নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষা ধ্বংসের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা        

 

৩১ মে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে ৯ সদস্যের কস্তুরিরঙ্গন কমিটি যে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি (খসড়া) ২০১৯’ পেশ করেছে তার তীব্র সমালোচনা করল অল ইণ্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন৷ সংগঠনের পক্ষে বলা হয়েছে, এই ‘জাতীয় শিক্ষানীতি (খসড়া) ২০১৯’ চালু হলে ভারতের শিক্ষা এবং সমাজব্যবস্থা ধ্বংসের সম্মুখীন হবে৷

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অশোক মিশ্র এক প্রেস বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘শিক্ষাসংস্কারের নামে ‘খসড়া এনইপি–২০১৯’ প্রস্তাব করেছে, বর্তমান ১০+২+৩ বর্ষ পদ্ধতি তুলে দিয়ে ৫+৩+৩+৪+৪ বর্ষ পদ্ধতি চালু করা হোক৷ তার সঙ্গে ৩ বছরের প্রাক–প্রাথমিক শিক্ষা এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সেমেস্টার প্রথা চালু করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল প্রথা পুনঃপ্রবর্তনের বিষয়ে কোনও কথা বলা হয়নি৷ বলাই বাহুল্য, এই যেমন–তেমন স্তরবিন্যাস এবং দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বোর্ডের পরীক্ষা তুলে দেওয়া, এর ফলে সামগ্রিক সুক্লশিক্ষা আরও বিপন্ন হবে৷ তার চেয়েও বড় কথা, মূল পাঠক্রম, সহ–পাঠক্রম এবং অতিরিক্ত পাঠক্রমের মধ্যে তেমন কোনও ফারাক রাখা হবে না৷ গান, খেলা, হাতের কাজ, যোগব্যায়াম ইত্যাদি সবই হবে মূল পাঠক্রমের অন্তর্ভূক্ত৷ এমনকী কলা এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কোনও প্রভেদ রাখা হবে না৷ সব ছাত্রেরই সুযোগ থাকবে কলা এবং বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ শিক্ষার৷ এই প্রক্রিয়া প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতির সর্বনাশ করবে৷ ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্সকে ৪ বছরের করা আদতে ভারতের উচ্চশিক্ষাকে বিশ্ববাজারের পণ্যে পরিণত করার পথই প্রশস্ত করবে৷ এছাড়া, এই কোর্সে যে–কোনও বর্ষে ভর্তি হওয়া বা ছেড়ে দেওয়ার উপায় থাকার ফলে কোনও বিষয়ে সামগ্রিক জ্ঞানচর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শিক্ষার্থীর হাতে থাকবে কেবলমাত্র একটা কাগুজে ডিগ্রি৷ বাস্তবে এইসব প্রস্তাব সিবিসিএস–ব্যবস্থাক উৎসাহিত করবে৷

দ্বিতীয়ত, কর্মমুখী শিক্ষার উপর যে যাবতীয় জোর দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি একটি ধাপ্পা৷ এর একমাত্র উদ্দেশ্য হল, গত ৪৫ বছরে দেশে যে রেকর্ডসংখ্যক বেকার বৃদ্ধি হয়েছে তার আসল কারণ থেকে নজর ঘোরানো৷ যেখানে কাজ নেই বরং বিপুল হারে ছাঁটাই চলছে সেখানে সরকার কর্মসংস্থানের মিথ্যা স্বপ্ণ ফেরি করতে চাইছে৷ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো, বিএড কোর্সকেও ২ বছরের জায়গায় ৪ বছরের করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷ এরকম হলে স্থায়ী শিক্ষক পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব হয়ে যাবে৷ আসলে শিক্ষাপর্বকে ক্রমশ দীর্ঘায়িত করে চাকরি দেওয়ার দায় এড়াতেই এইসব চাইছে সরকার৷

তৃতীয়ত, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করাটা অত্যন্ত নিন্দনীয়৷ এর মাধ্যমে অ–হিন্দিভাষীদের উপর হিন্দি চাপিয়ে দিয়ে মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করাটা শাসকশ্রেণির একটা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র৷ পাশাপাশি, ইংরেজি ভাষাশিক্ষাকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব না দিয়ে, তার গভীর চর্চায় জোর না দিয়ে কেবল কথোপকথনের স্তরে রাখার  ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হবে৷

চতুর্থত, প্রস্তাবে আছে সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হয় বিশ্ববিদ্যালয়, নতুবা স্বশাসিত কলেজ হবে৷ এর ফলে একদিকে উচ্চশিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অন্যদিকে ক্রমাগত ফি–বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলি হয়ে দাঁড়াবে নিছক ডিগ্রি বেচার দোকান৷ তাছাড়া, ইউজিসি বা এই ধরনের অন্যান্য একাধিক সংস্থার পরিবর্তে একটি মাত্র রেগুলেটরি বডি দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এর পরিণামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার হরণের রাস্তাই পাকা হবে৷

পঞ্চমত, খসড়ায় বলা হয়েছে, সমস্ত বেসরকারি স্কুল তিন বছর অন্তর ফি–বৃদ্ধি করতে পারবে৷ বলা বাহুল্য, ব্যাপক ফি–বৃদ্ধির ফলে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে৷ এমনকী, সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যক্তিমালিক বিনিয়োগ করতে পারবে৷ বোঝাই যায়, এর ফলে সরকারি ব্যবস্থা ব্যবহার করে ব্যক্তিমালিক মুনাফা লুটবে৷

ষষ্ঠত, পুরো শিক্ষা বিষয়টাকেই কেবলমাত্র ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার উপর ঝোঁক রয়েছে উক্ত প্রস্তাবে৷ তথাকথিত এই ভারতীয় দৃষ্টিকোণ আদতে শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদকেই সম্প্রসারিত করবে৷

পরিশেষে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শীর্ষ কমিটি তথা রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ (আরএসএ) বা ন্যাশনাল এডুকেশন কমিশন (এনইসি) গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷ বলা হয়েছে, এর লক্ষ্য হবে শিক্ষাক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির সমন্বয় করিয়ে দেওয়া৷ স্বাভাবিকভাবেই, এর দ্বারা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ফ্যাসিবাদী কেন্দ্রীকতা তৈরি করাই তাদের উদ্দেশ্য৷

দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এ হেন ভয়ঙ্কর আক্রমণ প্রতিরোধে এআইডিএসও সর্বস্তরের জনগণকে, বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের  আহ্বান জানাচ্ছে, বৈজ্ঞানিক–ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলনে সামিল হোন৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা)