ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি–শত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷
(১১)
অনন্য গদ্যশিল্পী বিদ্যাসাগর
‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’–এ বিদ্যাসাগর ধারালো যুক্তির কথা লিখেছেন৷ যে যুক্তি সম্পর্কে অন্তত প্রকাশ্যে কেউ কোনও প্রশ্ন তুলতে পারেননি, কোনও সংশয়–সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেননি৷ বিদ্যাসাগরের যুক্তি কোনও ভাবে খণ্ডন করতে পারেননি৷ এর অন্যতম কারণ, বিদ্যাসাগর শুধুই যুক্তি তোলেননি৷ শুধুই মানুষের মগজের দরবারে করাঘাত করেননি৷ যুক্তির সাথে সাথে একজন জাতশিল্পীর মতো পাঠকের হৃদয়কে আন্দোলিত করতে চেয়েছেন৷ পাঠকের হৃদয়ের কোমলতাকে সকরুণ পরশে সঞ্জীবিত করেছেন তিনি৷ বাল্যবিধবাদের সীমাহীন দুর্দশায় তিনি নিজে যেমন কেঁদেছেন, সেই কান্নাকে অন্যের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পেরেছেন তাঁর রচনার মাধ্যমে৷ সেই লেখা পড়লে আজও বিদ্যাসাগরের বুকের ভেতরকার কান্না শোনা যায়৷
সেখানে আছে বিদ্যাসাগরের করুণাঘন আর্তি– ‘‘হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ …হতভাগ্য বিধবাদিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্যরসের সঞ্চার হওয়া কঠিন, এবং ব্যাভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও, মনে ঘৃণার উদয় হওয়া অসম্ভাবিত৷ …কী আশ্চর্য শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক, পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্যযন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে এবং আপনাদিগকেও সকল বিপদ হইতে মুক্ত করিতে সম্মত নহে৷ …হায়, কী পরিতাপের বিষয় যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়–ন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে৷’’ এই আবেদন তৎকালীন সমাজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷ ধর্ম–বর্ণের নানা অত্যাচারে নির্যাতিতা নারীর অন্তর্বেদনা সমাজের মূলস্রোতে বিশেষ ভাবে আলোচ্য হয়ে উঠেছিল৷ কাব্য–নাটক–সঙ্গীত সহ নানা শিল্পমাধ্যমেও তা বিষয় হিসাবে উঠে এসেছিল৷ এর অসংখ্য উদাহরণ আছে৷
কর্মের সাথে যদি সামাজিক উদ্দেশ্য যুক্ত হয় সে–কর্মের শিল্পস্তরে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই৷ বিদ্যাসাগরের গদ্য সেই কারণেই এত কার্যকরী, এত অমোঘ, এত সুন্দর৷ তাঁর ‘সীতার বনবাস’ হয়তো অনেকে পড়েননি, কিন্তু বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাস পড়েছেন৷ সেখানে দেখা যায়, শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের শ্রুতিলিখন দিচ্ছেন ‘সীতার বনবাস’ থেকে– ‘‘এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি৷ এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরপটল সংযোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত– অধিত্যকাপ্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়৷ পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী, তরঙ্গ বিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে৷’’
বিষয়োপযোগী ভাষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর রেখে গিয়েছেন এক উজ্জ্বলতর দিক–নির্দেশিকা৷ যখন যা লিখেছেন, সেই বিষয় ও তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভাষাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ বিদ্যাসাগরের রচনাবলিতে চোখ রাখলেই তা দেখা যাবে৷ এমনকি ভাগে ভাগে ‘বর্ণপরিচয়’ (১৮৫৫) যখন লিখেছেন তখন তাঁর লক্ষ্য–উদ্দেশ্যের সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন তিনি৷ দীর্ঘকালের শোনা কথা, ‘মিথ্যা বোলো না৷ মিথ্যা বললে ঠাকুর পাপ দেয়৷’ আজও একথা শোনা যায়৷ কিন্তু ‘বর্ণপরিচয়ে’ বিদ্যাসাগর লিখলেন, ‘মিথ্যা বলিও না৷ মিথ্যা বলিলে তোমাকে কেহ ভালবাসিবে না৷’ আমাদের লক্ষ করতেই হয় যে, এর মধ্যে দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে৷ একদিকে অতিপ্রাকৃত সত্তাকে অস্বীকার করা৷ অপর দিকে, নিছক পাপপূণ্যের বায়বীয় ব্যাপার নয়, মিথ্যা বলা–না–বলার সঙ্গে মানবিক সম্পর্কের কোমল আকর্ষণকে যুক্ত করে দেওয়া৷ –এই দুটি দিক এসেছে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, নবজাগরণের দৃষ্টিভঙ্গি৷ সে–যুগে বিদ্যাসাগর যে বাকি সকলকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন তা এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই৷ তাই, বাংলা গদ্য– যা জন্মাবার পর বিকশিত হওয়ার রাস্তা পাচ্ছিল না, এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর সেই মহাপথ নির্মাণ করেছেন৷
