নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর (১৩) — পার্থিব মানবতাবাদী বিদ্যাসাগর

নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি–শত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷

(১৩)

পার্থিব মানবতাবাদী বিদ্যাসাগর

‘একদিন সকালে উঠিয়াই শুনি মেয়েমহলে খুব শোরগোল উঠিয়াছে, ওমা, এমন তো কখনো শুনিনি, বামুনের ছেলে অমৃতলাল মিত্তিরের পাত থেকে রুই মাছের মুড়োটা কেড়ে খেয়েছে! কেউ বলিল, ঘোর কলি! কেউ বলিল, সব একাকার হয়ে যাবে! কেউ বলিল, জাতজন্ম আর থাকবে না৷ আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কে কেড়ে খেয়েছে? মা বললেন, জানিসনি? বিদ্যাসাগর৷’– লিখেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

জাত–ধর্ম–ছোঁয়াছুঁয়ি কিছুই মানতেন না বিদ্যাসাগর৷ তাঁর কাছে ব্রাহ্মণ–চণ্ডাল–মুসলমান-সাঁওতাল ইত্যাদিতে কোনও ফারাক ছিল না৷ সকলের সঙ্গেই তিনি অনায়াসে মিশে যেতে পারতেন এবং অদ্ভুত ভাবে একান্ত আপনজন হয়ে যেতেন৷ প্রচলিত কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিদ্যাসাগর মানতেন না৷ কোনও শাস্ত্রীয় ধর্মমতের সাথে তাঁর কোনও রকম সংস্রব ছিল না৷ সেই সময়ে এ কাজ নিতান্ত অভাবনীয় এবং অত্যন্ত কঠিন ছিল৷ গোটা সমাজ জুড়ে তখন জাত–পাত–ধর্ম–বর্ণের ভেদাভেদ ছিল মারাত্মক৷ কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা, ছোঁয়াছুঁয়ি, ধর্মীয় গোঁড়ামি গোটা সমাজকে ছেয়ে ছিল৷ শাস্ত্রীয় যাঁতাকলে মানুষের জীবন পিষ্ট হচ্ছিল৷ আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে বিদ্যাসাগর পার্থিব মানবতাবাদী চিন্তার দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রায় একক প্রতিভায় এর বিরুদ্ধে মহান এবং দুর্ধর্ষ লড়াই চালিয়েছিলেন৷

বিদ্যাসাগরকে বলা হয় ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ৷ বলা বাহুল্য, ভারতীয় নবজাগরণ ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রভাবেই ঘটেছে৷ ইউরোপে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল পনেরো–ষোলো শতকে৷ এই নবজাগরণ তথা মানবতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঈশ্বর ধারণা এবং চার্চের বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে এবং ‘যা যুক্তিহীন, যা প্রমাণসাপেক্ষ নয় তা–ই বর্জনীয়’– এই বিচারধারাকে ভিত্তি করে৷ তা ছিল ধর্ম থেকে পুরোপুরি মুক্ত– সেকুলার৷  তার মূল কথা ছিল মানুষ৷ তার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষ৷ মানুষের মূল্যবোধের জয়গান সে গেয়েছে৷ এর আগে পর্যন্ত সামাজিক যে মূল্যবোধের ধারণা মানুষকে পরিচালিত করেছে, তার মূল কথা ছিল– মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি৷ কাজেই মানুষকে ভালবাসলেই ঈশ্বরকে ভালবাসতে পারবে, ঈশ্বরের কাছে যেতে পারবে৷ এই মূল্যবোধের দ্বারাই মানুষের মূল্যবোধ পরিচালিত হয়েছে৷ এ হল সাধারণ মানবিকতা৷ কিন্তু মানবতাবাদ যে মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে তা মূলত সেকুলার, যার ভিত্তি হল অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার অস্বীকৃতি৷ তার মূল কথা হচ্ছে মানুষই সত্য, মানুষ সবার ওপরে৷

