১৯১৭ সালের ৭-১৭ নভেম্বর পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় উদ্ভব ঘটেছিল এক নতুন সভ্যতার। এই নতুন সভ্যতার অভ্যুদয় নভেম্বর মাসে ঘটেছিল বলে ইতিহাসে তা নভেম্বর বিপ্লব নামে পরিচিত। আগামী ৭ নভেম্বর ১০৫তম নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী। এই বিপ্লব সামন্তীবাদের অবশেষ এবং পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে কায়েম করেছিল শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা ‘সমাজতন্ত্র’। সেই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, না এলে এ জন্মের তীর্থ দর্শন অসমাপ্ত থাকত। এই সমাজতন্ত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন আইনস্টাইন, বার্নাড শ, রমাঁ রলাঁ, চ্যাপলিন, শরৎচন্দ্র, নেতাজি, নজরুল সহ অসংখ্য মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। সমাজতন্ত্রের কী মহত্ত্ব দেখে তাঁরা আপ্লুত হয়েছিলেন? সমাজতন্ত্র কী দিয়েছিল রাশিয়াকে? এক কথায়, সমাজতন্ত্র মানুষকে দিয়েছিল সমস্ত রকমের শোষণ, বঞ্চনা, বন্ধন থেকে মুক্তির স্বাদ।
রাশিয়ায় জারের শাসনে যে সমস্ত সমস্যায় মানুষের জীবন ছিল জেরবার, সমাজতন্ত্র তা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে সমস্ত সমস্যায় মানুষের জীবন নিষ্পেষিত তা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ এই সমাজতন্ত্র সেই কারণে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদীরা তীব্র সমালোচনায় মুখর। শোষণের সওদাগরদের বিষোদগার সত্ত্বেও মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে সমাজতন্ত্রের আবেদন বিশ্বজনীন। এমনকী সমাজতন্ত্রের সাময়িক পরাজয় সত্ত্বেও এর অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক রূপরেখা জানলে এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ তৈরি হয় দুর্নিবার। কোথায় তার রহস্য?
সমাজতন্ত্র বেকারত্বের সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটিয়েছিল
ভারতের মতো পুঁজিবাদী দেশে চাকরি চাই, কাজ চাই, কাজের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই ইত্যাদি দাবিতে যুবকদের আন্দোলন করতে হয়, রাজপথে দিনের পর দিন ধরনা দিতে হয়। সরকার সেই আন্দোলনে লাঠি-গুলি চালিয়ে জবাব দেয়। এই পুঁজিবাদী সমাজে সরকার সকলের চাকরির ব্যবস্থা করা দূরের কথা, কাজের সাংবিধানিক অধিকারটুকুও দিতে রাজি নয়। চাকরির এই চূড়ান্ত সংকটের জন্যই যুবকদের একাংশ অন্যায়ভাবে কাজ পাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। অনৈতিক পথে তাদের যেতে হয়। সমাজতন্ত্রে এ সবের বালাই নেই। নভেম্বর বিপ্লবের পর সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সরকার ঘোষণা করেছিল, সবাইকে সাধ্যানুযায়ী কাজ করতে হবে এবং উপযুক্ত কাজ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কী ভাবে সমাজতন্ত্র এ কাজ সম্ভব করতে পেরেছিল? পেরেছিল উৎপাদন ব্যবস্থাকে মুনাফার চক্কর থেকে মুক্ত করে।
পুঁজিবাদে উৎপাদন হয় মানুষের প্রয়োজনকে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য। কিন্তু সমাজতন্ত্রে উৎপাদন হয় মানুষের বা সমাজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। সমাজের যে সামগ্রিক প্রয়োজন তা হিসাব করে পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন করা হয় এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জিনিসপত্রের দাম ধার্য করা হয়। সমাজতন্ত্রে শ্রমিকের শ্রমের ফলে যে সম্পদ সৃষ্টি হয় তার একটা অংশ দেশের সামগ্রিক উন্নতি ও শিল্পোন্নয়নে নিয়োগ করা হয়। বাকি সবটাই মজুরের প্রাপ্য হিসাবে ফিরে আসে। এতে মজুরের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। তাকে ভিত্তি করে ক্রমাগত শিল্পায়ন হয়। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সে মুনাফা করতে গিয়ে শিল্পায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
