দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজ-২ ব্লকের নোদাখালি মোড়ের চায়ের দোকানে বসে সেদিন এক তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীর হাসি আর বাধ মানে না– তাঁর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ডহারবারের সাংসদের ‘সন্ত্রাস বিহীন’ ভোটের বাণী খবরের কাগজে পড়ছিলেন তিনি। পাঁচ বছর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমার দিনে ডোঙাড়িয়া স্কুল মোড়ের এস ইউ সি আই (সি) অফিসে বন্দুকধারী মস্তানদের হামলা নিজের চোখে দেখেছেন তিনি। সে হামলা কার নির্দেশে হয়েছিল সে কথাও তাঁর অজানা নয়। ডায়মন্ডহারবারের এসডিও অফিসে এস ইউ সি আই (সি) সহ সমস্ত বিরোধী দলের মনোনয়ন জমা করতে তাঁর দলের মস্তানরা কী ভাবে কার নির্দেশে বাধা দিয়েছিল সে কথাও বেশ জমিয়ে পরিবেশন করছিলেন তিনি। এই এলাকায় দলের সাংসদের ইশারা ছাড়া যে কিছুই ঘটে না, সে কথাও তাঁর জানা। তাই ‘সন্ত্রাস বিহীন ভোটের’ স্বরূপটা কেমন, তা আন্দাজ করেই এই হাসি।
২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে কী ভাবে ‘বিরোধীশূন্য’ ভোট হয়েছিল তার সাক্ষী অবশ্য সারা পশ্চিমবঙ্গ। এ বছর আবার পঞ্চায়েত ভোট আসছে। মানুষের প্রশ্ন, এবার কি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে?
সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কোচবিহার থেকে তাঁর ‘নব জোয়ার যাত্রা’ শুরু করে ডাক দিয়েছেন, ‘সন্ত্রাস বিহীন’ ভোট করার জন্য দলের গ্রামীণ কর্মীদের নিজেদের প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। এমনকি বিরোধীদের প্রতিও তাঁর দক্ষিণ্যের হাত বাড়িয়ে বলেছেন– দরকার হলে তিনি নিজে ও দলের সভাপতি দাঁড়িয়ে থেকে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা করিয়ে দেবেন। শুনে যেন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ শাজাহান নাটকের জাহানারার মতো বলতে ইচ্ছা করে ‘চমৎকার, আবার বলি চমৎকার!’ তাঁর তত্ত্বাবধানে পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ঠিক করার জন্য নানা ব্লকে দলের আভ্যন্তরীণ ভোট চলছে।প্রতিটি জেলাতেই সেই ভোট এখন সাধারণ মানুষ তো বটেই পুলিশ-প্রশাসনেরও আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে। দলের প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলির সমর্থকরা নিজের গোষ্ঠীর প্রার্থীর টিকিট জোগাড়ের তাগিদে ব্যালট বাক্স ভেঙে, ব্যালট পেপার ছিঁড়ে একে অপরকে আক্রমণ করে তাণ্ডব জুড়ছেন। যা চলছে তাকে বলা যায় ভোট সন্ত্রাসের স্টেজ রিহার্সাল। নিজেদের গোষ্ঠী কোন্দলে সন্ত্রাসের মহড়া দিতে গিয়ে প্রাণহানি যাতে না হয় তা দেখতে প্রতি ব্লকেই পুলিশকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। দলীয় ভোট সামলাতে পুলিশ কেন, সে প্রশ্ন না হয় আপাতত তুলে রাখা গেল। রক্ত ঝরলেও প্রাণগুলো বাঁচুক, এ কামনা করে জনগণ অন্তত পুলিশের এটুকু অপব্যবহার মেনে না হয় নিলই!
