কোনও রাখঢাক না করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হল নাগরিক সমাজই কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের প্রধান শত্রু। সরকারের যুদ্ধটা এখন তাদের বিরুদ্ধেই– স্পষ্ট বললেনকেন্দ্রীয় সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।
দেশের মানুষ জানে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সাথে ভারতে যে ব্যক্তিটি এখন একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন তাঁর নাম অজিত ডোভাল। তিনি যখন বলে দিয়েছেন, বুঝতে হবে এটাই আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মন কি বাত’।
১১ নভেম্বর হায়দরাবাদে জাতীয় পুলিশ অ্যাকাডেমির ‘পাসিং আউট প্যারেডে’ সদ্য পাশ করা আইপিএসদের কর্তব্য নির্ধারণ করে এই বার্তাই দিয়ে এসেছেন ডোভাল। বলেছেন, নাগরিক সমাজই সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তি ও বিকৃতির শিকার হয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়। জাতীয় স্বার্থ কোনগুলো তিনি অবশ্য তা খোলসা করে বলেননি। গত অক্টোবরে এক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, কিছু লোক মানবাধিকারের কথা তুলে দেশের ভাবমূর্তিতে কালি ছেটাচ্ছে। তিনি গত ফেব্রুয়ারি মাসে আইনজীবী, কৃষক, ছাত্র সকল স্তরের আন্দোলনকারীদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলে কটাক্ষ করেছেন। বিজেপি নেতারা কৃষক আন্দোলনকারীদের আখ্যা দিয়েছিলেন ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী’ ইত্যাদি। গত কয়েক বছর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে চলেছেন, মানবাধিকার সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবীরা (যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন) বিদেশের টাকায় চলছেন। কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে পরিবেশ কর্মী, সমাজকর্মী, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা দিল্লি পুলিশ এবং অন্যান্য রাজ্যের বিজেপি সরকার। বোঝা যাচ্ছে নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাঁর উপদেশের ঝুলি এইসব মণি-মুক্তোতেই ভরেছেন এবং এক পা এগিয়ে নাগরিককেই শত্রু হিসাবে দেগে দিয়েছেন।
নাগরিক সমাজ বলতে সাধারণ ভাবে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজকর্মী, পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানীদের, অর্থাৎ সমাজের চিন্তাশীল অংশটিকে বোঝানো হয়। কংগ্রেসের মনমোহন সিং সরকারের আমলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দিল্লিতে আন্না হাজারের আন্দোলনে এই অংশের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের জমি রক্ষার আন্দোলনের সময় প্রতিবাদী কৃষকদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল সমাজের এই অংশটি। বিজেপি ঘনিষ্ঠ ধর্মোন্মাদদের হাতে প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যা ও গো-রক্ষার নামে সংঘবদ্ধ নরহত্যার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে খেতাব এবং পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছিল শিল্পী-সাহিত্যিকদের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। বিজেপি সরকারের আনা সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারা ভারতের সবচেয়ে অগ্রণী শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানীরা রুখে দাঁড়ানোর কথা জানিয়ে দিয়েছেন। দেশের শিক্ষিত, সচেতন এই অংশটি যাঁরা বিজেপির সাম্প্রদায়িক, স্বৈরাচারী, জনস্বার্থবিরোধী রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁদেরই দেশের শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দিচ্ছে বিজেপি সরকার।
দেখা যাচ্ছে, বিজেপির এই বিষাক্ত রাজনীতি মানতে রাজি নয় গোটা দেশের সাধারণ মানুষ। সিএএ বিরোধী আন্দোলন, দিল্লি সীমান্তের কৃষক আন্দোলন প্রমাণ করেছে, ‘নাগরিক সমাজ’-এর সংজ্ঞা এখন আর জনসাধারণের একটি অংশে সীমাবদ্ধ নেই। আন্দোলনকারীদের ঐক্যবদ্ধ সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রাম ও তার প্রতি প্রবল জনসমর্থন বুঝিয়ে দিয়েছে, গোটা দেশের সমগ্র প্রতিবাদী জনতাই আজ ‘নাগরিক সমাজ’। শাহিনবাগ কিংবা দিল্লির কৃষক আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে ভোটসর্বস্ব বড় দলগুলির সাহায্য ছাড়াও সচেতন সংঘবদ্ধ নাগরিকরা একটা চরম উদ্ধত সরকারেরও মাথা কী ভাবে নত করে দিতে পারে। বিজেপি সরকারের আতঙ্ক এখানেই। কারণ, এই সরকারের কাছে সম্প্রীতি নয়, সাম্প্রদায়িক বিভাজনই জাতীয় স্বার্থ। কোটি কোটি শ্রমজীবীর স্বার্থ তাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ নয়, মুষ্টিমেয় মালিকের স্বার্থই বিজেপি নেতাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ। সেই কারণেই কৃষি আইনের মতোই নতুন শ্রম আইন এনেছে তারা।
