ভারতবর্ষ তথা বিশ্বে বিজ্ঞান গবেষণায় কলকাতার আইএসিএস (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স) ঐতিহ্যমণ্ডিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান৷ ভারতীয় নবজাগরণের ধারাবাহিকতায় বরেণ্য মনীষীরা উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষের মনন থেকে ধর্মীয় অন্ধতা, গোঁডামি, কুসংস্কারাছন্ন সামন্তী চিন্তার প্রভাব দূর করতে হলে চাই জ্ঞান–বিজ্ঞানের ব্যাপক চর্চা৷ সেই উদ্দেশ্যেই ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগে ১৮৭৬ সালে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য গডে ওঠে এই প্রতিষ্ঠান৷ এই প্রতিষ্ঠানের গডে ওঠা, বিকাশ ও গবেষণার সাথে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্যার আশুতোষ মুখার্জি, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ডাক্তার নীলরতন সরকার, ডাক্তার ইউএন ব্রহ্মচারী, চুনিলাল বোস, প্রমথনাথ বোস, কেশবচন্দ্র সেন, রাজা প্যারিমোহন মুখার্জী প্রমুখ স্বনামধন্য মানুষ৷ এই প্রতিষ্ঠান থেকেই পদার্থবিদ্যার মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করেছিলেন সিভি রমন৷ এ জন্য তিনি ১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কার পান৷
কিন্তু অত্যন্ত বেদনা ও উদ্বেগের সাথে দেশবাসী লক্ষ করল গত ১৩ সেপ্টেম্বর সেই আইএসিএসের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস উদ্বোধন উপলক্ষে কর্তৃপক্ষ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী হর্ষবর্ধন বিজ্ঞান চিন্তার চূডান্ত পরিপন্থী ধর্মীয় হোমযজ্ঞ, পুজোপাঠ, তিথি মেনে গণেশ পুজো এবং কুসংস্কারাছন্ন প্রথায় নারকেল ভেঙে শিলান্যাস করলেন৷ প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা ও মন্ত্রী উভয়েই বিজ্ঞান গবেষণায় গণেশের মাহাত্ম্য প্রচার করেন৷ যা সংবাদপত্রে ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছে৷ একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের এহেন অবৈজ্ঞানিক আচরণ জন–মানসে কুসংস্কার ও সামন্তী তমসাছন্ন চিন্তার প্রসারে সরকারি মদতের নামান্তর৷
প্রসঙ্গত, এই মন্ত্রী কিছুদিন আগে দাবি করেছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং নাকি বলেছিলেন ভর ও শক্তির সম্পর্ক বিষয়ে আইনস্টাইনের তত্ত্বের থেকেও উন্নত ব্যাখ্যা আছে বেদে৷ যদিও হকিং কবে কোথায় এমন কথা বললেন এবং বেদের কোথায় তত্ত্বটি মিলবে, তা জিজ্ঞাসা করতেই মন্ত্রীমশাই চম্পট দিয়েছেন৷ হর্ষজি একা নন, তাঁর দলভুক্ত প্রধানমন্ত্রী গণেশের মাথায় প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন খুঁজে পান৷ আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকেই নস্যাৎ করে দিতে পারেন এ আসলে বিজেপি–আরএসএসের সুপরিকল্পিত চক্রান্ত৷ একদিকে ফান্ডের অভাবে ধুঁকতে থাকা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত অর্থ না দিয়ে বিজেপি সরকার চাপে রাখতে চাইছে, অন্যদিকে আরএসএস–বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উগ্র ধর্মীয় গোঁডা কূপমণ্ডুকতার পাঁকে জনগণকে ডুবিয়ে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে চলছে৷ এর মধ্য দিয়ে দেশে ফ্যাসিবাদী চিন্তার ধাঁচা কায়েম করতে চাইছে তারা৷ বহু দিন আগেই বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছিলেন, ‘‘ফ্যাসিবাদ হচ্ছে অধ্যাত্মবাদ, তমসাচ্ছন্ন ভাবনা–ধারণা এবং যুক্তিহীনতার সাথে কারিগরি বৈজ্ঞানিক বিদ্যার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ৷’’ (২৪ এপ্রিল, ১৯৭৪)৷ একদা এমনই বিজ্ঞান আর কুসংস্কারের মিশেল দেওয়ার প্রতিবাদ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘সত্যের সঙ্গে মিথ্যা এসে জুটেছে৷ খাঁটির সঙ্গে কলঙ্ক মিশে গেছে৷ …বিজ্ঞানের আহ্বান… সত্য আহ্বান, …চেষ্টার পর চেষ্টার সাধনার বলে বিজ্ঞানের রাজ্যে খাঁটি সত্যকে বাজিয়ে নিচ্ছে৷ …আর আমাদের ধর্ম নাকি প্রাণ … যত ধূলো, যত আবর্জনা সবই আমরা মাথা পেতে নিয়ে পূজা করতে বসে গিয়েছি৷ এই কি বাঁচবার সাধনা? এতে যদি কোনো জাতি বাঁচে, তবে জাতি মরে কিসে তা তো বলতে পারি নে’’(ধর্ম ও জড়তা)৷
আশার কথা আইএসিএসের মতো এমন একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে কায়েমি স্বার্থে কর্তৃপক্ষ ও সরকারের যৌথ মদতে এ ধরনের ধর্মীয় প্রথায় শিল্যান্যাস অনুষ্ঠান আয়োজনের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছেন এদেশের বহু বিজ্ঞানী৷ নবজাগরণের মহান মনীষীদের গৌরবোজ্জ্বল স্বপ্ণকে ভূলুন্ঠিত করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই আজ বিজ্ঞান ও সত্যের প্রতি মানুষ হিসাবে আমাদের কর্তব্য৷
(৭১ বর্ষ ৮ সংখ্যা ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)