শোষণ-অত্যাচারে পিছু হটতে হটতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন মানুষ কী ভাবে রাস্তায় নামে তার নমুনা এত কাছ থেকে কখনও দেখিনি। দেখলাম, পার্ক সার্কাসের সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী অবস্থানে গিয়ে। অসংখ্য মুসলিম মহিলা যাঁরা খুব বেশি বেরোন না, তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়ে, ছোট বাচ্চা সবাইকে নিয়ে এসেছেন রাস্তায়। খুব কম শিক্ষিত বা প্রায় অশিক্ষিত মহিলারা এত সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে কথা বলছেন যে বোঝা যায় সমস্যাটা তাঁরা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝছেন। সমাজে মেয়েরা বিভিন্নভাবে যে বাধা-নিষেধের মধ্য দিয়ে যান, এই আন্দোলনের ময়দানে এসে তাঁরা যেন তার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যও উদ্দীপিত হচ্ছেন। বাড়ির কঠোর অনুশাসনও এ সময় অনেকটাই শিথিল হয়েছে। খুব ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা এই আন্দোলনে স্লোগান দিচ্ছে, এইট-নাইনের ছাত্রছাত্রীরা এনআরসি-র বিরুদ্ধে খুব সুন্দর বক্তৃতা দিচ্ছে। এই আন্দোলন সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। যে মসজিদে মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিল না, সেখানে মহিলাদের নমাজ পড়ার অধিকার দিয়েছে মুসলিম সমাজ।
মুসলিম মহিলারা বাড়ির বাইরে রাত কাটাবে এটা অকল্পনীয় ছিল, দিনের পর দিন এখন তাই হচ্ছে। নাগরিকত্বের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ধনী-দরিদ্র একাকার হয়ে গেছে। এই সমাজের অন্যতম প্রধান বিভেদ অর্থনৈতিক বৈষম্যকে হারিয়ে অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইয়ে তাঁরা এক হয়ে গেছেন। অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলারাও প্রতিদিন অবস্থানে এসে বসছেন। এসেছেন হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ সহ নানা অংশের মানুষও।
রায়গঞ্জের একটি ছেলে কলকাতার হোস্টেলে থেকে পড়ে। সে একদিন ময়দান থেকে তার মাকে ভিডিও কল করে আন্দোলনের ছবি, জনতার ভিড় দেখায়। তার মা তাকে বলেন, এত মানুষ সারাদিন তো থাকেন, রাতেও কি থাকেন? ছেলে জানায় রাতেও থাকেন। মা জানতে চান, ছেলেও কি রাতে ময়দানে থাকে? ছেলে তার উত্তরে না বলে। তখন তার মা বলেন, এত মহিলা– এঁরা যদি রাতে থাকেন, ছেলেটিরও থাকা উচিত। তিনি ছেলেকে রাতে ওখানে থাকতে বলেন। তারপর থেকে ছেলেটি প্রায় প্রতিদিনই রাতে থাকে।
‘আন্দোলন মানুষকে চরিত্র দেয়’– এই কথাটা এতদিন বইতে পড়েছি। চোখের সামনে দেখলাম এবং উপলব্ধি করলাম এই প্রথমবার। মোট পাঁচদিন আমি রাতে থেকেছি পার্কসার্কাস ময়দানে। অনেক মহিলা রাতে থাকেন। অনেক ছাত্র-যুবকও রাতে থাকেন। কিন্তু সম্পর্কগুলো এত সুন্দর, এত নির্মল, এত স্বচ্ছ যে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, আমরা এই সমাজের বাইরে অন্য কোনও এক উন্নত সমাজে অবস্থান করছি। মনে হচ্ছে, এক পরিবারের ভাই-বোন, মা এদের নিয়ে রাতে আছি আমরা। এই আন্দোলনের ময়দানে না এলে হয়ত এই অভিজ্ঞতা অধরাই থাকত।
ব্রততী মাইতি, কলকাতা-৪৮