নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর (১৪) — নবজাগ্রত শিক্ষা ও বিদ্যাসাগর

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি–শত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷

(১৪)

নবজাগ্রত শিক্ষা ও বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, ধর্ম–বর্ণ–জাতপাতে নামে সমাজে চলতে থাকা বৈষম্য, অন্যায়–অত্যাচারের অন্ধকার দূর করতে হলে কুসংস্কারমুক্ত নবজাগ্রত আধুনিক শিক্ষার উজ্জ্বল আলো জ্বালতে হবে৷ এই কাজ করতে গিয়ে তিনি এ–ও বুঝেছিলেন, ধর্মশাস্ত্রের ব্যবসায়ী তথাকথিত পণ্ডিতদের শোধরানো একপ্রকার অসম্ভব৷ কিন্তু তাদের প্রভাব থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করা খুবই সম্ভব যদি তাদেরআধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায়৷ ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ আলোচনায় বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘‘বিদ্যা দ্বারা ধর্মাধর্মে ও সদসৎ কর্মে প্রবৃত্তি–নিবৃত্তি বিচার জন্মে এবং বিবেকশক্তির প্রাখর্য বৃদ্ধি হয়৷’’ এই কারণেই বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, আমার জীবন আমি ‘… জনসাধারণের সুশিক্ষালাভ এবং তাহাদের মধ্যে জ্ঞান বিস্তারের সুপবিত্র অনুষ্ঠানের সুপ্রতিষ্ঠায়’ নিয়োগ করব এবং ‘সেই ব্রত জীবনের শেষ দিনে আমার চিতাভস্মে উদযাপিত হইবে৷’ (শিক্ষা পরিষদের সম্পাদককে লেখা চিঠি)৷

বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন, তৎকালীন প্রচলিত শিক্ষায় ভারতের অধিকাংশ ছাত্র বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যবাদের নির্মম শিকারে পর্যবসিত হচ্ছে৷ যার ফলে, সমাজের ক্রমাগত অধঃপতন নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই৷ এই দুরবস্থার পরিবর্তে তারা যদি ন্যায়–ন্যায় বিচারবোধের অধিকারী হয়, সমাজকে উন্নত করার আকাঙক্ষায় উদ্বোধিত হয় তা হলে মানবজাতির কতই না অগ্রগতি সম্ভব৷ তাই বিদ্যাসাগর দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার নামমাত্র কিছু সংস্কার চাননি৷ তিনি চেয়েছিলেন এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন৷ স্বপ্ন দেখেছিলেন, এ দেশের ছাত্ররা শুধুমাত্র দেশীয় ধর্মীয়শাস্ত্রের বদলে ইউরোপীয় নবজাগরণ–সৃষ্ট পার্থিব মানবতাবাদী চিন্তা–চেতনার সাথে পরিচিত হবে৷ একমাত্র এর দ্বারাই তারা অন্ধতা–কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন চিন্তাশক্তি সম্পন্ন ও কর্মমুখী মানুষ হিসাবে বড় হয়ে উঠতে পারবে৷ এইখানেই বিদ্যাসাগরের বিশেষত্ব৷ বিদ্যাসাগরের অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ‘যেখানেই আধুনিক ইউরোপীয় জ্ঞানের আলো পৌঁছেছে এবং যতটুকু পৌঁছেছে, সেখানে ততটুকু এ দেশীয় শাস্ত্রীয় বিদ্যার প্রভাব কমছে৷ ফলে এই শিক্ষার প্রসার আরও বাড়াতে হবে৷’ সেজন্যই তিনি সংস্কৃত কলেজে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দর্শনের পাশাপাশি পাশ্চাত্য আধুনিক দর্শনও পড়াতে চেয়েছিলেন৷ এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দুই দর্শনেই সম্যক জ্ঞান থাকলে, এদেশের পণ্ডিতদের পক্ষে আমাদের দর্শনের ভ্রান্তি ও অসারতা কোথায় তা বোঝা সহজ হবে৷’’ (নোটস অন সংস্কৃত কলেজ)৷ তাই বিদ্যাসাগর জন স্টুয়ার্ট মিলের লজিক পড়াতে বললেন৷ মিল ছিলেন মূলত ‘ইমপিরিসিস্ট’ (অভিজ্ঞতাবাদী) এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী৷ তিনি মনে করতেন, পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ জ্ঞানের বাইরে অলৌকিক কিছু নেই৷ অন্য অনেক ইমপিরিসিস্ট ব্যক্তিগত ভোগসুখকেই জীবনের সার বলে মনে করেছিলেন৷ অন্য দিকে স্টুয়ার্ট মিল দর্শনের জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে ইমপিরিসিজমের সঙ্গে ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিক বোধের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন৷ সংসৃক্ত কলেজের ছাত্রদের মিল–এর লজিক পড়ানো এবং পাশ্চাত্যের অধ্যাত্মবাদী বিশপ বার্কলের দর্শন না পড়ানোর জন্য সুপারিশ করার মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগর নিজের চিন্তা ও ভাবধারার স্বতন্ত্র পরিচয় রেখেছেন৷ সংস্কৃত কলেজের গ্রন্থাগারের জন্যে যেসব বই কেনার সুপারিশ তিনি করেছিলেন তার মধ্যেও বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়৷ সে যুগের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাসবিদ গিজো–র বই যেমন নির্বাচন করেছিলেন তেমনই ইউক্লিডের জ্যামিতি, নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা, জনস্টন–এর নানা দেশের মানচিত্র, ফরাসি বিপ্লব ও ইংল্যান্ডের বিপ্লবের ইতিহাস প্রভৃতি গ্রন্থ রাখার সুপারিশ করেছিলেন৷

