নতুন আইনে চাষিকে একচেটিয়া পুঁজির মুঠোয় এনে দিল বিজেপি সরকার

টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় ২৪ জুন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধের শিরোনাম– ‘ল্যান্ডমার্ক বিলস ফ্রি দি ফার্মার : দি মোদি গভর্নমেন্ট হেরাল্ডিং দি পাথ ফর ফারমার্স টু বি আত্মনির্ভর’। অর্থাৎ মোদি সরকার এমন সব বিল এনেছে যার ফলে দেশের কৃষকরা সব আত্মনির্ভর হয়ে যাবে যেন ‘এ দেশেতে নাহি রবে হিংসা অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র যাতনা।’ বাজে কথার চাষ বলে ফেলে দিলে চলবে না, ভক্তি করে পড়তে হবে। কারণ মন্ত্রীমশাই অনেক দামি কথা বলেছেন, যা পড়লে এই দুঃখের দিনেও আপনি একটু প্রাণ খুলে হাসতে পারবেন।

কী বলেছেন মন্ত্রীমশাই? বলেছেন এতদিন কৃষকরা ফড়েদের হাতে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিল, এখন বিজেপি সরকারের এই আইন বলে তাঁরা ‘যে দাম চায় সেই দামেই দেশের যে কোনও প্রান্তে তাদের কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবে।’ ইচ্ছামতো দামে দেশের যে কোনও প্রান্তে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবে? দেশের মধ্য-নিম্ন-প্রান্তিক কৃষকরা? যাদের ঘরে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, রোগ হলে চিকিৎসা নেই, শিক্ষা যাদের কাছে আকাশের চাঁদের মতো অধরা, যারা চাষ করে মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে, যাদের ফসল মাঠে থাকতেই বিক্রি করে দিতে হয়– এই রকম কৃষক তো দেশের মোট কৃষকের ৮৬ শতাংশ। এই ধরনের কৃষকরা ফসলের অভাবি বিক্রি না করে, বস্তাবন্দি করে, পরিবহনের বিপুল ব্যয় বহন করে, দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নিয়ে গিয়ে ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করতে পারবে বলে কি অমিত বাবু সত্যিই বিশ্বাস করেন? আমি জানি তিনি বিশ্বাস করেন না। তাঁকে আর যাই হোক নির্বোধ বলা যায় না। তিনি ভাল করেই জানেন, এ অসম্ভব। তবে কেন এই মিথ্যাচার? কেন এই অনৃতভাষণ?

আসলে মিথ্যা না বলে ওঁদের কোনও উপায় নেই। এত কুকর্ম ওঁরা করছেন যা ঢাকতে ওদের নিত্য নতুন মিথ্যা উদ্ভাবন করতে হচ্ছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে ওরা খেই হারিয়ে ফেলেছেন। না হলে না খেতে পাওয়া কৃষকরা দেশের যে কোনও প্রান্তে গিয়ে ইচ্ছামতো দামে ফসল বিক্রি করতে পারবে– এ কথা বলে কেউ!

আসলে ওঁরা একটা ভয়ঙ্কর দুষ্কর্ম করেছেন। তা হল সরকারি সহায়ক মূল্যে কৃষিজ পণ্যের দাম পাওয়ার যতটুকু ব্যবস্থা এতদিন ছিল আইন করে অমিত শাহজিরা তা তুলে দিয়েছেন। কেমন করে? এপিএমসিকে বাস্তবে অকার্যকর করে দিয়ে। বিষয়টাকে একটু ব্যাখ্যা করে বলা যাক।

এপিএমসি হল সরকারি সহায়ক মূল্যে কৃষকের ফসল বিক্রির ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে। রাজ্যের কৃষি এলাকাকে নানা ভাগে ভাগ করে এক একটা এপিএমসি এলাকা তৈরি হয়। সেই এলাকায় একটা নিয়ন্ত্রিত বাজার বা মান্ডি থাকে। সেখানে গোডাউন থাকে, ফসল মাপার ব্যবস্থা থাকে, খুচরো দোকান থাকে, এজেন্টদের ঘর ইত্যাদি থাকে। এক একটা নিয়ন্ত্রিত বাজার বা মান্ডির অধীনে একশ দেড়শ গ্রাম থাকে। বহুজাতিক পুঁজি বা কোনও ব্যবসাদার এখানে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কৃষিজ দ্রব্য কিনতে পারে না। কিনতে পারে একমাত্র সরকার নিযুক্ত এজেন্টরা। এরা কিছু কমিশন পায়। আর রাজ্য সরকার কৃষকের কাছ থেকে খাজনা নেয়। এখানেও নানা ধরনের দুর্নীতি হয়। এবং তার বিরুদ্ধে কৃষকদের লড়াই করতে হয়। কিন্তু তবুও কৃষকরা এই এপিএমসিতে সরকারি সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করার সুযোগ পায়। আইন করে বিজেপি সরকার এই এপিএমসিকে পঙ্গু করে দেওয়ার ও পরিণামে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলল। কিন্তু কীভাবে?