আবার, এই বিদ্যাসাগরই যখন প্রতিপক্ষের কুযুক্তিকে নির্দয় ভাবে কষাঘাত করছেন, তখন তার যোগ্য ভাষাও তিনি নিদর্শন হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন৷ ‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’, ‘ব্রজবিলাস’ ইত্যাদি তাঁর এই ধরনের বিশেষ লেখার দৃষ্টান্ত৷ ভাষার বিবর্তনের দিক থেকে যেগুলির ঐতিহাসিক মূল্য আক্ষরিক অর্থেই অপরিমেয়৷ আধুনিক বাংলা ভাষা ও গদ্যরীতি গঠনকালের সেই একেবারে সূচনাপর্বেই উইট–হিউমার–স্যাটায়ার ইত্যাদি রচনায় যে অসাধারণ দক্ষতার স্বাক্ষর বিদ্যাসাগর রেখে গেছেন, এক কথায় তাকে অনন্য হিসাবে অভিহিত না করে কোনও উপায় নেই৷
কালানুক্রমে নানা লেখায়, ভাষার নানা ব্যবহারে, বারবার ভাষাকে আরও সহজ, আরও সরল করে তোলার ধারাবাহিক এবং অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে একটা উচ্চস্তর পর্যন্ত তিনি নিয়ে এসেছিলেন৷ এক্ষেত্রে তাঁর একক অবদানকে আজ পর্যন্ত কেউ অস্বীকার করতে পারেননি, এমনকি তাঁর কতিপয় অতিবড় সমালোচকও তা পারেননি৷ কেউ কেউ সে অপচেষ্টা করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরের ভাষাকে ‘কঠিন’ বলে চিহ্ণিত করতে চেয়েছিলেন৷ তারা ‘কঠিন ভাষা’ কে ‘বিদ্যাসাগরী ভাষা’ বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অপপ্রচারও চালিয়েছিলেন৷ এ প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘…আমরা যদি তাঁর (বিদ্যাসাগরের) সমকালীন লেখকদের রচনার পাশাপাশি রেখে দেখি, তবে নিশ্চয়ই স্বীকার করব, তাঁর ভাষা অতিশয় প্রাঞ্জল ও সুবোধ্য৷ অণ্বয়গুণে প্রতিটি বাক্যের অর্থ সুস্পষ্ট শুধু তাই নয়, বিন্যাস–কৌশলে বাক্যগুলি সুললিত৷ বিষয়ের অনুরোধে স্থানে স্থানে তাঁকে গম্ভীর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে, কিন্তু তাতে লালিত্য ক্ষুণ্ণ হয়নি এবং সন্ধি–সমাসের জটিলতায় অর্থ আচ্ছন্ন হয়নি৷’’ প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগরী রীতি’ লইয়া কিছু ভুল বোঝাবুঝি চলিয়া আসিতেছে৷ এই ভুলের উৎপত্তি তাঁহার (বিদ্যাসাগরের) সমকালে, আর এই রীতিকে যাঁহারা ভুল বুঝিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রও আছেন৷ দুরূহ ও অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দের সমন্বয়ে গঠিত জবুথবু বাক্যকে যেন তাঁহারা ‘বিদ্যাসাগরী রীতি’ মনে করেন৷ ইহা অপেক্ষা ভুল আর কিছু হইতেই পারে না৷ প্রসাদগুণে বিদ্যাসাগরের সমকক্ষ লেখক কয়জন? ‘সীতার বনবাস’ গ্রন্থে সংস্কৃত শব্দ কিছু বেশি– কিন্তু সে বস্তুমাহাত্ম্যে৷ তৎসম, তদ্ভব ও দেশী শব্দ মিশাইতে বিদ্যাসাগরের সমকক্ষ কয়জন?’’ এরপর তিনি লিখেছেন চমৎকার, ‘‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্যাসাগরী রীতি’ নামে একটি ভাষারীতি আছে, বা বলা উচিৎ এক সময় ছিল– এই রীতির প্রধান লক্ষণ দুরূহ অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ৷ এখন, এই রীতি আর যাঁহার রচনাতেই পাওয়া যাক, বিদ্যাসাগরের রচনায় কখনো পাওয়া যাইবে না৷ উহা কেন যে তাঁহার নামে চলিল জানি না৷ বিদ্যাসাগরের ভাষা ও স্টাইল বিষয়ানুগ, প্রসাদগুণবিশিষ্ট, মার্জিত ও সুললিত৷ সর্বোপরি তাঁহার ভাষারীতি একটি নয়, অন্ততঃ তিনটি৷ সীতার বনবাস, শকুন্তলা প্রভৃতি এক রীতিতে লিখিত, বিতর্ক পুস্তিকাগুলি অন্য রীতিতে লিখিত, আর আত্মচরিত তৃতীয় রীতির অন্তর্গত৷’’
বাস্তবিকই, অসমাপ্ত ‘আত্মচরিত’–এ বাংলা ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে বিশেষ নজর দিয়েছেন তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উল্লেখের দাবি রাখে৷ একদিকে তাঁর সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয় অসাধারণ ভাষায় ব্যক্ত হয়, অন্যদিকে কলমের দুয়েকটা আঁচড়ে, দুয়েকটা টানে একেকটা চরিত্র কেমন জীবন্ত করে তোলা যায়, তারও উৎকৃষ্ট প্রমাণ মেলে৷ প্রখ্যাত ভাষাবিদ অধ্যাপক সুকুমার সেন লিখেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগরের বিশেষ কৃতিত্ব এই যে তিনি প্রচলিত ফোর্ট উইলিয়াম পাঠ্যপুস্তকের বিভাষা, রামমোহন রায়ের পণ্ডিতি ভাষা এবং সমসাময়িক সংবাদপত্রের অপভাষা কোনটিকেই একান্তভাবে অবলম্বন না করিয়া তাহা হইতে যথাযথ গ্রহণ–বর্জন করিয়া সাহিত্যের ও সংসারকার্যের সব রকম প্রয়োজন মিটাইতে সমর্থ হইলেন৷’’ (চলবে)