পুঁজিপতিরা কী ভাবে মুনাফা করে? নভেম্বর বিপ্লবের রূপকার মহান লেনিন ‘গ্রামের গরিবদের প্রতি’ আলোচনায় দেখান– উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফা আসে মূলত চারটি উপায়ে, (১) কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে, (২) উন্নত যন্তে্রর সাহায্যে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে, (৩) কাজের সময় বাড়িয়ে, (৪) মজুরির পরিমাণ কমিয়ে। কিন্তু অর্থনীতিতে এর ফল কী বর্তায়? এর ফলে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন ঘটে, বাজারে মন্দা দেখা দেয়, শিল্পায়নের গতি শ্লথ হয়, বেকারত্ব বাড়ে, শ্রমিক ছাঁটাই হয়। এগুলি পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিবার্য পরিণাম। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে এসব জিনিস থাকে না।
সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে বেতন নির্ধারণে অংশ নিত শ্রমিকরা
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কেউ কি কল্পনা করতে পারেন বেতন নির্ধারণে শ্রমিকরা অংশ নেবেন? এখানে মালিকরা সর্বোচ্চ মুনাফা করতে যতটা কম বেতন দেওয়া যায় তারই চেষ্টা করে। ন্যায্য মজুরি পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা এখানে নেই। ভারতে মজুরি ব্যবস্থা তিন রকমের– (১) মিনিমাম ওয়েজ–যেটুকু না দিলে শ্রমিক তার পরিবার নিয়ে বাঁচতে পারে না, (২) ফেয়ার ওয়েজ– কোনও মতে বাঁচার মজুরি, (৩) লিভিং ওয়েজ অর্থাৎ বাঁচার মতো মজুরি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এটুকুও মালিকরা ঠিকমতো দেয় না।
সমাজতন্ত্রে মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন হয় না বলে, বেতন বঞ্চনার প্রশ্ন আসে না। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে কারখানা কর্তৃপক্ষের সাথে শ্রমিকদের আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হত বেতন কাঠামো। এই আলোচনায় শুধু শ্রমিক নেতারাই অংশগ্রহণ করতেন তা নয়, অংশগ্রহণ করতেন বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। নতুন যৌথ যুক্তি হলে, সেই সংক্রান্ত আলোচনায় শ্রমিকদের উপস্থিতি থাকত ৯৫-১০০ শতাংশ। পুজিবাদী ব্যবস্থায় এই সুযোগ বা অধিকার স্বপ্নাতীত। সমাজতন্ত্র এটা পারে, কারণ এখানে উৎপাদনের উদ্দেশ্য কোনও মালিকের মুনাফা নয়, সমাজের কল্যাণ। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও পরিচালিত হয় শ্রমিক স্বার্থে।
সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে নর-নারীর বেতনের কোনও বৈষম্য ছিল না
১৯২৮ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে একজন শ্রমিকের গড় পড়তা মজুরি ছিল বছরে ৯৯১ রুবল। পাঁচ বছরের মধ্যে ১৯৩৩ সাল নাগাদ মজুরি বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৪৪৭ রুবল। অর্থাৎ মজুরি বৃদ্ধি প্রায় ২৪৮ শতাংশ। সরাসরি মজুরি হিসাবে এই আয় ছাড়াও শ্রমিকরা নানা ধরনের সুবিধা পেতেন, যাকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে বলা হয় সামাজিক মজুরি। এই সামাজিক মজুরি বলতে বোঝায় শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহণ, খাদ্যের সুযোগ-সুবিধা, অল্প ভাড়ায় বাসস্থানের ব্যবস্থা, বিনামূল্যে জ্বালানি, জল, বিদ্যুৎ, কাজের বিশেষ পোশাক। পুঁজিবাদী সমাজে সমকাজে সমমজুরি বহুক্ষেত্রে দেওয়া হয় না। একই পরিমাণ কাজ করলেও মহিলাদের এখানে কম বেতন দেওয়া হয়। এখানে স্থায়ীকর্মী, অস্থায়ী কর্মী–এ জাতীয় নানা ভাগ। অস্থায়ী কর্মীরা বেশি কাজ করেও বহুক্ষেত্রে কম বেতন পেয়ে থাকে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে নর-নারীর বেতনের কোনও বৈষম্য ছিল না। এত আর্থিক সুবিধা যখন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে শ্রমিকরা ভোগ করতেন, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শ্রমিকদের মজুরির অবস্থাটা কী ছিল? ১৯২৮ সাল নাগাদ আমেরিকাতে শ্রমিকদের গড় বেতন কমে গিয়েছিল ৩৫ শতাংশ। জার্মানিতে কমে গিয়েছিল ৫০ শতাংশ।
শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা কমিয়েছিল সমাজতন্ত্র