২০১৮-তে গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় ‘রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে’ থেকে, ‘গুড় বাতাসা’ দিয়ে শুধু বীরভূমে নয়, জেলায় জেলায় কী ভাবে বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত তৈরি হয়েছে তা মানুষের স্মৃতি থেকে সহজে যাবার নয়। যা দেখে বহু তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকও বলেছেন, যে সব পঞ্চায়েতে এমনিতেই দল জিতত, সেখানেও এ ভাবে অন্য কাউকে মনোনয়ন জমা করতেই না দেওয়ার ফলে গ্রামে গ্রামে শাসকদলের সমর্থকদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ জমেছে, জনগণের থেকে শাসকদলের বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রবল তৃণমূল বিরোধী হাওয়া ওঠার অন্যতম কারণও এটা। সে দলের নেতৃত্ব এর শিক্ষা নিতে চান কি না তাঁরাই বলতে পারবেন। তবে ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে যাচ্ছে তাতে অনুমান করা যায় তৃণমূল কংগ্রেস তাদের পূর্বসূরি সিপিএম-কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের বিজেপির অনুসৃত পথকেই শিরোধার্য করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তাকে আরও জোরদার করেছে। কংগ্রেসের এই রূপ মানুষ দেখেছে স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সব নির্বাচনে, বিশেষত ১৯৭২-এর ভোটে। বিজেপি শুধু ত্রিপুরা মডেলে ভোট সন্ত্রাস এবং বিরোধীশূন্য ভোটের যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তাকে ছাপিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম আমলে পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধী কোনও দলের হয়ে ভোটে কেউ দাঁড়াতে পারে এমন সম্ভাবনা দেখা দিলেই সম্ভাব্য প্রার্থীর স্ত্রীর কাছে সাদা থান পৌঁছে যেত, গ্রামে গ্রামে হুমকি, বোমাবাজি, বাইক বাহিনীর দাপট কীভাবে বেড়ে যেত সে কথা সে দিনের সংবাদপত্রের পাতায় ধরা আছে। বামপন্থাকে বিসর্জন দিয়ে সিপিএম নেতারা গায়ের জোরকেই ভোট জোগাড়ের মূল হাতিয়ার করে ফেলেছিলেন। তাঁরাও আজকের তৃণমূল কংগ্রেসের সুরেই বলতেন ‘বিরোধীরা প্রার্থী না পেলে আমরা তো আর দাঁড় করিয়ে দিতে পারব না’। সে দিন শত শত বুথে সব বিরোধী দল মিলে শূন্য বা নামমাত্র ভোট আর সিপিএমের বাক্সে সব ভোট কোন ম্যাজিকে চলে যেত তা জনগণ ভোলেনি। শাসকদের ভাষ্যটা একই– আমরাই থাকব, আর কেউ দাঁড়াতেও পারবে না।
এখন রাজ্য জুড়ে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মানুষ সরব। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সরকারের কোনও চোখ রাঙানিতেই দমন করা যাচ্ছে না। সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, নার্স, চিকিৎসকরা ন্যায্য ডিএ এবং স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে যে আন্দোলন করছেন তা সরকারের কাছে মাথাব্যথার কারণ। তাই রাজ্য সরকার তথা শাসকদলের নেতৃত্ব পঞ্চায়েত ভোট কবে হবে তা নিয়েই ধোঁয়াশা তৈরি করছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত নাকি এ ব্যাপারে অন্ধকারে। ‘নব জোয়ার যাত্রা’-র হিড়িক তুলে বেশ কিছুদিন নির্বাচনটাকে পিছিয়ে দেওয়া, আর ‘সন্ত্রাসবিহীন’ ভোটের ভড়ং করে মানুষের চোখ মূল বিষয়গুলি থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়াই তাদের দলের এই যাত্রার উদ্দেশ্য।
প্রতিবার পঞ্চায়েত ভোট এলেই মনোনয়ন পর্ব থেকে শুরু করে ভোটের ফল বার হওয়া পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে সন্ত্রাসের আবহ চলতে থাকে। বহু প্রাণ অকালে ঝরে যায়, বোমা-গুলিতে রক্ত ঝরে বহু সাধারণ মানুষের। কিন্তু পঞ্চায়েত দখলে শাসক এবং বিরোধী উভয় পক্ষের ভোটবাজ দলগুলোর এত তীব্র আকাঙক্ষা কেন? কেনই বা ভোটে রাজ্য বা কেন্দ্রের মসনদে থাকা দলের প্রার্থী হওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি, মারামারি? কোন সুবিধার আশায় ভোটে টিকিট পেতে নেতাদেরও ঘুষ দেওয়ার কথা শোনা যায়? ভোটের প্রচারে নেতারা জনসভায় বলেন, একটিবার সেবার সুযোগ দিন। ভোটের পর থেকে তাঁরা কেমন জনসেবা করেন তা সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে বোঝে। গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়েতে ক্ষমতাসীন