বিজেপি সরকারের আমলে দেশে কার্যত চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনআইএ) এই বাহিনীগুলিই যেন হয়ে উঠছে দেশের যে কোনও বিষয়ে কথা বলা এবং যথেচ্ছ ক্ষমতা ভোগ করার অধিকারী। সিবিআই, ইডি-র মতো তদন্তকারী সংস্থা সমস্ত নিরপেক্ষতা হারিয়ে শাসকদলের দপ্তরে পরিণত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে আজ সংসদের ভূমিকাও প্রায় নস্যাৎ করে দিচ্ছে এই সরকার। সরকার জানে এই স্বৈরাচার এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা যে আক্রমণ নামিয়ে আনছে তার বিরুদ্ধে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের শক্তি যুক্ত হলে প্রতিবাদের শক্তি বর্ধিত হবে বহুগুণ। সরকার এ-ও জানে বর্তমান তীব্র সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে যত একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা তাদের মুনাফাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে শোষণ আরও তীব্র করবে, তত সঙ্কটের অতল খাদের দিকে চলে যাবে দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি পুঁজির স্বার্থরক্ষায় আরও বেশি বেআব্রু হয়ে পড়বে। এবং ততই সাধারণ নাগরিকরা বেশি বেশি করে সংগ্রামে এগিয়ে আসবেন। এ বারের কৃষক আন্দোলনে দেখা গেছে, শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, কৃষকদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই যে সমস্যার আসল কারণ তা তাঁরা ধরতে শুরু করেছেন। পুঁজিপতিদের বিশ্বস্ত সেবাদাস হিসাবে বিজেপি সরকার তাতেই বেশি চিন্তিত। স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের মোকাবিলা রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে বড় সমস্যা নয়। কিন্তু তাতে চেতনার স্পর্শের সম্ভাবনাতেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার রক্ষকরা আতঙ্কিত। তাই তারা নাগরিক সমাজকেই এখন আক্রমণের মূল লক্ষে্য পরিণত করেছে।
এ জিনিস অতীতেও বারবার দেখা গেছে। কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে নাগরিক সংগঠনগুলোকে বিদেশি শক্তির মদত জোগানোর অভিযোগ করতেন। শাসকের গদিতে বসলে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণিকে রক্ষা করার তাগিদ এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, তথাকথিত বামপন্থী নেতা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও বলেছিলেন, ‘মানবাধিকার-ফানবাধিকার আমি বুঝে নেব’। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় পশ্চিমবঙ্গের অগ্রণী নাগরিক সমাজকে সিপিএম-ফ্রন্ট সরকারের প্রশাসন ও শাসকদল বারবার আক্রমণ করেছে। আজ তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদী নাগরিক সমাজকে দমাতে বারবার পুলিশকে ব্যবহার করেছে। আসলে, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকরা যতক্ষণ জনবিচ্ছিন্ন তথাকথিত বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন ততক্ষণ শাসকের অসুবিধা থাকে না। তাদের পুরস্কার দিয়ে, কর্পোরেট মাধ্যমের আনুকুল্য দিয়ে ভরিয়ে রাখেন তাঁরা। কিন্তু সাধারণ মানুষের লড়াই-আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালেই বুদ্ধিজীবীরা দেশের শত্রু বনে যান।
বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার গায়ে দিনে দিনে সার্বিকভাবে স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট চরিত্রলক্ষণ প্রকটভাবে ফুটে বেরোচ্ছে। শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির সেবাদাস হিসাবে শাসকদলগুলিও যে কোনও প্রতিবাদকেই গলা টিপে মারতে কোমর বেঁধে নামছে। শাসক বিজেপি একচেটিয়া পুঁজির সেবাদাস হিসাবে এই কাজ করে চলেছে। তাই সামগ্রিকভাবে সমস্ত সচেতন সংগ্রামী নাগরিকই আজ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সমস্ত স্তরের মানুষকে প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।