উনিশ শতকের ভারতে যাঁরা ইউরোপীয় নবজাগরণের তথা ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের চিন্তা–ভাবনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম এবং প্রধান রামমোহন রায়৷ কিন্তু তিনি ধর্মীয় চিন্তা থেকে মুক্ত ছিলেন না৷ ধর্মীয় মূল্যবোধকে তিনি বাদ দেননি৷ তাঁর সংগ্রাম ছিল পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে৷ ধর্মকে কেন্দ্র করে নানা সংকীর্ণ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে৷ তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী৷ তিনি বেদান্ত দর্শনের চর্চা করেছেন৷ কিন্তু ইহলোকের স্বীকৃতির প্রশ্নে তিনি শঙ্করপন্থী ছিলেন না৷ শঙ্করাচার্যের মতো তিনি বলেননি, জগৎ মিথ্যা৷ ধর্মীয় মূল্যবোধকে সমাজ এবং মানুষের বিকাশের স্বার্থে ঢেলে সাজানোর জন্য ধর্মীয় সংস্কার সাধন, এই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য৷ ইউরোপের বুর্জোয়া মানবতাবাদী ধ্যানধারণা ও চিন্তাভাবনাগুলিকে ধর্মের মূল সুরটির সঙ্গে মিলিয়ে ধর্মীয় সংস্কারের পথেই তিনি এ দেশে নবজাগরণ আন্দোলনের জন্ম দেন৷ কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত বিদ্যাসাগর বেদান্তকেই ভ্রান্তদর্শন হিসাবে চিহ্ণিত করলেন৷ রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর– ভারতীয় নবজাগরণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এটাই হল ছেদ, গুণগত উত্তরণ৷

বিদ্যাসাগর তাঁর কর্মজীবনে সমাজ সংস্কার এবং শিক্ষার প্রসার আন্দোলনে নেমে দেখেছেন, যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা ধর্মীয় বিধি, আচার, আড়ম্বর মানুষের মনকে জড়, অনড়, গতিহীন এবং মৃতপ্রায় করে তুলেছে৷ ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার মানুষের মনকে ছেয়ে রয়েছে৷ নতুন কোনও কিছু ভাবতে তারা ভয় পায়৷ দেখেছেন ধর্মের নামে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র কী মারাত্মক ভাবে গোটা সমাজ জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে৷ ইংরেজি শিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞানভাণ্ডার এবং নবজাগরণের চিন্তার সংস্পর্শে আসেন৷ স্পষ্ট দেখতে পান, ভারতের মানুষ যখন গোঁড়ামি অশিক্ষা অন্ধতা নিয়ে সুদূর অতীতের অন্ধকারে পড়ে রয়েছে তখন পাশ্চাত্যের মানুষ আধুনিক বিজ্ঞান, যুক্তিবাদকে হাতিয়ার করে মনুষ্যত্বের সাধনায় কীভাবে দ্রুত এগিয়ে চলেছে৷ তিনি উপলব্ধি করেন, এ দেশের সাধারণ মানুষকে যদি যথার্থ মানুষের মর্যাদায় তুলে আনতে হয় তবে তাদের মনের অন্ধকার দূর করতেই হবে৷ সে জন্য আধুনিক শিক্ষা দিতে হবে, তাদের মধ্যে যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক মনন গড়ে তুলতে হবে৷ না হলে এই সমাজের মুক্তি নেই৷ দেশীয় শাস্ত্র এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান–বিজ্ঞানে তাঁর গভীর জ্ঞান এবং নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসাই তাদের কল্যাণে সারা জীবন কাজ করে যেতে তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে৷ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করার একাগ্রতায় তাঁকে এই সত্যে পৌঁছে দিয়েছিল যে, প্রাচীন ধর্মীয় চিন্তার মধ্যে আজ আর সত্য খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ তার জন্য চাই আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী চিন্তা৷ এ ব্যাপারে তিনি সেকুলার মানবতাবাদী চিন্তাকেই পাথেয় করেছেন৷ ব্যক্তিগত জীবনে বিদ্যাসাগর ধর্মীয় ভাবধারা থেকে মুক্ত যুক্তি, পরীক্ষিত সত্য এবং বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই চলতে চেষ্টা করেছেন, দেখাতে চেয়েছেন, অতিপ্রাকৃত সত্তা আছে কি নেই, সে প্রশ্নের মীমাংসার প্রচেষ্টার খুব একটা প্রয়োজন নেই৷ মানুষই তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে মুখ্য৷ তাই তাঁর একটি বক্তব্য খুব প্রচলিত রয়েছে, ‘চোখের সামনে মানুষ অনাহারে মরবে, ব্যাধি–জরা–মহামারীতে উজাড় হয়ে যাবে, আর দেশের মানুষ চোখ বুজে ভগবান–ভগবান করবে– এমন ভগবৎপ্রেম আমার নেই৷ আমার ভগবান আছে মাটির পৃথিবীতে, স্বর্গ চাই না, মোক্ষ চাই না৷ বার বার যেন ফিরে আসি এই বাংলায়’৷