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিকের মুনাফা বাড়ানোর জন্য কাজের ঘণ্টা বাড়ানো হয়। পাশাপাশি কমানো হয় শ্রমিকদের বেতন। সমাজতন্ত্রে ঘটে এর উল্টো। কারণ সেখানে মুনাফা নেই। এখানে শ্রমিকের বেতন বাড়ে, কমে শ্রমিকদের কাজের সময়। ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে মে দিবসের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের এই দাবি কার্যকর করল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া। বিপ্লবের পরেই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় দৈনিক কাজের সময় নির্ধারিত হল ৮ ঘণ্টা। তারপর ধীরে ধীরে শ্রম সময় আরও কমানো হয়। বিপ্লবের দশ বছরের মধ্যেই শ্রমসময় কমিয়ে করা হয় ৭ ঘণ্টা। বিপ্লবের ২০ বছরের মধ্যে শ্রম সময় আরও কমিয়ে করা হয় ৫ ঘণ্টা। ফলে সারাদিনে কারখানায় শিফটের সংখ্যা বেড়ে গেল। কর্মসংস্থানও বেড়ে গেল। শ্রমিকরা অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ পেল।
সমাজতন্ত্রে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার সুরক্ষিত ছিল
বর্তমানে বহু পুঁজিবাদী দেশে শ্রমিকের সংগঠন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ভারতে এখন মোদি সরকার কুখ্যাত ‘লেবার কোড’ এনে শ্রমিকের ধর্মঘট করার, সংগঠন করার অধিকার সঙ্কুচিত করছে। এ সবই করা হচ্ছে শ্রমিক শোষণ নির্ঝঞ্ঝাটে চালিয়ে যাওয়ার জন্য। রাশিয়ায় জারের আমলেও শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার ছিল না। কিন্তু সমাজতন্ত্রে শ্রমিকরাই উৎপাদনের মূল কেন্দ্র হিসাবে বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে শ্রমিকদের সংগঠন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। শ্রমিক সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল ট্রেড ইউনিয়নের। কারখানার পরিচালকমণ্ডলীর কোনও শ্রমিককে শাস্তি দেওয়ার অধিকার ছিল না। এমন সর্বব্যাপক অধিকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কেউ কল্পনাও করতে পারে না।
সমাজতন্ত্র বাস্তবেই শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করেছিল
পুঁজিবাদী দেশেও শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অভাবগ্রস্ত পরিবারে একটু খাবারের সংস্থানের জন্য বহু শিশুকে মজুরের কাজে নিযুক্ত হতে হয়। মালিকরাও এদের নিয়োগ করে কম বেতনে কাজ করিয়ে বেশি মুনাফা করার জন্য। সব পুঁজিবাদী দেশেই এটা কমবেশি হয়ে থাকে। ফলে ‘শিশু শ্রম নিষিদ্ধ’–পুঁজিবাদে এই ঘোষণাটুকুই সার। তার বাস্তব প্রয়োগ নেই। কিন্তু সমাজতন্ত্রে শিশুর খাওয়া-পরা, শিক্ষা, চিকিৎসা, এক কথায় বেঁচে থাকার গ্যারান্টি দিত সমাজতান্ত্রিক সরকার। সমাজতন্ত্র যে পুঁজিবাদ থেকে অনেক উন্নততর সমাজব্যবস্থা–এটা শুধু কথার কথা নয়, বাস্তব।
উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে সমাজতন্ত্রে শ্রমিক ছাঁটাই হয় না
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মালিকরা কম শ্রমিক দিয়ে বেশি উৎপাদন করে। ফলে শ্রমিক অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। শ্রমিক ছাঁটাই হয়। সমাজতন্ত্রেও উৎপাদনের প্রাচুর্যের জন্য দরকার হয় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। কিন্তু এখানে মুনাফার বিষয়টি যুক্ত নয় বলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বাধ্যতা আসে না। সমাজতন্ত্রে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু উৎপাদনই বাড়ায় না, শ্রমিককেও শ্রমভার থেকে মুক্তি দেয়। উন্নত প্রযুক্তি শ্রমিকের কাছে আশীর্বাদ হিসাবে আসে। দুই বিপরীত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহারের উদ্দেশ্যের ভিন্নতার জন্য দু’রকম ফল দেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যন্ত্রের ব্যবহার শ্রমিককে করে কর্মহারা। সমাজতন্ত্রে এই যন্ত্রণা নেই।
সমাজতন্ত্র নারীমুক্তির দরজা খুলে দিয়েছিল
