নারীর ক্ষমতায়ন নির্ভর করে সঠিক আদর্শভিত্তিক রাজনীতির উপর

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে সংবাদপত্রে, সমাজমাধ্যমে নারী সমাজের উন্নতি নিয়ে নানা তথ্য-পরিসংখ্যান উঠে আসছে। বিভিন্ন দলের মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা কত, কোন দল ক্ষমতায় এলে মহিলাদের উন্নতির জন্য কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা নিয়ে আলোচনা, লেখালিখি চলছে। রাজনীতিতে মহিলারা বেশি করে অংশগ্রহণ করলে, তা প্রগতিরই পরিচয়।কিন্তু এই ‘অংশগ্রহণ’ বিষয়টাকে কী ভাবে দেখা উচিত? কোন দল কত মহিলা প্রার্থী দিল, কোন দলের ইস্তেহারে ক্ষমতায় এলে মহিলাদের সমস্যা নিরসনের প্রতিশ্রুতি সংখ্যায় বেশি থাকল বা কোন দলের কতজন মহিলা মন্ত্রী হলেন, শুধুমাত্র এই পরিসংখ্যান দিয়ে কি নারীসমাজের বাস্তব অগ্রগতির ছবিটা পরিষ্কার হবে? সহজ বুদ্ধি বলে, কোনও রাজনৈতিক দল মহিলাদের সুরক্ষা, সম্মান এবং উন্নয়ন নিয়ে সত্যিই ভাবছে কি না, তা বুঝতে হলে সেই দলের রাজনীতি, দলের নেতা-কর্মীদের রুচি-সংস্কৃতিকে সবার আগে বোঝা দরকার।

বিগত দশ বছর দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকা বিজেপি দলটির কথাই ধরা যাক।অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি সহ আরও কয়েকজন মহিলা মন্ত্রী আছেন বিজেপি সরকারের মন্ত্রিসভায়।দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি একজন মহিলা এবং পিছিয়ে পড়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু এইসব ‘পদাধিকার’ বা ‘অংশগ্রহণ’ কি বিজেপি শাসনে মহিলাদের ন‌্যূনতম সুরক্ষা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? বিজেপি-শাসিত রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশ দেশের মধ্যে নারী ধর্ষণে প্রথম ও দ্বিতীয়। গুজরাত দাঙ্গায় বিলকিস বানোর ধর্ষক ও তাঁর শিশুকন্যার খুনিদের জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে রীতিমতো মিষ্টিমুখ করিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছে সে রাজ্যের বিজেপি সরকার। অন্য ধর্মের মহিলাদের সম্পর্কে যোগী আদিত্যনাথ সহ বিজেপির বিভিন্ন নেতামন্ত্রীরা নানা সময় ভয়াবহ বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন। হাথরসে নির্যাতিতার দেহ পুড়িয়ে, তাঁর পরিবারকে আক্রমণ করে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা হয়েছে, জম্মুর কাঠুয়ায় আসিফার ধর্ষক-খুনিদের সমর্থনে বিজেপি বিধায়কদের মিছিল করতে দেখা গেছে। কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ সিংয়ের শাস্তির দাবিতে দিনের পর দিন রাস্তায় ধরনা দেওয়া পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিদের কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পুলিশ তাঁদের টেনে হিঁচড়ে গ্রেপ্তার করেছে। এর কোনও একটি ঘটনাতেও কি বিজেপি সরকারের মহিলা মন্ত্রীরা দুঃখপ্রকাশ করেছেন? কোথাও কি দেখা গেছে, কোনও মন্ত্রী বা সাংসদ মহিলা হয়ে এইসব নির্যাতিতা মহিলাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বা তাঁর দলের প্রশ্রয়ে এইসব জঘন্য নারী নির্যাতনের কোনও প্রতিবাদ করেছেন?

