Breaking News

নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর (২১) — রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্যাসাগর

নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷

 

(২১)

রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগর স্মরণসভায় রবীন্দ্রনাথ গভীর দুঃখের সাথে বলেছিলেন, ‘‘আক্ষেপ এই যে, বিদ্যাসাগরের বসওয়েল্[জেমস বসওয়েল (১৭৪০–’৯৫) ছিলেন ইংলন্ডের প্রখ্যাত লেখক ও জীবনীকাব] কেহ ছিল না, তাঁহার মনের তীক্ষ্ণতা সবলতা গভীরতা ও সহৃদয়তা তাঁহার বাক্যালাপের মধ্যে প্রতিদিন অজস্র বিকীর্ণ হইয়া গেছে, অদ্য সে আর উদ্ধার করিবার উপায় নাই৷ …সৌভাগ্যক্রমে বিদ্যাসাগরের মনুষ্যত্ব তাঁহার কাজের মধ্যে আপনার ছাপ রাখিয়া যাইবে, কিন্তু তাঁহার অসামান্য মনস্বিতা, যাহা তিনি অধিকাংশ সময়ে মুখের কথায় ছড়াইয়া দিয়াছেন, তাহা কেবল অপরিস্ফূট জনশ্রুতির মধ্যে অসম্পূর্ণ আকারে বিরাজ করিবে৷’’ বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরের অন্তঃতল দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, বিদ্যাসাগর চরিত্রের অপার বিশালতা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে সঞ্জীবিত হওয়া প্রয়োজন৷

শৈশবে বিদ্যাসাগরের লেখা ‘বর্ণপরিচয়’–তেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম কাব্যের ধ্বনি শুনেছিলেন৷ তা নিয়ে পরে যখন স্মৃতিচারণ করেছেন সে গদ্যও যেন এক কাব্যের রূপ লাভ করেছে৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘কেবল মনে পড়ে, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে৷’ তখন ‘কর খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি৷ সেদিন পড়িতেছি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে৷’ আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা৷’’

বিদ্যাসাগরের সাথে রবীন্দ্রনাথের একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৮৮২ সালে, বিদ্যাসাগরের কলকাতার বাড়িতে৷ একটি সাহিত্য–সমিতি (সারস্বত সমাজ) করার উদ্যোগ নিয়ে এবং সেই সমিতিতে বিদ্যাসাগরকে থাকতে বলার আবেদন নিয়ে তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন৷ বিদ্যাসাগর তাঁদের সব পরিকল্পনা শুনে বলেছিলেন, ‘‘ভাল উদ্যোগ৷ কিন্তু আমার অনুরোধ, হোমরাচোমরাদের এর মধ্যে রেখো না৷ ওতে কাজ পণ্ড হয়৷’’ ঘটনাচক্রে সত্যিসত্যিই সে সমিতি কিছুদিনের মধ্যে উঠে গিয়েছিল৷

আরেকবার, রবীন্দ্রনাথ তখন ম্যাকবেথ–এর কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করেছেন৷ তাঁর ইংরেজির গৃহশিক্ষক বললেন, ‘চলো, অনুবাদটা বিদ্যাসাগর মশাইকে দেখিয়ে আসা যাক৷’ শিক্ষক মহাশয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথ একদিন গেলেন বিদ্যাসাগরের কাছে৷ ‘জীবনস্মৃতি’–তে সেদিনের কথা স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ তাতে লিখেছেন, ‘‘তখন তাঁহার (বিদ্যাসাগরের) কাছে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বসিয়াছিলেন৷ পুস্তকে–ভরা তাঁহার ঘরের মধ্যে ঢুকিতে আমার বুক দুরুদুরু করিতেছিল৷ ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা আমি তো পাই নাই, অতয়েব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল৷ বোধ করি কিছু উৎসাহ সঞ্চয় করিয়া ফিরিয়াছিলাম৷’’ এই দু’বার ছাড়া বিদ্যাসাগরের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ সম্ভবত আর হয়নি৷ জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার তখন ব্রাহ্মধর্মের উপাসক৷ পরিবারের সদস্যদের উপর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবল প্রভাব৷

