ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি–শত জন্মবার্ষিকী আগতপ্রায়৷ সেই উপলক্ষ্যে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য৷
(৭)
মানবপ্রেমিক বিদ্যাসাগর
বিদ্যাসাগর বিহারের কার্মাটারে একটি বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন৷ বিলাসিতায় জীবন কাটানোর জন্য নয়৷ হাঁপানিতে তাঁর খুব কষ্ট হত৷ কার্মাটারের জল–হাওয়া স্বাস্থ্যকর৷ তা ছাড়া সেখানে সরল সাঁওতালদের বাস৷ এই সব গরিব, সরল ও অবহেলিত শ্রেণির মানুষের সাহচর্য পাওয়ার জন্য তাঁর সেখানে যাওয়া৷ সাঁওতালরা সে যুগে সাধারণ মানুষের কাছে ছিল অস্পৃশ্য, অবহেলিত৷ বিদ্যাসাগরের কাছে এঁরা ছিলেন অত্যন্ত আপনজন৷ কলকাতা থেকে যাওয়ার সময় তিনি গরিব সাঁওতালদের জন্য নতুন জামাকাপড়, চিকিৎসার জন্য ওষুধ–পথ্যাদি ইত্যাদি নানা জিনিস নিয়ে যেতেন৷ সাঁওতালরা অসুস্থ হলে তিনি ওষুধ নিয়ে তাঁদের বাড়ি ছুটে যেতেন৷ নিজের হাতে ওষুধ খাওয়াতেন৷ গরিবদের খাবার বিলি করতেন৷
একবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী গিয়েছেন কার্মাটারে৷ দেখলেন, সকাল না হতেই একজন সাঁওতাল পাঁচ–ছটি ভুট্টা নিয়ে উপস্থিত৷ বলল– ‘ও বিদ্যেসাগর, আমার পাঁচগণ্ডা পয়সার দরকার৷ তুই আমার ভুট্টাগুলো নিয়ে পাঁচগণ্ডা পয়সা দে৷’
বিদ্যাসাগর পাঁচগণ্ডা পয়সা দিয়ে ভুট্টাগুলো তুলে রাখলেন৷ এরপর দলে দলে সাঁওতালরা আসছে৷ তাঁরা যা পয়সা চাইছে তাই দিয়ে বিদ্যাসাগর ভুট্টা কিনছেন৷
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন–‘এত ভুট্টা নিয়ে আপনি কী করবেন?’
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘দেখ না, কী হয়৷’
ভুট্টা কেনার বিরাম নেই৷ হরপ্রসাদ একটা কাজে একটু অন্য দিকে গিয়েছেন, ফিরে এসে দেখেন বিদ্যাসাগর নেই৷ কোথায় গেলেন চোখের পলকে?
খানিক পরে হরপ্রসাদ দেখলেন, একটা আলপথে বিদ্যাসাগর হন হন করে হেঁটে আসছেন৷ গা থেকে দর দর করে ঘাম পড়ছে৷ হাতে একটা পাথরের বাটি৷ হরপ্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলেন এভাবে৷’
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘ওরে, খানিক আগে একটা সাঁওতালী এসেছিল৷ সে বলল– ‘বিদ্যেসাগর আমার ছেলেটার নাক দিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, তুই এসে যদি বাঁচাস৷’ তাই আমি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এই বাটিতে করে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ আশ্চর্য দেখলাম এক ডোজ ওষুধে ছেলেটার রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল৷ এরা তো মেলা ওষুধ খায় না, অল্প ওষুধেই এদের উপকার হয়৷ কলকাতার লোকের ওষুধ খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়া গিয়েছে, মেলা ওষুধ না দিলে তাদের উপকার হয় না৷’
হরপ্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন– ‘আপনি কতদূর গিয়েছিলেন?’