বিজেপির মতাদর্শগত অভিভাবক যে আরএসএস সংগঠন, তার প্রধান মোহন ভাগবত যখন ‘মহিলাদের কাজ শুধু গৃহকর্ম করা’ এমন মন্তব্য করেন এবং একটি চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দেন, তখনও বিজেপির কোনও মহিলা প্রতিনিধি-মন্ত্রী-বিধায়কের প্রতিবাদ শোনা যায়নি। এই ভোটের মরসুমেই বিজেপি সমর্থিত জেডিএস নেতা প্রোজ্জ্বল রেভান্নার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের ভয়ঙ্কর অভিযোগ সামনে এলে তার দ্রুত তদন্ত করে শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, তিনি বিশেষ পাসপোর্টের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর নাকের ডগা দিয়ে দিব্যি বিদেশে পালিয়ে গেলেন।এগুলি কী প্রমাণ করে? এরা মহিলাদের যথার্থই মানুষের মর্যাদা দেয়?নাকি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মরে করে?

পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর রাজ্যের বর্তমান প্রশাসনিক প্রধান হয়েছেন একজন মহিলা। কিন্তু এর কতটুকু সুফল সাধারণ মহিলাদের কাছে পৌঁছেছে? নারী পাচার-খুন-ধর্ষণের বাড়বাড়ন্ত এতটুকু কমেনি। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের পর মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’ বলে অপরাধের গুরুত্ব আড়াল করা, কামদুনির প্রতিবাদীদের ‘মাওবাদী’ বলে ধমকে চুপ করিয়ে দেওয়া, এমন একের পর এক ঘটনায় মহিলাদের সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের অসংবেদনশীলতা প্রকাশ পেয়েছে।ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি-পাচার এর মতো অপরাধ ছাড়াও শিক্ষার হার, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও সমতা, অপুষ্ট শিশুর জন্ম, গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা শ্রমিকদের দুরবস্থা এমন আরও অজস্র পরিসংখ্যান প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দিচ্ছে, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এর বিজ্ঞাপনী জৌলুস বা কন্যাশ্রী-রূপশ্রী-লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি দিয়ে সমাজের লক্ষ লক্ষ মহিলার আর্তনাদ আড়াল করা যাবে না। কাজেই, দেশে বা রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদে যতই মহিলারা থাকুন বা ভোটসর্বস্ব দলগুলো নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ প্রমাণ করতে যতই মহিলা প্রার্থীদের দাঁড় করাক, দলের রাজনীতি যদি নীতি-আদর্শহীন হয়, শুধু ক্ষমতার রাজনীতি হয়, তা হলে সে দলের মহিলা প্রতিনিধিরাও মূলত সেই ক্ষমতার সুরেই সুর মেলাবেন বা মেলাতে বাধ্য হবেন। ইস্তেহারে যতই নারী উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি থাক বা সংসদে মহিলা আসন সংরক্ষণের বিল এনে খাতায় কলমে মহিলাদের অধিকার দেওয়া হোক, সাধারণ নারীদের জীবন যন্ত্রণার বিন্দুমাত্র সুরাহা তাতে হবে না।

এ রাজ্যে পূর্বতন সিপিএম সরকারের আমলে বানতলা ধর্ষণকাণ্ডের মতো ভয়ানক ঘটনার পর জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘এমন তো কতই হয়’।সুটিয়ায় সিপিএম নেতা সুশান্ত চৌধুরী ও তার মদতপুষ্ট গুন্ডারা দিনের পর দিন মহিলাদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করত। প্রতিবাদী শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে মঞ্চ গড়ে তুলে রুখে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করে কায়েমি স্বার্থবাদীরা।নেতাই, মরিচঝাঁপি, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম সহ বহু ঘটনায় স্থানীয় মহিলাদের উপর, বিরোধী দলের মহিলা কর্মীদের উপর সিপিএমের পুলিশ এবং লেঠেল বাহিনী অত্যাচার করে পার পেয়ে গেছে।অনিল বসু, বিনয় কোঙার মহিলাদের সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করেছেন। ক্ষমতার ৩৪ বছরে কেন্দ্রে, রাজ্যে সিপিএম দলটির মহিলা সাংসদ-বিধায়ক তো কম ছিল না।তাঁরা কি দলের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসে মুখ খুলেছেন বা খুলতে পেরেছেন?