শাস্ত্রজ্ঞ এবং সংস্কৃতজ্ঞ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত গণিতগ্রন্থের পরিবর্তে আধুনিক ইংরেজি গণিত বই পড়ানোর সুপারিশ করেছিলেন শুধু নয়, সাহিত্যশ্রেণির ছাত্রদের জন্যও তিনি গণিতশিক্ষা আবশ্যিক করেছিলেন৷ কারণ, গণিত কেবল বিজ্ঞানের একটা বিষয় নয়৷ যে কোনও মানুষের চিন্তার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ যুক্তিবাদ ও চিন্তার শৃঙ্খলা গড়ে তোলার জন্য গণিত শিক্ষা অত্যাবশ্যক৷

ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী ধর্মশাস্ত্রগ্রন্থগুলি গভীর ভাবে পড়াশুনা করে এ কথা বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই সমস্ত গ্রন্থগুলি সমাজ সম্পর্কে, আধুনিক জীবনের সমস্যা সম্পর্কে, সমাজের সাথে ব্যক্তির যোগাযোগ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে সক্ষম নয়৷ সেগুলি সামাজিক সমস্যার উৎসে নজর দেয় না, তার পরিবর্তে দুঃখ–দারিদ্র–নিপীড়নকে মুখ বুজে মেনে নিতে বলে৷ সেগুলি বলে, অনাহার–অত্যাচার–অশান্তি ইত্যাদি চুপচাপ মেনে নিলে স্বর্গে গিয়ে অনন্ত শান্তি মিলবে৷ বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, ধর্ম ইহকালের সমস্যা সমাধান করতে না পেরে তাকে অদৃষ্ট পরকালে ঠেলে দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চায়৷ এই ধর্মীয় চিন্তা সমাজের অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই বিদ্যাসাগর কোনও দিন, কোনও অবস্থায় এক মুহূর্তের জন্যও ধর্মের আশ্রয় নেননি৷  

এই কারণেই, বিদ্যাসাগর যেভাবে শিক্ষার পাঠক্রম তৈরি করেছেন এবং যে ধরনের বিষয় অবলম্বন করে পাঠ্য বই রচনা করেছেন, তার মধ্যেও তাঁর আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়৷ ছেলেমেয়েদের পড়াবার জন্য ‘জীবনচরিত’ এবং ‘চরিতাবলী’ তিনি রচনা করেছেন৷ এখানে দেখা যায়, বিশেষত দু’ধরনের চরিত্র তিনি বেছে নিয়েছেন৷ প্রথমত কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিডটন প্রমুখ মহান বিজ্ঞানীর চরিত্র– যাঁরা ধর্মীয় ও চিরাচরিত ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ লড়াই চালিয়ে, মূলত বস্তুনিষ্ঠ যুক্তিবাদ তথা পরীক্ষ–নিরীক্ষা ভিত্তিক জ্ঞানচর্চা সহ সত্যানুসন্ধানের ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ দ্বিতীয়ত ডুবাল, রস্কো প্রভৃতি চরিত্র– যাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান৷ সহায় সম্বল বলতে কিছু না থাকা সত্ত্বেও যাঁরা কঠোর সংগ্রাম করে কেউ বড় দার্শনিক হয়েছেন, কেউ বড় শিক্ষাব্রতী, বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি হয়েছেন৷ এদের জীবনসংগ্রাম বিদ্যাসাগর বাংলায় সহজ–সরল গদ্যে লিখেছেন৷ ধর্মগুরুদের মতো দারিদ্রের মিথ্যা জয়গান গেয়ে নিপীড়িত দরিদ্র মানুষকে তিনি ভোলাতে চাননি, কারণ সেটা তাঁর নীতি ছিল না৷ ওই সব বড় চরিত্র কী ভাবে, কোন সামাজিক ঘাত–প্রতিঘাতে গড়ে উঠল সে কথাই তিনি বলতে চেয়েছেন৷ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখাতে চেয়েছেন, ‘তুমি যদি কিছু শিখতে চাও, যদি সমাজের স্বার্থে কাজ করে জীবনকে যথার্থ মর্যাদাময় অবস্থানে প্রতিষ্ঠা দিতে চাও, তাহলে তোমাকেও নানা বাধার বিরুদ্ধে ধৈর্য এবং সাহসের সাথে লড়তে হবে৷ লড়াই করেই, সেই বাধাগুলিকে অতিক্রম করেই এ–বিশ্বকে আরও সুন্দর করে যেতে হবে৷ বিদ্যাসাগর বলতে চেয়েছেন, অতিপ্রাকৃত কোনও শক্তির দ্বারা বা কপাল–লিখনের দ্বারা মানুষের জীবন নির্ধারিত হয় না৷ আর্থিক–সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লেও সচেতন এবং নিরলস সংগ্রাম সঠিক পথে পরিচালনা করে মানুষ বড় কাজ করতে পারে৷