নতুন আইনে এপিএমসি থেকে তার গ্রাম গুলোকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এই সব গ্রামে আম্বানি-আদানিরা অবাধে কৃষিপণ্য কিনতে পারবে। প্রথম প্রথম তারা মান্ডি থেকে দু-এক টাকা দাম বেশি দেবে। সরকার ইতিমধ্যে মান্ডিগুলোকে হীনবল করে ফেলবে, ঠিক মতো অর্থবরাদ্দ করবে না, সেখানে ঠিক মতো কেনাবেচা হবে না, শেষপর্যন্ত রুগ্ন হয়ে মান্ডিগুলো এক এক করে বন্ধ হতে থাকবে। তখন বহু জাতিক পুঁজির সামনে একেবারে খোলা মাঠ। জলের দরে কৃষকদের ফসল তুলে দিতে হবে ওদের হাতে। এই ভবিতব্য কৃষকদের জন্য অপেক্ষা করছে। চুক্তি চাষ প্রসঙ্গে মন্ত্রী মহোদয় যা বলেছেন তাও কম চমকপ্রদ নয়। তিনি বলেছেন, এই চুক্তি চাষ ‘কৃষকের আয় অনেক বৃদ্ধি করবে’। খুব ভালো কথা। কৃষকের যদি আয় বৃদ্ধি হয়, কৃষক যদি সন্তান সন্ততি নিয়ে দুধে ভাতে থাকে তা হলে আমাদের কারও আপত্তির কোনও কারণ নেই। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়কে প্রশ্ন, এই অসাধ্য সাধন হবে কীভাবে? আপনারা যে আইন তৈরি করেছেন তাতে তো এর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। বরং এতে তো কৃষকের সমূহ সর্বনাশ হবে। কেন এ কথা বলছি?

চুক্তি হবে কাদের মধ্যে? এক দিকে থাকবে বৃহৎ বহুজাতিক পুঁজি, অন্য দিকে থাকবে সহায় সম্বলহীন কৃষকরা। চুক্তিতে লেখা থাকবে কোন গুণমানের কতটা পণ্য কী দামে কৃষকের কাছ থেকে কেনা হবে। গুণমান অনুযায়ী দাম। গুণমান ঠিক করবে কে? বৃহৎ বহুজাতিক পুঁজি। তারা কৃষকের স্বার্থে সঠিক গুণমান নির্ণয় করে সঠিক দাম দেবে, এ ভরসা করা যায়? আইনের এক জায়গায় বলা হয়েছে, কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য নেওয়ার সময় কোম্পানি তিন ভাগের দুই ভাগ দাম দেবে। বাদবাকি দাম দেবে গ্রেডেশনের পর, অর্থাৎ গুনমান ঠিক হয়ে যাওয়ার পর। এখন গ্রেডেশনের পর কোম্পানি যদি বলে তোমার পণ্য গুণমানে কম তাই তুমি বাকি টাকা পাবে না, কী করবে কৃষক?

একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। হরি মোড়লের সাথে চুক্তি হল রিলায়েন্স কোম্পানির। প্রতি কুইন্টাল আলু আটশো টাকা দরে সে কিনবে। কিন্তু সেবার আলুর ফলন অনেক বেশি হয়ে যাওয়ায় বাজারে চারশো টাকা দরে আলু পাওয়া যাচ্ছে। কোম্পানি ডবল দাম দিয়ে হরি মোড়লের কাছ থেকে আলু কিনবে? সে চুক্তিমেনে চলবে? সে নিজের লোকসান করে চাষির ঘরে পয়সা ঢুকিয়ে দেবে? দেবে না যে একথা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। ফসল নিয়ে চাষি তখন কী করবে? চোখের জলে বুক ভাসানো ছাড়া তার আর কোনও উপায় থাকবে না।

বলা যেতে পারে এ আশঙ্কা অমূলক। কোম্পানি এমন কাজ করতেই পারে না। কিন্তু এ আমাদের আশঙ্কা নয়, বাস্তব সত্য। মহারাষ্টে্রর তুলা চাষিদের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তো ঠিক এই কাজ করেছে। এ দেশের সবচেয়ে বেশি কৃষক আত্মহত্যা তো এখানে। এবং এটাই তার অন্যতম প্রধান কারণ। এই সরল সত্য কী মন্ত্রীবর অস্বীকার করতে পারেন?

