‘‘দখলদারির ইতিহাস খুঁডে দেশকে অগ্নিগর্ভ করবেন না৷ একটি জাতির ইতিহাস কখনওই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাড়িয়ে অতীতের মধ্যে বন্দি করতে পারে না৷’’ বললেন সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারক জাস্টিস কে এম জোসেফ এবং জাস্টিস নাগরত্না৷
পুনঃনামকরণের মধ্য দিয়ে রাস্তা, প্রাচীন শহর, ধর্মীয় স্থানের হিন্দু ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশিকা চেয়ে বিজেপি নেতা অ্যাডভোকেট অশ্বিনী উপাধ্যায়ের আদালতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারক তাঁদের অভিমত স্পষ্ট করেন৷
বিজেপির আবেদনকারীর মতে পঞ্চদশ শতাব্দীর নিষ্ঠুর আক্রমণকারীদের হাতে দেশের সার্বভৌমত্ব, নাগরিক অধিকার, ঐক্য-সংহতি বিপন্ন হয়েছে৷ রামায়ণ, মহাভারত সময়কালের বহু নাম এই বিদেশি শাসনে পরিবর্তিত হয়ে গেছে৷ সুতরাং সেই প্রাচীন সংস্কৃতিকে সংরক্ষিত করতে হবে এবং ফিরিয়ে আনতে হবে৷ জাস্টিস নাগরত্না বলেন ‘‘হিন্দুত্ব কোনও ধর্ম নয়, হিন্দুত্ব জীবনধারণের একটি পথ৷ ভারতবর্ষ সকলকেই একীভূত করেছে সে আক্রমণকারী হোক আর বন্ধুই হোক৷ এই জন্যই আমরা সকলে একত্রে থাকতে পারছি৷ ব্রিটিশরাই ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি আমদানি করেছিল৷ যার ফলে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল৷ এখন এই ধরনের আবেদনের মধ্য দিয়ে আর নতুন করে বিভেদ তৈরি করবেন না৷’ জাস্টিস নাগরত্না বলেন ধর্ম নয়, দেশের কথা মাথায় রাখুন৷ মহাকবি শেক্সপিয়র বলেছিলেন ‘নামে কী বা আসে যায়’ শেক্সপিয়রের না এসে যেতে পারে, কিন্তু ভোটবাজ শাসকদের আসে যায় বই কী৷
২০২৪-এর আসন্ন নির্বাচনের আর এক বছরও বাকি নেই৷ অথচ মানুষের জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন– চাকরি, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, মূল্যবৃদ্ধি রোধ, দুর্নীতিহীন সরকার– এ সব কোনও কিছু নিয়ে সরকারের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই৷ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে হিন্দুত্ববাদে সুড়সুড়ি দিয়ে বিভেদের পরিবেশ সৃষ্টি করাই এখন ক্ষমতাসীন বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা৷ সেটাকেই পাখির চোখ করে দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থান, শহর, স্টেশন, জনপদের নাম বদলাতে উঠেপডে লেগেছেন দিল্লিশ্বররা৷ এই কাজে তারা দেশের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদসহ বিশিষ্টজনদের মতামতেরও বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেনি৷ তারই ধারাবাহিকতায় এলাহাবাদের নাম বদলে হয়েছে প্রয়াগরাজ, ঐতিহ্যবাহী মুঘলসরাই স্টেশনের নাম হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন এবং সম্প্রতি সেই তালিকায় নবতম সংযোজন হিসাবে রাষ্ট্রপতি ভবনের বিখ্যাত মুঘল গার্ডেনের নাম বদলে হয়েছে অমৃত উদ্যান৷ যাঁরা এই নাম বদল করেছেন, তাঁরা ভাল করেই জানেন যে, এই উদ্যানটি মুঘলরা তৈরি করেনি৷ মুঘল গার্ডেন হচ্ছে গার্ডেনিং-এর একটি বিশেষ ধারণা৷ বাগানটির নাম পাল্টে তারা সেটি চাপা দিতে চেয়েছে৷ ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মৌয়ের নাম বদলে লক্ষ্মণপুর করার উদ্যোগও ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে৷ মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ ও ওসমানাবাদের নামও পাল্টানো পাকা করেছেন মোদি সরকার৷ কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের নামকরণ হয়েছে হিন্দুত্ববাদী নেতা শ্যামাপ্রসাদের নামে৷