১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন৷ উল্লেখযোগ্য ভাবে, সে বছরই মে মাসে রবীন্দ্রনাথ ‘দেনাপাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’–এর মতো ছোটগল্প লিখে প্রকাশ করছেন৷ সমাজে নারী জীবনের উপর কত বড় নিপীড়ন চলছে রবীন্দ্রনাথ তা দেখাচ্ছেন কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়ে৷ বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ–সংবাদ আসার পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশ করা হল ‘‘বিদ্যাসাগর রচিত ‘আত্মজীবনচরিতের’ কয়েক পৃষ্ঠা’’ শীর্ষক লেখা৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘এই সংখ্যায় (কার্তিক, ১২৯৮) বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আত্মজীবনচরিতের কয়েক পৃষ্ঠা বাহির হইয়াছে৷ ইহাতে অলঙ্কারবাহুল্য বা আড়ম্বরের লেশমাত্র নাই৷ পূজনীয় লেখক মহাশয় সমগ্র গ্রন্থটি শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই বলিয়া মনে একান্ত আক্ষেপ জন্মে৷ এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ হইলে বাঙ্গালীদের পক্ষে শিক্ষার স্থল হইত৷’’ ১৮৯২ সালে ‘সাহিত্য’ পত্রিকাতেই প্রথম ছাপা হয় বিদ্যাসাগরের ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’৷ লেখাটি পড়ার সাথে সাথেই রবীন্দ্রনাথ ‘সাধনা’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘‘স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় রচিত এই প্রবন্ধটি পাঠ করিলে হৃদয় করুণারসে আর্দ্র না হইয়া থাকিতে পারে না৷’’

১৮৯৫ সালের ২৯ জুলাই কলকাতার বিডন স্ট্রিটে এমারেল্ড থিয়েটার (১৮৮৭–১৮৯৬) মঞ্চে বিদ্যাসাগর স্মরণে এক বিশাল সভা আয়োজন করা হয়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৩৪৷ তিনি ওই স্মরণসভায় এক প্রবন্ধপাঠের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মসাধনার বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং পরের মাসেই (ভাদ্র–কার্তিক ১৩০২) সেটি ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ এই আলোচনা থেকে সর্বপ্রথম যেটি বোঝা যায় সেটি হল, প্রচুর সময় দিয়ে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে অত্যন্ত বিশদে এবং খুঁটিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং সমগ্র আলোচনায় বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় চরিত্রের উপর বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছেন৷ বিদ্যাসাগরকে যত তিনি জেনেছেন ততই মুগ্ধবিস্ময়ে এবং শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হয়েছে তাঁর চেতনা ও মনন৷ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সেই সময় সাধারণের মধ্যে কিছুটা ভাসা–ভাসা ধারণা প্রচলিত ছিল,  মূলত তাঁর পাণ্ডিত্য ও পরোপকার নিয়েই বেশি চর্চা হত৷ কিন্তু তার উৎস এবং তাৎপর্য কী, এ নিয়ে চর্চা হত কম৷ বিদ্যাসাগর–চরিত্রের্ গভীরতা প্রসঙ্গে অনন্যসাধারণ বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ওই প্রবন্ধের শেষ বাক্যে বলেছেন, ‘‘…দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব…৷’’

রবীন্দ্রনাথের এই ঐতিহাসিক মূল্যায়ন বিদ্যাসাগর–চর্চার ধারা–বদল ঘটিয়ে দিয়েছে৷ এই প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান, যে গুণে তিনি পল্লীআচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালিজীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া– হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে– করুণার অশ্রুজল উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, আমি যদি অদ্য তাঁহার সেই গুণকীর্তন করিতে বিরত হই তবে আমার কর্তব্য একেবারেই অসম্পন্ন থাকিয়া যায়৷ কারণ, বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারংবার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়োলোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি রীতিমতো হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে– তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন৷ বিদ্যাসাগরের জীবনীতে এই অনন্যসুলভ মনুষ্যত্বের প্রাচুর্যই সর্বোচ্চ গৌরবের বিষয়৷’’