বিপ্লব পূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের ১০ শতাংশ মানুষ ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। মোল্লাতন্ত্রের নিদান অনুযায়ী মেয়েদের মানুষ বলেই মনে করা হত না। বোরখা পরিহিতা এই সব নারীরা ছিল তাদের স্বামীর কাছে কেনা পণ্যের মতো। স্বামী মারা গেলে স্ত্রীরা স্বামীর নিকটতম আত্মীয়ের সম্পত্তিতে পরিণত হত। তৈজসপত্রের মতো তাকেও বিক্রি করে দেওয়া যেত। খ্রিস্টান পরিবারগুলোর অবস্থাও ছিল একই রকম। স্বামীর বিরুদ্ধে এই সব পরিবারের মেয়েদের কোনও আইনি অধিকার ছিল না। জার শাসিত রাশিয়ার আইনে বলা হত, ‘সমস্ত বিষয়েই নারীরা স্বামীকে মেনে চলতে বাধ্য। কোনও মতেই সে স্বামীর মতের বাইরে যেতে পারবে না।’ কোনও বিবাহিত নারীকে পাসপোর্ট দেওয়া হত না। স্বামীর সঙ্গ ছাড়া তাঁর বাইরে যাওয়ারও কোনও উপায় ছিল না। কর্মরত মহিলাদের ৭৫ শতাংশ ছিল নিরক্ষর। আর কৃষক রমণীদের মধ্যে সাক্ষরের সংখ্যা ছিল নামমাত্র। এই ছিল বিপ্লব পূর্ব রাশিয়ার সাধারণ নারীদের জীবনের বাস্তব চিত্র।
বিপ্লবের পর এই অবস্থার পরিবর্তনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি। বিপ্লবের এক বছর পর ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে মস্কোতে বসল প্রথম নিখিল শ্রমিক-কৃষক-নারী সম্মেলন। লেনিন বললেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই হতই না যদি অসংখ্য শ্রমজীবী নারী এতে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন না করতেন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রাথমিক কাজ হল নারীর অধিকারের উপর সমস্ত বাধা অবলুপ্ত করা।
মহান লেনিন নারীদের দৈনন্দিন জীবনের ঘরোয়া কাজ থেকে মুক্ত করে বৃহত্তর সামাজিক কর্মকাণ্ডের শরিক হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নারীদের একটা বিশাল সময় কেটে যায় শিশুদের পরিচর্যার জন্য। এই শিশুপালনের ভার থেকে নারীকে মুক্ত করা যাবে কী করে? এই প্রশ্নে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বিশাল ও ব্যাপক সামাজিক ব্যবস্থার আয়োজনের কথা চিন্তা করেছিল। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের চিন্তা ছিল এই রকম– শিশু মাতা-পিতার অত্যন্ত আদরের, এটা ঠিকই, কিন্তু একই সাথে শিশু সামাজিক সম্পদও বটে। শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক। শিশুর উন্নত পরিচর্যায় মাতা-পিতার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তেমনি সমাজের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে শিশুপরিচর্যার ক্ষেত্রে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র যে ব্যাপক আয়োজন করেছিল বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার।
কিন্তু যাদের পরিবার ছিল না, ঘর-বাড়ি, বাবা-মা, কিছুই ছিল না, পথেই যারা দিন কাটাত, পথেই যারা সবার অগোচরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করত সেই পথ শিশুদের জন্য কী ব্যবস্থা করেছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্র? এদের সম্পর্কে ইরিয়া স্কারিয়াতিনা লিখছেন, অনেক আগে আমি মস্কো ও লেনিনগ্রাদের রাস্তায় দেখেছি অস্থিচর্ম সার, ঢুলু ঢুলু চোখ, কৃষ বিদ্বেষভরা মুখ। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে ভিক্ষা করত। … কখনও কখনও রাতের বেলায় নিঃসঙ্গ পথিককে ছিনতাই করত …। মৃতপ্রায়, রোগগ্রস্ত, বিকৃত কিশোর-কিশোরীরা থাকত রাস্তার চারপাশে গাড়ি বারান্দায়। দিনের বেলায় ঘুমাত আর রাতে লোকচক্ষুর আড়াল থেকে বেরিয়ে আসত। পরিষ্কার মনে আছে, অনেক আগে মস্কো স্টেশনে শীতের রাতে একটু গরম হওয়ার জন্য এই ধরনের কিশোর-কিশোরীরা স্তূপাকৃতি হয়ে পড়ে আছে এ আমি দেখেছি। কী খারাপই না লাগত।
সোভিয়েত সরকার সিদ্ধান্ত নিল চিরকালের জন্য এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। বড় বড় স্টেশনে অভিযান চালিয়ে এদেরকে আনা হল। পথশিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা কমিউনগুলোতে ভর্তি করা হল। যারা অসুস্থ তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করে সুস্থ করার পর অন্যদের সাথে মেলামেশা করতে দেওয়া হল। প্রথম প্রথম শিশুরা বন্য প্রাণীর মতো মত্ত আচরণ করত। তারপর পরিবেশ তাদের প্রভাবিত করল। জীবনের নানা দিক সম্পর্কে তারা উৎসাহিত হল। খেলাধূলা, পড়াশোনা সম্পর্কে আকর্ষণ বোধ করল। তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হতে হতে তারা একেবারে স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হল। (চলবে)
One comment
Pingback: সমাজতন্ত্র যা দিতে পারে পুঁজিবাদ তা পারে না