স্বাধীনতার ৭৫ বছরের গালভরা নামকরণ করা হয়েছে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব৷ অথচ সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলনকেই আরএসএস ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ তকমায় ভূষিত করেছিল এবং ব্রিটিশ রাজশক্তির পদলেহন করেছিল৷ প্রকৃতপক্ষে শহিদের আত্মবলিদানে অর্জিত রাজনৈতিক স্বাধীনতার ‘অমৃত’ ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর দেশীয় পুঁজিপতিরাই আত্মসাৎ করেছে৷ আজও বর্তমান শাসকেরা দেশীয় সম্পদকে ক্রমাগত আদানি, আম্বানিদের পকেটে তুলে দিয়ে জনসাধারণকে গরলের সমুদ্রে নিক্ষেপ করছেন, তারাই আবার রসিকতা করে ‘অমৃত মহোৎসব’ নামকরণ করেছে৷ কিন্তু ‘আতরআলি নাম দিলেই কি মুখের দুর্গন্ধ চাপা দেওয়া যায়?’
বিজেপির অ্যাডভোকেট মহাশয় তার আবেদননামায় আরও বলেছেন, লোধি, গজনি, ঘোরির নামে এখানে রাস্তা আছে৷ পাণ্ডবদের নামে কোনও রাস্তা নেই৷ অথচ ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করেছিলেন যুধিষ্ঠির৷’ ঐতিহাসিক চরিত্র ও পৌরাণিক চরিত্রের (কাল্পনিক চরিত্র) তুলনা টেনে, সত্য মিথ্যা মিশিয়ে যে ব্যঞ্জন দেশজুডে পরিবেশিত হচ্ছে, এখানে তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি৷ যদিও বিচারপতিরা কোনও বিভ্রান্তি রাখেননি৷ বিশেষ করে জাস্টিস নাগরত্না স্পষ্ট করে বলেছেন, একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করে আপনি গোটা দেশে আগুন লাগাতে চান? এই ধরনের মামলা করে সমাজকে বিভক্ত করার চেষ্টা করবেন না৷ ধর্ম নয়, মাথায় রাখুন দেশের কথা৷
আসলে বিষয়টি নতুন কিছু নয়৷ হিন্দুত্ববাদী বিজেপি পরিকল্পিতভাবেই প্রচার করে যে মুঘলরা বিদেশি, আক্রমণকারী৷ তাই মুঘলদের সব স্মারক, ভারতে মুসলিম সংস্কৃতির সব চিহ্ণ মুছে ফেলার মধ্যেই তাদের হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল করতে চাইছে৷
সেই বিজয় রথের সামনে প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতির মূল্যবান মসজিদ, স্থাপত্য স্মৃতিসৌধ যা-ই থাকুক, তার ঐতিহাসিক মূল্য যা-ই হোক তাকে মাটিতে মিশিয়েই তাদের বিজয় সম্পন্ন হবে, এই তালিবানি চিন্তাই তাদের চালিকাশক্তি৷
২০২৪ নির্বাচন যত কাছে আসছে, এক ঢিলে দুই পাখি মারার বিভাজন, মেরুকরণ নীতি তত গতি পাচ্ছে৷ জালিয়ানওয়ালাবাগের ডায়ারের গুলিচালনার বিরুদ্ধে দেশজুডে ধরনা, প্রতিবাদ সভা থেকে তদানীন্তন পাঞ্জাব হিন্দু মহাসভা নিজেদের প্রতিবাদ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে ঘোষণা করেছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন আমাদের কাছে আশীর্বাদ৷ ইতিহাসের সেই লজ্জা মোছার কোনও দায় তাদের নেই৷ কারণ লজ্জাই তো নেই