আসলে, নারীদের অবস্থার উন্নতি, নারীর মর্যাদা এবং সুরক্ষা, নারীর অধিকারের মতো বিষয়গুলো সমাজব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও জিনিস নয়।প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পর পুরুষতান্ত্রিক সমাজও এসেছিল সম্পত্তির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করেই।নবজাগরণের সময় সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মর্যাদা ও সমানাধিকারের সাথেই সমাজে নারীর মর্যাদা, নারীর অধিকার, কর্মক্ষেত্রে ও পারিবারিক জীবনে সমানাধিকারের দাবি উঠেছিল।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মহিলাদের যতটুকু অধিকার দাবি দাওয়া অর্জিত হয়েছিল, তার পেছনে ছিল দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস।আমাদের দেশে বিদ্যাসাগর, রামমোহনের মতো মানুষরা নারীর অধিকারের জন্য জীবন পণ করে সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনী-রোকেয়া-সাবিত্রীবাই ফুলে-দুর্গাবাঈ-এর মতো নারীরা সেই পিছিয়ে পড়া দেশে মেয়েদের মানুষ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জীবন দিয়ে।কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজের ভিত্তিই দাঁড়িয়ে আছে শোষণ আর মুনাফার ওপর, তাই একদিন যে পুঁজিবাদ নারীমুক্তির স্লোগান তুলেছিল, সে যত শক্তিশালী, সংহত হয়েছে তত সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে মানুষের অধিকারের সাথে সাথে নারীদের অধিকারও সে পদদলিত করেছে। সামন্ততন্দ্রের সরাসরি সম্পত্তি হিসেবে নারীদের কেনাবেচা চলত, আজ মুমূর্ষু পুঁজিবাদ নিজের মুনাফার প্রয়োজনে নারীকে, নারীদেহকে পণ্য করছে। নাম বা পতাকার রঙ যাই হোক, বাস্তবে বড় বড় দলগুলো ক্ষমতায় বসে এই পুঁজির দাসত্বই করে চলেছে। তাই স্বাধীনতার পর এতগুলো দশক পেরিয়েছে, দেশের প্রধানমন্ত্রীত্বেও মহিলা বসেছেন, কিন্তু ঘরে ঘরে মেয়েদের কান্না বন্ধ হয়নি।ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, শ্লীলতাহানি, নারী পাচার, কর্মক্ষেত্রের বৈষম্য ও যৌন হয়রানি সহ ঘরে-বাইরে অজস্র বাধার দেওয়াল আজও পেরোতে হয় মেয়েদের। মালিক-শ্রমিকে বিভক্ত এই সমাজে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ছাড়া, অধিকার অর্জনের বিপ্লবী রাজনীতির চর্চা ছাড়া নারীমুক্তির লড়াই যে অসম্ভব, এই মূল কথাটি একমাত্র উঠে আসছে বিপ্লবী বামপন্থী দল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে।মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে উন্নত রুচি-সংস্কৃতির আধারে গড়ে ওঠা এই দলের বিপ্লবী রাজনীতি মেয়েদের যে মর্যাদাময় জীবনের সন্ধান দিয়ে চলেছে, তার ছোঁওয়াতেই নিজেদের গণআন্দোলনের সৈনিকে পরিণত করার চেষ্টা করেন এ দলের মহিলা কর্মীরা। আদর্শকে ভিত্তি করে নতুন মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এই মহিলারা বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব নিয়ে সমাজের সামনে এসে দাঁড়ান।এ জন্যই এই দলের মহিলাকর্মীরা রাজনীতি ক্ষেত্রে একটা বিশিষ্টতা অর্জন করেন।লোকসভা নির্বাচনেও সেই নারী মুক্তির বার্তা নিয়েই দেশ জুড়ে মানুষের মধ্যে যাচ্ছেন এসইউসিআই(সি)-র মহিলা প্রার্থীরা। চেনাচ্ছেন মেয়েদের সত্যিকারের মুক্তির রাস্তা।