বিদ্যাসাগরের চিন্তায় এই বলিষ্ঠ সেকুলার মানবতাবাদের প্রভাবের জন্যই রামকৃষ্ণ সে যুগের বহু শিক্ষিত যুক্তিবাদী বলে পরিচিত মানুষকে প্রভাবিত করা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরকে প্রভাবিত করতে পারেননি৷ ধর্মবিশ্বাস, ঈশ্বরভক্তি ও পরকাল নিয়ে নানা ঠাট্টা–বিদ্রূপ তিনি প্রায়শই করতেন৷ একবার কলকাতার সিটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পিতা চাঁদমোহন মৈত্রকে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক শশিভূষণ বসু৷ বাদুড়বাগানের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও শশিবাবু বিদ্যাসাগরের বাড়িটা ঠিকমতো চিনতে না পেরে খানিক ঘুরে হয়রান হয়েছিলেন৷ পরে বাড়ি খুঁজে পেলে বিদ্যাসাগর শশিভূষণকে বলেন, ‘‘ওই বাড়িতে বাস করে তুমি এই বৃদ্ধকে আমার বাড়িতে আনতে এত বেগ দিয়েছ তবে তুমি কী করে মানুষকে পরলোকের পথ দেখাচ্ছ? এখান থেকে এখানে, যখন তোমার এত গোলযোগ, তুমি সেই অজানা পথে কেমন করে লোক চালান দাও৷ আমি বুঝেছি, ও ব্যবসা তুমি এখনই ত্যাগ কর৷ ও তোমার কর্ম নয়৷ যার জানা পথে এত গোল, সে অজানা পথে না জানি লোকের কত দুর্দশাই করে থাকে৷’’ পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির সঙ্গে প্রাচীন হিন্দুদর্শন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘‘আমি দর্শন পড়েছি৷ কিন্তু দুর্বোধ্য বিষয়৷ কিছুই ভাল করে বোঝা যায় না৷ পণ্ডিত মশায় পড়ানোর সময় যখন জিজ্ঞাসা করতেন, ঈশ্বর বোঝো তো? আমি বলতাম, আপনিও যেমন বোঝেন, আমিও তেমন বুঝি৷ পড়িয়ে যাচ্ছেন পড়িয়ে যান৷’’