বিদ্যাসাগর–চরিত্রের্ কতগুলি বিরল এবং অত্যন্ত শিক্ষণীয় দিক রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন, যেগুলি আমাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে উপলব্ধি করা দরকার৷ না হলে বিদ্যাসাগর–চর্চা সম্পূর্ণ হতে পারবে না৷ যেমন, (১) ‘‘বিদ্যাসাগরের গৌরব কেবলমাত্র তাঁহার প্রতিভার উপর নির্ভর করিতেছে না৷ প্রতিভা মানুষের সমস্তটা নহে, তাহা মানুষের একাংশ মাত্র৷ …চরিত্রের শ্রেষ্ঠতাই যে যথার্থ শ্রেষ্ঠতা, ভাবিয়া দেখিলে সে বিষয়ে কাহারও সংশয় থাকিতে পারে না৷ …এই চরিত্ররচনার প্রতিভা কোনো সাম্প্রদায়িক শাস্ত্র মানিয়া চলে না৷’’ (২) ‘‘যে অবস্থায় মানুষ নিজের নিকট নিজে প্রধান দয়ার পাত্র, সে অবস্থায় ঈশ্বরচন্দ্র অন্যকে দয়া করিয়াছেন৷ তাঁহার জীবনে প্রথম হইতে ইহাই দেখা যায় যে, তাঁহার চরিত্র সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে ক্রমাগতই যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করিয়াছে৷ …তাঁহার মতো দরিদ্রাবস্থার লোকের পক্ষে দান করা, দয়া করা বড় কঠিন, কিন্তু তিনি যখন যে অবস্থায় পড়িয়াছেন, নিজের কোনোপ্রকার অসচ্ছলতায় তাঁহাকে পরের উপকার হইতে বিরত করিতে পারে নাই৷’’ (৩) ‘‘আমাদের দেশে প্রায় অনেকেই নিজের এবং স্বদেশের মর্যাদা নষ্ট করিয়া ইংরাজের অনুগ্রহ লাভ করেন৷ কিন্তু বিদ্যাসাগর সাহেবের হস্ত হইতে শিরোপা লইবার জন্য কখনো মাথা নত করেন নাই৷ তিনি আমাদের দেশের ইংরাজপ্রসাদগর্বিত সাহেবানুজীবীদের মতো আত্মাবমাননার মূল্যে বিক্রীত সম্মান ক্রয় করিতে চেষ্টা করেন নাই৷’’ (৪) ‘‘বিদ্যাসাগরের দয়ায় কেবল যে বাঙালিজনসুলভ হৃদয়ের কোমলতা প্রকাশ পায় তাহা নহে৷ তাহাতে বাঙালি–দুর্লভ চরিত্রের বলশালিতারও পরিচয় পাওয়া যায়৷ তাঁহার দয়া কেবল একটা প্রবৃত্তির উত্তেজনামাত্র নহে, তাহার মধ্যে একটা সচেষ্ট আত্মশক্তির অচল কর্তৃত্ব সর্বদা বিরাজ করিত বলিয়াই তাহা এমন মহিমশালিনী৷ এ দয়া অন্যের কষ্টলাঘবের চেষ্টায় আপনাকে কঠিন কষ্টে ফেলিতে মুহূর্তকালের জন্য কুণ্ঠিত হইত না৷’’ (৫) ‘‘পরের উপকারকার্যে তিনি আপনার সমস্ত বল ও উৎসাহ প্রয়োগ করিতেন৷ ইহার মধ্যেও তাঁহার আজন্মকালের একটা জিদ প্রকাশ পাইত৷ সাধারণত আমাদের দয়ার মধ্যে এই জিদ না থাকাতে তাহা সংকীর্ণ ও স্বল্পফলপ্রসূ হইয়া বিশীর্ণ হইয়া যায়, তাহা পৌরুষমহত্ত্ব লাভ করে না৷’’ (৬) ‘‘আমাদের হৃদয় অত্যন্ত কোমল বলিয়া আমরা প্রচার করিয়া থাকি৷ কিন্তু আমরা কোনো ঝঞ্ঝাটে যাইতে চাহি না৷ এই অলস শান্তিপ্রিয়তা আমাদিগকে অনেক সময়েই স্বার্থপর নিষ্ঠুরতায় অবতীর্ণ করে৷ …আমরা অতি সহজেই ‘আহা উহু’ এবং অশ্রুপাত করিতে পারি, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে পরোপকারের পথে আমরা সহস্র স্বাভাবিক এবং কৃত্রিম বাধার দ্বারা পদে পদে প্রতিহত৷ বিদ্যাসাগরের কারুণ্য বলিষ্ঠ– পুরুষোচিত৷ এইজন্য তাহা সরল এবং নির্বিকার৷ তাহা কোথাও সূক্ষ্মতর্ক তুলিত না, নাসিকাকুঞ্চন করিত না, বসন তুলিয়া ধরিত না, একেবারে দ্রুতপদে, ঋজুরেখায়, নিঃশঙ্কে, নিঃসঙ্কোচে আপন কার্যে গিয়া প্রবৃত্ত হইত৷’’ (৭) ‘‘তাঁহার কারুণ্যের মধ্যে যে পৌরুষের লক্ষণ ছিল তাহার অনেক উদাহরণ দেখা যায়৷ আমাদের দেশে আমরা যাহাদিগকে ভালোমানুষ অমায়িক প্রকৃতি বলিয়া প্রশংসা করি, সাধারণত তাঁহাদের চক্ষুলজ্জা বেশি৷ অর্থাৎ, কর্তব্যস্থলে তাঁহারা কাহাকেও বেদনা দিতে পারেন না৷ বিদ্যাসাগরের দয়ায় সেই কাপুরুষতা ছিল না৷’’ (৮) ‘‘বিদ্যাসাগরের হৃদয়বৃত্তির মধ্যে যে বলিষ্ঠতা দেখা যায়, তাঁহার বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যেও তাহার পরিপূর্ণ প্রভাব প্রকাশ পায়৷ …আমাদের বুদ্ধি ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার মতো অতি সূক্ষ্ম তর্কের বাহাদুরিতে ছোটে ভালো, কিন্তু কর্মের পথে গাড়ি লইয়া চলে না৷ বিদ্যাসাগর যদিচ ব্রাহ্মণ, এবং ন্যায়শাস্ত্রও যথোচিত অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, তথাপি যাহাকে বলে কাণ্ডজ্ঞান সেটা তাঁহার যথেষ্ট ছিল৷’’ (৯) ‘‘আমরা সাধারণত প্রবল সাহেবি অথবা প্রচুর নবাবি দেখাইয়া সম্মানলাভের চেষ্টা করিয়া থাকি৷ কিন্তু আড়ম্বরের চাপল্য বিদ্যাসাগরের উন্নত–কঠোর আত্মসম্মানকে কখনো স্পর্শ করিতে পারিত না৷ ভূষণহীন সারল্যই তাঁহার রাজভূষণ ছিল৷’’ (১০) ‘‘আমাদের এই অপমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল আমরা বলিতে পারি না৷ কাকের বাসায় কোকিলে ডিম পাড়িয়া যায়– মানব–ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপনে কৌশলে বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন৷’’

রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন৷ তৎপূর্বে বাংলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন৷ ভাষা যে কেবল ভাবের একটা আধারমাত্র নহে, তাহার মধ্যে যেন–তেন–প্রকারেণ কতকগুলা বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্যসমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন৷ তিনি দেখাইয়াছিলেন যে যতটুকু বক্তব্য তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে৷… একটি অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোত রক্ষা করিয়া সৌম্য ও সরল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন৷’’ তিনি বলেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগরের দান বাংলা ভাষার প্রাণপদার্থের সঙ্গে চিরকালের মতো মিলে গেছে, কিছুই ব্যর্থ হয়নি৷’’

বিদ্যাসাগর–চরিত্রের অসাধারণত্ব রবীন্দ্রনাথকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছিল৷ তিনি তার উৎস খুঁজেছেন গভীর তন্ময়তার সাথে৷ ১৮৯৮ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আরও একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ৷ এই প্রবন্ধে তিনি বিদ্যাসাগরের চিন্তা–চেতনা এবং মননের উৎকর্ষ নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গোটা বিশ্বে বিদ্যাসাগরের উপমা নেই৷ অবারিত শ্রদ্ধা উৎসর্গ করে এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘আমাদের অপেক্ষা বিদ্যাসাগরের একটা জীবন অধিক ছিল৷ তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, তিনি দ্বিগুণ–জীবিত ছিলেন৷… সেইজন্য তাঁহার লক্ষ্য, তাঁহার আচরণ, তাঁহার কার্যপ্রণালী আমাদের মতো ছিল না৷ আমাদের সম্মুখে আছে আমাদের ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, ব্যক্তিগত লাভক্ষতি৷ তাঁহার সম্মুখেও অবশ্য সেগুলো ছিল– কিন্তু তাহার উপরেও ছিল তাঁহার অন্তর্জীবনের সুখদুঃখ, মনোজীবনের লাভক্ষতি৷ সেই সুখদুঃখ লাভক্ষতির নিকট বাহ্য সুখদুঃখ লাভক্ষতি কিছুই নহে৷’’

