ভারতীয় নবজাগরণ আন্দোলনের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী আগতপ্রায়৷ সেই উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য৷
(৩)
চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে সঙ্গে নিয়ে টাকা ধার করে তিনি একটি ছাপাখানা খোলেন৷ প্রেস থেকে তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই হিন্দি বৈতাল পচ্চিশির অনুবাদ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’৷ মার্শাল সাহেব ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য তিনশো টাকায় একশোটি ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ কিনে নিলেন৷ এ ছাড়া ছাপাখানা থেকে ১০০টি ‘অন্নদামঙ্গল’ বই ছেপে দেওয়ার জন্য ৬০০ টাকা আগাম দিয়ে দিলেন৷ ওই টাকায় ধার শোধ করেন তিনি৷ ছাপাখানার কাজ, বই লেখা, সাথে সাথে সামাজিক কু–প্রথার হাত থেকে অসহায় নারীদের মুক্ত করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি৷
১৮৪৯ সালের ১ মার্চ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষের পদ শূন্য হলে ওই পদে যোগ দেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনুরোধ করলেন মার্শাল সাহেব৷ মার্শাল সাহেবের অনুরোধে আবার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের চাকরি নিলেন তিনি৷
মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজের সাহিত্য–শ্রেণির অধ্যাপক ছিলেন৷ ১৮৫০ সালে তিনি জজ–পণ্ডিত হয়ে মুর্শিদাবাদে চলে গেলে ওই পদ শূন্য হয়৷ কাউন্সিল অব এডুকেশনের সেক্রেটারি ময়েট সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কে যোগ্য বিবেচনা করে ওই পদে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন৷
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে আবার আসতে রাজি ছিলেন না৷ তবু ময়েট সাহেবের অনুরোধ এড়াতে না পেরে বললেন, তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে তিনি সংস্কৃত কলেজে যোগ দিতে রাজি আছেন৷ ময়েট সাহেব কথা দিলেন৷ ঠিক হল, সংস্কৃত কলেজ সম্পর্কে বিদ্যাসাগর একটি রিপোর্ট দাখিল করবেন এবং সেটি তাঁরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন৷ শেষপর্যন্ত বিদ্যাসাগর ১৮৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর ৯০ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন৷ ১৬ ডিসেম্বর তিনি রিপোর্ট দাখিল করেন৷ সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি রসময় দত্ত বুঝলেন কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরকেই কলেজের দায়িত্ব দেবে৷ তাই ডিসেম্বরেই তিনি ইস্তফাপত্র দিয়ে দিলেন৷
১৮৫১ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে বিদ্যাসাগরকে অস্থায়ী সেক্রেটারি করা হল৷ ২২ জানুয়ারি তাঁকে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল করা হল৷ ১৫০ টাকা মাইনে৷ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নানা পরিকল্পনা ও পরিবর্তনে কলেজের ছাত্রসংখ্যা বেড়ে গেল৷ সন্তুষ্ট হলেন কর্তৃপক্ষ৷ নিজের পরিকল্পনা মতো শিক্ষানীতি প্রণয়নে অনেক স্বাধীনতা পেলেন৷ ১৮৫৪ সালে বিদ্যাসাগরের মাইনে বেড়ে ৩০০ টাকা হল৷
ওই বছরই বাংলার ছোটলাট হয়ে এলেন হ্যালিডে সাহেব৷ তিনি এ দেশে বাংলা বিদ্যালয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাহায্য চাইলেন৷ তাঁর ইচ্ছায় বিদ্যালয়গুলির সহকারি ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হলেন বিদ্যাসাগর৷ ১৮৫৫ সালের মে মাস থেকে এ কাজের জন্য তাঁকে ২০০ টাকা মাইনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল৷ বিদ্যালয় গড়ে তোলার সাথে সাথে শিক্ষাপ্রসারের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনায় হাত দিলেন তিনি৷
সে সময়ে সমাজে প্রচলিত ছিল বাল্যবিবাহ প্রথা, বহুবিবাহ প্রথা ও কৌলীন্য প্রথা৷ এই প্রথায় মেয়েরা যে দুঃখ ও যন্ত্রণা সহ্য করত তা দেখে বিদ্যাসাগর অত্যন্ত কষ্ট পেতেন৷ তিনি কু–প্রথার হাত থেকে অসহায় মেয়েদের রক্ষা করার জন্য এগুলি পরিবর্তন করার চেষ্টা শুরু করলেন৷