পদাধিকারী এমনকি রাজ্য-কেন্দ্রের শাসক দলের ব্লক স্তরের নেতাদেরও যে সব প্রাসাদোপম অট্টালিকা দেখা যাচ্ছে তার উৎস কী? এখন না হয় পশ্চিমবঙ্গে মাঝে মাঝেই শত শত কোটি টাকার বান্ডিলের ছবি সংবাদমাধ্যমে ভেসে উঠছে। কিন্তু এই অট্টালিকাগুলো তো বেশ কিছু বছর ধরেই গ্রামাঞ্চলে মাথা তুলছে। পঞ্চায়েত বাবুরাই গ্রামে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠেছে সেই সিপিএম আমল থেকেই। বহু গ্রামেই এই বাবুদের খুশি না করে সাধারণ মানুষের পক্ষে গ্রামে টিকে থাকাই মুশকিল। যে কারণে পূর্বতন সিপিএম সরকারের আমলেও জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামে এক সিপিএম নেতার প্রাসাদ ভাঙার ছবি আন্দোলনের প্রতীক হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চায়েতের ক্ষমতা যে কত বড় সোনার খনির মালিকানা দেয় তার চিহ্ন এই সব প্রাসাদ।
পঞ্চায়েতের স্তরে স্তরে কাটমানি খাওয়ার অসংখ্য সুযোগ এই ব্যবস্থার মধ্যেই করা আছে। সম্প্রতি আবাস যোজনা নিয়ে হইচই ওঠায় এই কাটমানি এবং দুর্নীতির গভীরতাটা অনেকটা সামনে এসেছে। শুধু পঞ্চায়েতের জেতা প্রতিনিধিরা নয়, তাদের দলের ছোট বড় নেতাদেরও করে খাওয়া এবং নানা পথে রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেয় পঞ্চায়েতের ক্ষমতা।
শুধু দুর্নীতি এবং টাকা কামানো নয়, পঞ্চায়েত এখন গ্রামাঞ্চলের সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতারই উৎস। পঞ্চায়েতের ক্ষমতা হাতে থাকলে গরিব মানুষকে সুবিধার লোভ দেখিয়ে অথবা প্রাপ্য ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার ভয় দেখিয়ে তাদের ভোট কেনা যায়। সমস্ত পঞ্চায়েতেই তাই দেখা যায় গ্রামীণ কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূরা চেষ্টা করে রাজ্য অথবা কেন্দ্রের শাসকদলের সাথে না হলে অন্তত আগামী দিনে সরকারে আসতে পারে এমন তথাকথিত বড় দলের সাথে থাকতে। গ্রামীণ সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর পঞ্চায়েতে অতি ক্ষীণ। বেশিরভাগ পঞ্চায়েত আজ সাধারণ মানুষকে নেতাদের দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রত্যাশী করে রাখার বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এর জোরে যেমন দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, দলবাজি সবই করা যায়, একই সাথে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরকে গলাটিপে রুদ্ধ করার ক্ষমতাও হস্তগত হয়। আর্থিক এবং রাজনৈতিক লাভের ভাণ্ডার দখল করার জন্য পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখলে ভোটবাজ দলগুলোর মধ্যে যেমন হানাহানি চলে, তেমনই নিজের দলের মধ্যেও নিজের গোষ্ঠীর হাতে সব ক্ষমতা ধরে রাখতে খুনোখুনি-হানাহানির শেষ নেই। এ জন্যই বগটুইতে ঘর পোড়ে, বোমায় মানুষের প্রাণ যায়। নব জোয়ারের নামে এই পাঁককেই ঘুলিয়ে তুলেছেন তৃণমূল ককংগ্রেস নেতৃত্ব। তাই নতুন করে গোষ্ঠীদ্বন্দে্ব রক্ত ঝরছে, দলেরই দুই গোষ্ঠীতে মারামারি ব্যালট ছেঁড়াছেঁড়ি চলছে। এর সাথে যুক্ত দলদাস প্রশাসনের ভূমিকা। তারা শাসকদলের শত অন্যায় দেখেও পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো স্থবির হয়ে থাকে। প্রাথমিক পর্বে শুধু প্রার্থী ঠিক করা নিয়ে শাসকদলের নিজেদের গোষ্ঠীগত এই মারামারির ঘটনা দেখে সচেতন মানুষ বুঝবেনই– এ ভাবে যারা পঞ্চায়েতে শাসকদলের টিকিট জোগাড় করছে তারা জেতার জন্য মস্তান বাহিনীর পিছনে, পাড়ায় পাড়ায় মদ-মাদক বিতরণ করার কাজে, নানা অনৈতিক পথে ভোট জোগাড়ের ব্যাপারে অকাতরে খরচও করবে। জেতার পর সুদে আসলে তা উসুল করবে জনগণের ঘাড় ভেঙেই।
তাই শুধু ক্ষমতার সাথে থাকব, বড় দলের নেতা বলে যাদের ছবি কাগজ-টিভিতে দেখা যায় শুধু তাদের সঙ্গেই থাকব– গ্রামের মানুষ যদি এভাবে ভাবেন তাতে সর্বনাশ। পঞ্চায়েতেও সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরতে হলে সৎ লড়াকু প্রার্থী এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক সঠিক শক্তিকে চেনা চাই। করে খাওয়ার রাজনীতির বিপরীতে জনস্বার্থ নিয়ে কাজ করবে এমন সৎ, সাহসীব্যক্তিদের এগিয়ে এসে এই ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে আবার এই সব ভোটবাজ জনবিরোধী রাজনীতির কৌশলে মানুষ ঠকবে।