ধর্মের আচার–আচরণের দিকেই শুধু নয়, ধর্মের মূল বক্তব্যের উপরও তাঁর বিশ্বাস ছিল না৷ ছোট ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন, ‘‘দুইজন ধর্মপ্রচারক ও কয়েকজন কৃতবিদ্য ভদ্রলোক আসিয়া উপবেশনপূর্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়, ধর্ম লইয়া বঙ্গদেশে বড় হুলস্থুল পড়িয়াছে, যাহার যা ইচ্ছা সে তাহাই বলিতেছে, এ বিষয়ের কিছু ঠিকানা নাই৷ আপনি ভিন্ন এ বিষয়েরও মীমাংসা হইবার সম্ভাবনা নাই৷’ এ কথায় দাদা বলিলেন, ‘‘ধর্ম যে কী, তাহা মনুষ্যের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোনও প্রয়োজন নাই৷ … আমার বোধ হয় যে, পৃথিবীর প্রারম্ভ হইতে এরূপ তর্ক চলিতেছে ও যাবৎ পৃথিবী থাকিবে, তাবৎ এ তর্ক থাকিবে৷ কস্মিনকালেও ইহার মীমাংসা হইবে না৷’’

বিদ্যাসাগর যাতে মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেন সেজন্য তাঁর পরিবারের সদস্যরা চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন৷ বিদ্যাসাগরের সমগ্র জীবন বিচার করলে দেখা যাবে, তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট– ‘ধর্ম জিনিসটা না হলেও চলবে’৷

সে–সময় ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের অনেকেই সংস্কারমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন, হিন্দুধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, আদালতে ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ নিতে বলিষ্ঠ ভাবে অস্বীকারও করেছেন৷ কিন্তু তাঁরা এর সামাজিক ভিত্তিটি ধরতে পারেননি৷ তাই তাঁরা সামাজিক কুপ্রথাগুলিকে ভাঙতে গিয়ে কিছু কিছু উগ্র আচরণ করে ফেলেছেন৷ ফলে, সমাজমননে তেমন কোনও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হননি৷ বিদ্যাসাগর চিন্তায় এবং মননের দিক থেকে ছিলেন প্রখর বাস্তববাদী এবং আধুনিক৷ তাই তাঁর আচরণে কখনও কোনও উগ্রতা স্থান পায়নি৷ তাঁর চিন্তা এবং কাজের শেকড় ছিল সমাজের অনেক গভীরে৷ তাই সমাজপতিরা অনেক চেষ্টা এবং ষড়যন্ত্র করেও তাঁকে সমাজ–বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি৷ এর অন্যতম প্রধান কারণ, তাঁর জ্ঞানচর্চা কোনও ভাবেই নিছক পাণ্ডিত্যের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল না৷ ফলে, তিনি আধুনিক চিন্তা–চেতনার নির্যাস আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন৷