বাস্তবে, বড় চরিত্র কঠিন–কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে৷ বিদ্যাসাগরের মানসিকতা ছিল– শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রবল উদ্যম–উৎসাহ–অনুপ্রেরণা আনতে হবে এবং প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার মতো শক্তিমান করে তুলতে হবে৷ তাই দৃষ্টান্তমূলক চরিত্রগুলি কী করে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছেন সেটাই তিনি দেখাতে চেয়েছেন৷ এগুলোকে তিনি শিক্ষার বিষয় করতে চেষ্টা করেছেন৷ জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্য বই, পাঠ্য বিষয়ের মধ্যেই তিনি কর্তব্যবোধ, দায়িত্ববোধ, চারিত্রিক উদারতা, কর্মনিষ্ঠা প্রভৃতি মানবিক গুণাবলির শিক্ষা দিতে চেয়েছেন৷

‘বোধোদয়’ গ্রন্থটি নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে৷ বোধোদয়ের প্রথম দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হতে দেখা গেল দুটিতেই ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও কথা নেই৷ এ নিয়ে ইউরোপীয় মিশনারিদের একটি অংশ প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন৷ জন মার্ডক নামে সরকার নিযুক্ত এক মিশনারি এ নিয়ে তদন্তে আসেন৷ তাঁর রিপোর্ট খুব তাৎপর্যপূর্ণ৷ তিনি রিপোর্টে বললেন, বিদ্যাসাগরের ‘বোধোদয়’ গ্রন্থটি ইংল্যান্ডে মেসার্স চেম্বার্স কর্তৃক প্রকাশিত ‘দ্য রুডিমেন্টস অফ নলেজ’ গ্রন্থকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে৷ কিন্তু মূল গ্রন্থে আলোচিত ‘ঈশ্বর’ ও ‘আত্মা’ সম্পর্কিত অংশ ‘বোধোদয়’ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ এই বইয়ে সেন্সেস বা ইন্দ্রিয়ানুভূতির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তার দ্বারা চরম বস্তুবাদ (রাঙ্ক মেটেরিয়ালিজম) শেখানো হবে৷ এই বই কেবল একজন নিরীশ্বরবাদীর (সেকুলারিস্ট) দ্বারা লিখিত তা নয়, এই বই প্রস্তুত করাই হয়েছে নিরীশ্বরবাদ শেখানোর জন্য৷ মার্ডক বলেছেন, বিদ্যাসাগরকে যে ‘হিন্দু সংস্কারক’ বলা হয়, তা ঠিক নয়৷ বিদ্যাসাগর কোনও হিন্দু ধর্মীয় আন্দোলনে নেই, ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনেও নেই, তিনি হচ্ছেন সমাজ–সংস্কারক৷ তিনি আরও বললেন, ইংল্যান্ডে রবার্ট ওয়েন, সেন্ট সাইমন যেমন সেকুলার, বিদ্যাসাগরও তাই৷ অতএব যত দ্রুত এই বই সুক্লের পাঠক্রম থেকে বাতিল করা যায়, ততই মঙ্গল৷ মার্ডকের এই রিপোর্ট পেয়ে সরকারি নির্দেশে বোধোদয়ের প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল৷ তখন বাধ্য হয়ে অনুরাগীদের পরামর্শে বিদ্যাসাগর তৃতীয় সংস্করণে ঈশ্বর–প্রসঙ্গ যুক্ত করেন৷ সে ক্ষেত্রেও প্রথমে পদার্থ সম্পর্কে আলোচনার পর ঈশ্বর সম্পর্কিত অনুচ্ছেদটি দ্বিতীয় স্থানে রাখেন৷ এভাবে কোনও রকমে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করলেন যাতে বইটি প্রকাশ হতে পারে৷