আর দুনিয়ার অভিজ্ঞতা কী? যে সব দেশে আইন করে চুক্তি চাষ চালু হয়েছে সেই সব দেশের গরীব কৃষকদের অবস্থা কী? কী অবস্থা আফ্রিকার ঘানা, মালি, জাইরে, সুদান, ইথিওপিয়া, জাম্বিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার পানামা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এমনকি ব্রাজিল ইত্যাদি দেশের? ওই সব দেশের গরিব চাষিরা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে শহরে গিয়ে ভিক্ষা করছে। আর সেখানকার বহুজাতিক পুঁজি তার মুনাফার পাহাড় বাড়িয়েছে। এ দেশেও সেই একই ঘটনা ঘটছে ও ঘটবে। অমিত শাহজিদের কি এ কথা অজানা? আসলে ওরা মালিকের পায়ে মাথা বিক্রি করে দিয়েছেন। তাই সত্য স্বীকারের সাহস ওদের নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ কিন্তু তাঁর প্রবন্ধে একটা বিষয়ের উল্লেখ করেননি। হয়ত ভেবেছেন উল্লেখ করা বাহুল্য। কিন্তু তাঁর কাছে বাহুল্য হলেও জনজীবনে তার প্রভাব ভয়াবহ। ওরা চাল, গম, ডাল, সবজি, দুধ, মাছ, ছাগল, মুরগি ইত্যাদি সব কিছু যে আম্বানি, আদানিদের হাতে তুলে দিয়েছেন তা ঘুনাক্ষরেও উল্লেখ করেননি। এর পরিণতি কী হবে অমিতবাবু? খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে হু হু করে, পাল্লা দিয়ে বাড়বে জনগণের অনাহার। বেসরকারি হাতে যাওয়ার পর সবকিছুরই দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া– এটাই তো ঘটনা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণ, বিদ্যুৎ, সার, বীজ, কীটনাশক– সব কিছুরই তো দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বাজার অর্থনীতির মালিকদের হাতে যাওয়ার পর। বেড়েছে, কারণ এটাই স্বাভাবিক। এটাই বাজার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। ওরা পণ্য উৎপাদন করে মুনাফার জন্য। জনগণের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়। খাদ্য নিয়েও ওরা তাই করবে। মুনাফা করবে। কম দামে কিনবে, আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি করবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করবে। কৃষক মরবে, গৃহস্থ গরিব মধ্যবিত্ত মরবে। এই প্রক্রিয়া দেশে চলছে, ভাজপা সরকারের নতুন এই নীতির ফলে তা আরও অনেক বেশি বেগবান হবে, জনগণের সর্বনাশ হবে। আর সরকার পালন করবে নীরব দর্শকের ভূমিকা।

তা হলে কোন পথ অবলম্বন করতে হবে– যে পথ অবলম্বন করলে কৃষক বাঁচবে, শহরাঞ্চলের হতদরিদ্র গরিব মধ্যবিত্তরাও বাঁচবে? একটাই মাত্র পথ আছে। তা হল কৃষকের ফসল সরকার কিনবে লাভজনক দাম দিয়ে, আর সরকারি ব্যবস্থায় জনগণের কাছে কম দামে বিক্রি করতে হবে। খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করতে দেওয়া চলবে না। অর্থাৎ চালু করতে হবে সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য। এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।

বাজার অর্থনীতির প্রবক্তারা এবার কুযুক্তি তুলে বলবেন, সরকারের হাতে অর্থ কোথায়? আমরা বলি অর্থের কোনও অভাব নেই। এই কেন্দ্রীয় সরকার গত কয়েক বছরে দশ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করেছে পুঁজিপতিদের। ওদের অন্য অনেক ভর্তুকির কথা তো বাদ দিলাম। এই টাকার সামান্য একটা অংশ খরচ করলেই সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা যায়, দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে অনাহারের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।

কিন্তু সে ক্ষমতা মোদী-অমিত শাহর নেই। কংগ্রেসের ফেলে যাওয়া জুতোয় ওরা পা গলিয়েছেন, মালিকের সেবায় কায়মনোবাক্য সমর্পণ করেছেন। আর এ কাজ করতে হলে অনৃতভাষণ দিতে হবে, মানুষকে ভুল বোঝাতে হবে। তা না পারলে যে আম্বানি-আদানি জাতীয় প্রভুদের গোঁসা হবে। আর গোঁসা হলেই সর্বনাশ। গদি চলে যাবে যে!

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ৭ সংখ্যা_২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০)

Check Also

সব রাজ্যের সব শাসকের ভরসা ‘খয়রাতি’তেই

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট নাগরিকদের অধিকার। প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার। বিধানসভা, লোকসভার মতো আইনসভাগুলিতে কে জনগণের প্রতিনিধিত্ব …