নবজাগরণের যুগের আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগরের কাছে সত্য মানে ইহজগতের সত্য এবং তিনি মনে করতেন, একই বিষয়ে সত্য বহু হতে পারে না৷ কাশীর সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জে আর ব্যালেন্টাইন সুপারিশ করেছিলেন, ছাত্রদের পরস্পর পরিপূরক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য অধ্যাত্মবাদী দর্শন পড়তে হবে৷ কারণ, তাঁর মতে, প্রাচ্য দর্শনের সঙ্গে পাশ্চাত্য আধুনিক দর্শন পড়ালে তা ছাত্রদের কাছে পরস্পরবিরোধী ধারণা তুলে ধরবে, ফলে ছাত্ররা শিখবে– ‘সত্য দু’রকম’৷ কাজেই এক ও অভিন্ন সত্য ধারণা গড়ে তুলতে হবে, ব্যালেন্টাইনের মতে, পরস্পর পরিপূরক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য অধ্যাত্মবাদী দর্শন পড়ানো উচিত৷ এই মতের বিরোধিতা করে ১৮৫৩ সালে বিদ্যাসাগর তৎকালীন শিক্ষা অধিকর্তা এফ জে ময়েটকে লেখেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, যে ছাত্র সংস্কৃত ও ইংরেজি এই দুই ভাষায় বিজ্ঞান ও সাহিত্য বুদ্ধিমানের মতো পাঠ করেছে এবং সেটা বুঝতে চেষ্টা করেছে, তার সম্পর্কে এ রকম ভয় করার কোনও কারণ নেই৷ সত্যকার ধারণা একবার যে করতে পেরেছে তার কাছে সত্য সত্যই৷ ‘সত্য দু’রকমের’, এ রকমের ধারণা অসম্পূর্ণ প্রত্যয়ের ফল৷ সংস্কৃত কলেজে আমরা যে শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করছি, তাতে কোনও শিক্ষা থেকে ছাত্রদের মনে এ রকম ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে না৷’’ তা হলে প্রাচ্য অধ্যাত্মবাদী দর্শন এবং আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তগুলি থেকে ছাত্রদের এক ও অভিন্ন সত্যোপলব্ধি গড়ে উঠবে কী করে? এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর যা লিখেছিলেন তা শুধু সে যুগে অভাবিত তাই নয়, আজও কথাটা অনেকেই মানতে পারেন না বা যাঁরা পারেনও, তাঁরা সাহসের সাথে বলতে দ্বিধা করেন৷ ব্যালেন্টাইনের চিঠির উত্তরে ১৮৫৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কাউন্সিলের সেক্রেটারি ময়েট সাহেবকে এক পত্রে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘‘কতকগুলি কারণে সংস্কত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হচ্ছে৷ … কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই৷ তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে৷ আমাদের উচিত সংস্কৃত পাঠক্রমে এগুলি পড়ানোর সময়ে, এদের প্রভাব কাটানোর জন্য ইংরেজি পাঠক্রমে খাঁটি দর্শন দিয়ে এগুলির বিরোধিতা করা৷’’

‘সাংখ্য এবং বেদান্ত ভ্রান্ত দর্শন’–  প্রকাশ্যে এ কথা বলার মতো জ্ঞান ও সাহস সে যুগে বিদ্যাসাগর ছাড়া আর কারও ছিল না৷ এটাও লক্ষ করার বিষয় যে সাংখ্য ও বেদান্ত ভারতীয় দর্শনের ঐতিহ্য অনুসারে পরস্পরবিরোধী৷ কিন্তু বিদ্যাসাগর দু’টিকেই ভ্রান্ত বলে একই পংক্তিতে স্থান দিয়েছিলেন৷ কারণ, পরস্পরবিরোধী হলেও দু’টির কোনওটিই বিজ্ঞানসম্মত নয়৷ সংস্কৃত কলেজে সাংখ্য, বেদান্তের মতো প্রাচ্য দর্শন নানা কারণে পাঠ্য হিসাবে রাখলেও ছাত্রদের মধ্যে এইসব ভ্রান্ত দর্শনের প্রভাব দূর করার জন্য বিদ্যাসাগর ইংরেজি পাঠ্যক্রমে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন পড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছিলেন৷ অর্থাৎ প্রাচ্য অধ্যাত্মবাদী দর্শনের দুই মূল স্তম্ভ সাংখ্য ও বেদান্তের ভ্রান্ত ধারণাগুলি তুলে ধরে, সত্য সম্পর্কে যুক্তিবাদী ধারণা প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল৷ তাই তিনি জন স্টুয়ার্ট মিল–এর লজিক পড়াতে বললেন৷

উল্লেখ্য, সে যুগে অত্যন্ত পরিশ্রম করে বিদ্যাসাগর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন৷ তাঁর নিরপেক্ষতা এতদূর ছিল যে সনাতনপন্থীদের দ্বারা বহুনিন্দিত চার্বাক দর্শনকে তিনি সর্বদর্শনসংগ্রহে প্রথম অধ্যায়ে স্থান দিয়েছিলেন৷ সেদিক থেকে ভাববাদবিরোধী ও বেদবিরোধী চার্বাক দর্শনের আধুনিক চর্চার সূত্রপাত বিদ্যাসাগরের হাতেই৷      (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১১ সংখ্যা)