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরের অভূতপূর্ব চরিত্রের যথার্থ পরিচয় দেশের মানুষ জানুক, তার চর্চা করুক৷ ১৯২২ সালের ২ আগস্ট, কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বিদ্যাসাগর স্মরণসভা’য় সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ সেখানকার আলোচনাতেও তিনি বিদ্যাসাগরের যথার্থ চর্চার উপর গুরুত্ব দেন৷ সেই আলোচনা ওই মাসেই ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘বিদ্যাসাগর’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথ সেখানে বলেছেন, ‘প্রতি বছর বিদ্যাসাগরের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং বক্তারা তাঁর দানশীলতা নিয়ে কথা বলেন৷ কিন্তু তিনি তৎকালীন সমাজের রক্ষণশীলতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে লড়াই করেছিলেন সে বিষয়টা চাপা পড়ে থাকে৷ …বিদ্যাসাগর তাঁর সমকালীন সমাজের কাঠামোতে আঘাত করেছিলেন৷ সেইটিই তাঁর চরিত্রের সৌন্দর্য এবং এই কারণেই তিনি আধুনিক৷’

ঘটনাক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদ্যাসাগরের চিন্তার সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথ জীবনের নানা পর্বে প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছেন৷ আলোড়িত হয়েছে তাঁর দেশ–কাল ভাবনা, শিক্ষা ভাবনা, সমাজ ভাবনা৷ যে রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত সামাজিক প্রভাবে একসময় বাল্যবিবাহ, বর্ণপ্রথা ইত্যাদি দেশাচারের সমর্থক হয়ে পড়েছিলেন, সতীদাহ এবং নারীর চিরবৈধব্যকে প্রাচীন ভারতের গর্বের বিষয় বলে মনে করতেন, (সূত্র : ‘মাভৈঃ’ এবং ‘সমাজভেদ’ নিবন্ধ) সেই রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে এগুলি কাটিয়ে উঠেছেন৷ শিরোপা গ্রহণের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের আচরণে দেখা যায় বিদ্যাসাগরেরই ছায়া৷

বিদ্যাসাগরকে সরকার সিআইই দিতে চাইলে তিনি তা এড়াতে কিছু দিন কলকাতার বাইরে গিয়ে কাটিয়েছিলেন৷ পরে বাড়ি বয়ে সেই পদক দিতে এসে রাজকর্মচারীরা যখন বখশিস চেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘ওই স্বর্ণপদক বেনের দোকানে বেচে যা পাবে নিয়ে নাও৷’ আর, রবীন্দ্রনাথের হাতে যখন নোবেল প্রাপ্তির টেলিগ্রাম এল, তিনি শান্তিনিকেতনের সচিবের হাতে সেই টেলিগ্রাম দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই নিন, নেপালবাবু, আপনার নালা তৈরির খরচ৷’ ১৯৩৯ সালে মেদিনীপুরে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির’ উদ্বোধন করে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছিলেন ৭৮ বছরের রবীন্দ্রনাথ৷ নোবেলজয়ী বিশ্বকবি বলেছিলেন, ‘‘বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন তবে আমি যেন স্বীকার করি, একদা তার দ্বার উদঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷’’

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘ক্ষুধিত–পীড়িত অনাথ–সহায়দের জন্য আজ তিনি বর্তমান নাই৷ কিন্তু তাঁহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয়বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন, তাহার তলদেশ সমস্ত বাঙালিজাতির তীর্থস্থান হইয়াছে৷ আমরা সেইখানে আসিয়া আমাদের তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা, নিষ্ফল আড়ম্বর ভুলিয়া– সূক্ষ্মতম তর্কজাল এবং স্থূলতম জড়ত্ব বিচ্ছিন্ন করিয়া– সরল সবল অটল মাহাত্ম্যের শিক্ষা লাভ করিয়া যাইব৷’’  (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৯ সংখ্যা)