ইতিমধ্যেই শুরু করেছিলেন সামাজিক কু–প্রথা দূর করার কাজ৷ ১৮৫০ সালে ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন৷ ১৮৫৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর বহুবিবাহ নিরোধক আইন প্রণয়নের জন্য গভর্নমেন্টের কাছে আবেদন করেন৷ এ নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন তিনি৷ বাল্য বিধবাদের দুঃখ দেখে বিধবাবিবাহ আইন চালুর চেষ্টা করতে লাগলেন৷ এ ব্যাপারে আইন চালু করার জন্য একটি আবেদনপত্র লিখে নিজে বিশিষ্টজনদের কাছে ঘুরে ঘুরে এবং সমর্থকদের দিয়ে ৯৮৬ জনের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন৷ তাঁর পরিচিতদের অনেকে হিন্দুধর্মের সমর্থকদের বিরোধিতার ভয়ে বিধবা বিবাহকে সমর্থন করলেও আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করতে চাননি, তিনি তাঁদের বুঝিয়ে স্বমতে আনার চেষ্টা করেছেন, সাহস দিয়েছেন৷ তৎকালীন সমাজপতিরা চতুর্দিক থেকে বাধা ও আঘাতে তাঁর এই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে৷ মারাত্মক আক্রমণ, অপবাদ, নিন্দা, এমনকী শারীরিক আক্রমণের মধ্যেও তিনি ছিলেন অটল৷
তিনি সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম৷ এ জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই৷ এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যিক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরান্মুখ নহি৷ … আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব৷’’
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের হৃদয় ছিল একদিকে কুসুমের মতো কোমল, অন্যদিকে বজ্রের মতো কঠোর৷’ অসহায় নারীর দুঃখে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ত, আবার এদের রক্ষার জন্য কু–প্রথা দূর করার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা৷ কোনও বাধা বিপত্তিই তাঁকে থামাতে পারত না৷ তাই বহু বাধা–বিপত্তির মধ্যে বিধবাবিবাহ চালুর দাবিতে স্বাক্ষর করা আবেদনপত্র ভারত সরকারের কাছে পাঠালেন ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে৷
১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই ‘বিধবা বিবাহ আইন’ পাশ হয়ে গেল৷ এরপর অনেক বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেই উদ্যোগ আয়োজন করে বিধবা বিবাহ দেওয়ার অনুষ্ঠান করেন৷ যা ঠিক বলে মনে করতেন তিনি সে কাজ সমস্ত বাধা, আঘাত ও অপমান সহ্য করে শেষপর্যন্ত করতেন৷ কাউকে ভয়ে মাথা নত করতে বা অন্য রকম করতে দেখলে তিনি অত্যন্ত রেগে যেতেন৷
এ প্রসঙ্গে বহু ঘটনার মধ্যে একটির উল্লেখ করা যায়৷ রাজা রামমোহন রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র রমাপ্রসাদ রায় ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধুস্থানীয়৷ বিধবাবিবাহ আন্দোলনে প্রথমদিকে তিনি সমর্থন ও সাহায্য করেছিলেন৷ কিন্তু প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতে রাজি হননি৷ রমাপ্রসাদ রায় বলেছিলেন–‘আমি ভিতরে ভিতরে আছিই তো, সাহায্যও করিব, বিবাহস্থলে নাই গেলাম৷’ এ কথা শোনার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি৷ তারপর দেওয়ালে টাঙানো রামমোহন রায়ের ছবির দিকে লক্ষ করে বলেন, ‘ওটা দেওয়ালে রেখেছ কেন? ওটা ফেলে দাও, নামিয়ে রাখ’– এ কথা বলেই হন হন করে বেরিয়ে যান৷ এ রকমই তাঁর বন্ধুস্থানীয় কেউ কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াননি, তবু তিনি পিছিয়ে যাননি৷
শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগর
১৮৫১ সাল৷ বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ৷ কলেজের গেটে চিন্তিত মুখে পায়চারি করেছেন তিনি৷ কলেজ শুরুর ঘন্টা পড়ে গিয়েছে৷ অথচ অনেক শিক্ষক তখনও কলেজে আসেননি৷ প্রতিদিন এরকমই দেরি করে আসেন অনেকেই৷ সেদিন দেরি করে কলেজে ঢোকার সময় তাঁরা দেখলেন বিদ্যাসাগর গেটে পায়চারি করছেন৷ কাছাকাছি আসতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–‘এই এলেন বুঝি’?