সব মিলিয়ে বাহান্নটি বই প্রকাশ করেছিলেন বিদ্যাসাগর৷ ১৭টি সংস্কৃতে৷ ৫টি ইংরেজিতে৷ বাকি ৩০টি বাংলায়, এর মধ্যে ১৪টি বিদ্যালয়ের পাঠ্য বই৷ এত কিছুর মধ্যে কোথাও ধর্ম বা ঈশ্বরতত্ত্বের কোনও বই নেই৷ লক্ষণীয়, প্রায় সমস্ত পাঠক্রম থেকে বিদ্যাসাগর সচেতনভাবে ধর্ম, জাতি বা বর্ণের প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন৷ এসব চিন্তাকে তিনি কোনও ভাবে আমল দিতেন না৷ সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার ছিল না৷ কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার সাথে সাথেই বিদ্যাসাগর কলেজের দরজা সকলের জন্য খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেন৷ আবার, যেহেতু তিনি ছিলেন একজন প্রখর বাস্তববোধ সম্পন্ন এবং কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, তাই এহেন উদ্যোগ নিয়ে বাড়াবাড়িও করেননি৷ তিনি বলেছেন, সম্পূর্ণ অবৈতনিক না হলে শিক্ষা সর্বজনীন হবে না৷ অথচ সরকারি ব্যয়বরাদ্দ অত্যন্ত স্বল্প৷ তিনি বলেছেন, সাধারণ মানুষ, বলতে যদি শ্রমজীবী মানুষ বোঝায়, তবে তাদের হতদরিদ্র অবস্থা সার্বজনীন শিক্ষাবিস্তারের পথে অন্যতম প্রধান বাধা৷ শ্রমজীবী মানুষ সন্তানের শিক্ষার জন্য এক কপর্দকও খরচ করতে সক্ষম নয়৷ তা ছাড়া ঘরের সন্তান শিশুশ্রমিক হিসাবে নগণ্য আয় করলেও শ্রমজীবী পরিবারের সেটুকুও না হলে চলে না৷ তা ছাড়া শিক্ষাকে সার্বজনীন করতে হলে চাই সমাজ মানসিকতা, উপযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষায়তন৷ এই পরিকাঠামো সেদিন ছিল না৷ তাই তিনি ধাপে ধাপে এগোবার পথ নিয়েছিলেন, যাতে বিরোধিতার ধাক্কায় উদ্যোগ শুরুতেই শেষ না হয়ে যায়৷

প্রকাশিত বইপত্রে ধর্ম–ঈশ্বর–পরকাল ইত্যাদি প্রসঙ্গেও কখনও কোনও উগ্রতা তাঁর মধ্যে প্রশ্রয় পায়নি৷ নানা জায়গায় ছোট ছোট গল্প–কাহিনিতে যেসব চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, প্রায় কোথাও তাদের কোনও পদবি ব্যবহার করেননি৷ কারণ, পদবির মধ্য দিয়ে জাতপাত–বর্ণ–গোত্রের পরিচয় প্রকাশ পায়, আর বিদ্যাসাগর সে–সব ভেদাভেদ কোনও ভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঢোকাতে চাননি৷ এমনকি পশুদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়েও সব জীবই ঈশ্বরের সৃষ্টি বলেননি৷ সচেতনভাবেই তিনি এগুলো বলেননি৷ ‘সীতার বনবাস’ লেখার সময়ও ভবভূতির উত্তররামচরিতের অলৌকিক অংশ সযত্নে বাদ দিয়েছেন তিনি৷ অবতার হিসেবে নয়, গুণবান মানুষ হিসাবেই রাম চরিত্রটিকে দেখিয়েছেন৷ এরকম আরও উদাহরণ দিয়ে এগুলি দেখানো যায়৷ এ সবই তাঁর সময়ের সুচিন্তিত বৈজ্ঞানিক মননশীলতার সুস্পষ্ট প্রতিফলন৷ (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১২ সংখ্যা)