বিদ্যাসাগর বললেন–‘ওই যে গাঁ–টা দেখা যাচ্ছে, মাইল দেড়েক হবে৷’
একটা সাঁওতাল ছেলের জন্য সকালবেলা পাথরের বাটিতে ওষুধ নিয়ে পায়ে হেঁটে এক কথায় এতটা পথ গিয়েছিলেন৷ এতটুকু ক্লান্তি নেই৷ বরং গরিব মানুষের কাজে লেগেছেন তাই মন আনন্দে ভরপুর৷ এদিকে সামনের উঠোন সাঁওতালে ভর্তি হয়ে গিয়েছে৷ বিদ্যাসাগরকে দেখে সকলে বলতে লাগল– ‘ও বিদ্যেসাগর, আমাদের খাবার দে৷’
সবাইকে আনন্দের সঙ্গে সেই ভুট্টাগুলো বিলি করলেন তিনি৷ ভুট্টা নিয়ে তারা চলে যেতে লাগল৷ বিদ্যাসাগর দাঁড়িয়ে তাদের দেখতে লাগলেন, মুখে তৃপ্তির হাসি৷ এইসব গরিবদের সেবা করে তাদের খাইয়ে বিদ্যাসাগর যে কত আনন্দ পেতেন তা তাঁকে না দেখলে তাঁর কথা না শুনলে বোঝা যায় না৷ এই সরল গরিব সাঁওতালরা তাঁকে প্রচণ্ড ভালবাসত, তিনিও এঁদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন৷
জীবনে অনেক টাকাই উপার্জন করেছেন তিনি৷ কিন্তু নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য খরচ করেছেন অত্যন্ত কম৷ তাঁর জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন– ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় লোককে দেওয়ার সময় ভাল কাপড়, ভাল খাবার, বাজারের বাছা বাছা জিনিস আনতেন, কিন্তু নিজের বেলায় সাধারণ ধুতি, মোটা চাদর, চটি জুতা, সামান্য আহার এই সকলেই সদা সন্তুষ্ট৷ তিনি সারা জীবনে যে অর্থ উপার্জন করেছেন অন্য কেউ হলে সে ব্যক্তি বাংলাদেশে ধনবান ব্যক্তি বলে লোকসমাজে গণ্য হতেন৷ কিন্তু তিনি নিজের উপার্জিত ধন দরিদ্রের সেবায় ব্যয় করে নিজে দরিদ্রের মতো জীবনযাপন করেছেন৷’
তাঁর চারপাশে কোনও মানুষ না খেয়ে থাকবে আর তিনি নিজে আরামে থাকবেন এ তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না৷
বর্ধমানের মহারাজের সাথে তাঁর আলাপ পরিচয়ের পর তাঁর জনহিতকর কাজের জন্য রাজা বীরসিংহ গ্রাম তাঁকে তালুক হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন৷ অন্য যে কোনও মানুষের কাছে এটি ছিল লোভনীয় উপহার৷ প্রজাদের খাজনার একটা বড় অংশ থেকে প্রচুর আয়ের সুযোগ ছিল৷ কিন্তু বিদ্যাসাগর তা নিতে রাজি হননি৷ বলেছেন–‘আমার যখন এমন অবস্থা হবে যে আমি নিজে সমস্ত প্রজার খাজনা দিতে পারব তখন আমি তালুক নেব৷’
জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি যখন হাঁপানিতে খুব অসুস্থ, কিছুতেই সেরে উঠছেন না, তখন কলকাতার বাসায় এক বন্ধু বললেন– ‘আপনি কার্মাটারে গেলে তো সুস্থ থাকেন৷ সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিন৷’
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিদ্যাসাগর বললেন– ‘সেখানে ভাল থাকি বটে৷ আমার যদি অতুল ঐশ্বর্য থাকত তা হলে সেখানে গিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম৷ আমার তো সে ক্ষমতা নেই৷ আমি সেখানে গিয়ে দিব্যি খাওয়া দাওয়া করব, আর আমার চারদিকে সাঁওতালরা না খেয়ে মরে যাবে, এ কি আমি সইতে পারি?’ আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন বিদ্যাসাগর৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের প্রতি তাঁর ছিল এমনই গভীর ভালবাসা৷ (চলবে)