ছোট্ট একটি জিজ্ঞাসা৷ এর বেশি কিছু বলতে পারেননি তিনি৷ অধিকাংশ শিক্ষক ছিলেন তাঁর গুরুমশায়৷ এই ছোট্ট জিজ্ঞাসার মধ্যে তাঁরা কিন্তু বুঝে নিলেন আর দেরি করে আসা চলবে না৷ ঠিক সময়ে সবাইকে আসতে হবে৷
কেউ কেউ একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন– এমন ঘুরিয়ে বলার কী দরকার বিদ্যাসাগর তো সরাসরি বলতে পারতেন৷
যাই বলুক না কেন ওই ছোট্ট জিজ্ঞাসার জন্যই সকলে ঠিক সময়ে আসা শুরু করলেন৷ অধ্যক্ষ হয়ে প্রথমেই সংস্কৃত কলেজে শৃঙ্খলা আনতে চাইলেন৷ ছাত্রদের ঠিক সময়ে আসার নির্দেশ দিলেন, অধ্যাপকদেরও কৌশলে বুঝিয়ে দিলেন কলেজে ঠিক সময়ে আসার গুরুত্ব৷ শৃঙ্খলা আনার সাথে সাথে পাঠ্যসূচির পরিবর্তনের কথাও বললেন৷ আগে সংস্কৃত কলেজ মূলত সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র ছিল৷ সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনও বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হত না৷ এমনকি বাংলা ভাষা শিক্ষার দিকেও বিশেষ নজর ছিল না৷ ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক ভাল করে না পড়ানোর ফলে সংস্কৃত কলেজের পাশ করা ছাত্রদের বিষয়বস্তুর উপলব্ধি, যথার্থ জ্ঞান যেমন অসম্পূর্ণ থাকত তেমনই চাকরি পাওয়ার অসুবিধা হত৷ যে সব ছাত্র ইংরেজি শিখতে চাইত তারা এখানে পড়তে আসত না৷ এ জন্য সংস্কৃত কলেজে পড়ার উৎসাহ না থাকায় এখানে ছাত্রসংখ্যা কমে যাচ্ছিল৷ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন করলেন৷
সংস্কৃত কলেজে তিনি ইংরেজিকে অবশ্যপাঠ্য করলেন৷ আগে গণিত শেখানো হত সংস্কৃত শ্লোকের মাধ্যমে৷ বিদ্যাসাগর বললেন–‘যে সংস্কৃত বই দুটির মাধ্যমে অঙ্ক শেখানো হয় তাতে সহজ বিষয় সরল করে না বলার জন্য ছাত্রদের শিখতে অনেক বেশি সময় লাগে৷ সংস্কৃতের বদলে ইংরেজির মাধ্যমে গণিত বিদ্যার শিক্ষা দিলে ছাত্ররা অর্ধেক সময়ে অনেক বেশি শিখতে পারবে৷ তাই ইংরেজির মাধ্যমে গণিত শিক্ষা চালু করলেন৷ সংস্কৃতের কঠিন পাঠগুলিকে অনেকটা সরল করলেন৷
পূর্বে সংস্কৃত কলেজে কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের পড়ার অধিকার ছিল৷ তিনি এই নিয়ম পরিবর্তন করে অন্যদেরও পড়ার সুযোগ করে দিলেন৷ অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথি ধরে সংস্কৃত কলেজে ছুটি দেওয়া হত৷ বিদ্যাসাগর ইউরোপীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি রবিবার ছুটির নিয়ম চালু করলেন৷
এই সব পরিবর্তনের ফলে সংস্কৃত কলেজে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে গেল৷ সেই সময়কার কয়েকজন পদস্থ ইংরেজ সাহেব তাঁর এইসব শিক্ষাপ্রসারের পরিপূরক পরিবর্তনের বিরোধিতা করলে তিনি কর্তৃপক্ষকে লিখলেন–‘আমার আবেদন হল, আমাদের সংস্কৃত শিক্ষা দিতে দিন প্রধানত বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য৷ তার সঙ্গে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান–বিজ্ঞান আয়ত্ত করার সুযোগ দিন৷’ তাঁর মতে ‘বাংলাদেশের শিক্ষার তত্ত্বাবধানের ভার যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করা৷’ ‘… সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের যদি ইংরেজি সাহিত্য ভালভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়, তা হলে তারাই একমাত্র সুসমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যের সুদক্ষ ও শক্তিশালী রচয়িতা হতে পারবে৷’ (চলবে)