঁরা তারা ঋকবেদে বর্ণিত অম্ভৃণীর মতো নারী চরিত্রের খবরও রাখেন না– যে নারী দৃপ্তকে_ উচ্চারণ করেছিলেন ‘আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং বিশ্বদেবতা রূপে বিচরণ করি’। নারী শুধু ঘরকন্না করবে, পতিসেবা করবে এবং সন্তানের জন্ম দেওয়াই তার একমাত্র কর্তব্য– এর বিরুদ্ধ স্বরের উল্লেখও রয়েছে। অম্ভৃণির এই সুক্তই ঋক বেদে দেবীসুক্ত নামে খ্যাত। হিন্দুত্বের ঝাঁঝালো আরক ভুলিয়ে দিয়েছে এ দেশে দর্শনচর্চা থেকে শুরু করে সর্বত্র নারীর চিন্তাভাবনা ও স্বকীয়তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। সেই নারী ধীরে ধীরে কী ভাবে অধিকার হারাল তা এক ভিন্ন আলোচনা।
হিন্দুত্ব এবং ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে আজকের হিন্দুত্ববাদীরা নারীকে আরও বেশি করে গৃহবন্দি করতে চায়। আসলে আজকের পুঁজিবাদ মরণোন্মুখ। নিজের বিকাশের রাস্তা নিজেই অবরুদ্ধ করে সে নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকায় উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির বাজার আজ সঙ্কুচিত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নত যন্ত্র কাজে লাগিয়ে অধিক উৎপাদন করা যাচ্ছে না, তাই মানুষকে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা থেকে, সত্য জানার সুযোগ থেকে দূরে রাখ। কুসংস্কার, কুপমণ্ডুক চিন্তার বিস্তার ঘটাও। এ ছাড়া পুঁজিবাদের আজ আর বাঁচার রাস্তা নেই।
নারীসমাজ আজ শোষিত নিপীড়িত হচ্ছে দু’দিক দিয়ে। এক দিকে পুঁজিবাদের সঙ্কটে তার জীবন বিপর্যস্ত, অন্য দিকে পুরুষশাসিত সমাজের দমন-পীড়ন-অত্যাচার তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। নারীদেহকে পণ্য হিসাবে, ভোগের সামগ্রী হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে মেয়েদেরই। আর এই লড়াইতে প্রেরণা জোগাবে আঠারো-উনিশ শতক, বিশ শতকের গোড়ার দিকের তেজোদীপ্ত নারী আন্দোলনের উজ্জ্বল ইতিহাস। আঠারো-উনিশ শতাব্দীতে ইউরোপ আমেরিকার দেশে দেশে নারীরা, বিশেষ করে শ্রমজীবী নারীরা কাজের নির্দিষ্ট সময়, পরিবেশ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিপত্রের মূল্যহ্রাস, শিক্ষার অধিকার, সর্বোপরি নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে দীর্ঘস্থায়ী জঙ্গি আন্দোলন করেছেন, রাজপথে দৃপ্ত মিছিল করেছেন, প্যারিসের আইনসভা ঘেরাও করেছেন, পেত্রোগ্রাদে দিনের পর দিন ধর্মঘট করেছেন, অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রবল বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
সেই আন্দোলনকে মান্যতা দেওয়ার জন্যই ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন আন্তর্জাতিক নারীদিবস ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। সম্মেলনে বিশ্বের ১৭টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথি হিসাবে বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের নেতা, রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের রূপকার মহান লেনিন উপস্থিত ছিলেন। নারীদের অধিকার অর্জন আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসাবে ১৯১০ সালে আন্তর্জাতিক নারীদিবসের ঘোষণা হয়েছিল। অধিকার অর্জনের সেই লড়াই থেকে প্রেরণা নিয়ে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা পাওয়ার দাবিতে আজ আবার সংগ্রাম গড়ে তোলার সময় এসেছে। সেই সংগ্রামে সামিল হতে হবে সর্বস্তরের নারীদের। পাশাপাশি নিজেদের যুক্ত করতে হবে মানবতার শত্রু পুঁজিবাদ উচ্ছেদের লড়াইতে। এছাড়া নারীমুক্তি অর্জন করা সম্ভব নয়।