বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের সাজার মেয়াদ ফুরনোর আগেই কারামুক্তি দিয়েছিল গুজরাটের বিজেপি সরকার। গত ৮ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে। ধর্ষণ ও গণহত্যার মতো চরম অপরাধে দণ্ডিত ১১ জন দুষ্কৃতীকে রক্ষা করতে গুজরাটের বিজেপি সরকার ও প্রশাসন কীভাবে মিথ্যাচার, আইনের অপব্যবহার ও আদালতকে প্রতারণা করেছে, তা উল্লেখ করে তাদের তীব্র নিন্দা করেছেন বিচারপতিরা। তাঁরা মন্তব্য করেছেন, বাস্তবে সেখানকার সরকার ও প্রশাসন অপরাধীদের সঙ্গে একযোগে এই অনৈতিক কাজ করেছে।
গুজরাট রাজ্যটিকে নিয়ে বিজেপির প্রচারের অন্ত নেই। ২৮ বছর ধরে একনাগাড়ে সরকারে থেকে হয় কথায় নয় কথায় এই রাজ্যটিকে মডেল হিসাবে তুলে ধরে তারা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এবং সরকার ও প্রশাসনের এমন একটি হীন ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ্যে এসে যাওয়ার লজ্জায় তো বিজেপি নেতাদের মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার কথা। মানুষ ভেবেছিল, নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর জন্য গুজরাটে দলের নেতা-মন্ত্রীদের নিন্দাটুকু অন্তত করবেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দুঃখপ্রকাশ করবেন, কারণ ২০২২-এ অপরাধীদের মুক্তির বেআইনি ও চরম অনৈতিক সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছিল তাঁরই দফতর।
কিন্তু সেসব কিছুই ঘটতে দেখা গেল না। বরং তাঁরা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চূড়ান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন নিয়ে। নরেন্দ্র মোদি জানিয়ে দিয়েছেন, মন্দির উদ্বোধন উপলক্ষে নিজের মধ্যে ‘দিব্য চেতনা’ জাগিয়ে তুলতে ১১ দিন ধরে নানা ধর্মীয় ব্রত ও কঠিন নিয়ম পালন করবেন। চলবে উপবাস, জপ, ধ্যান, কৃচ্ছসাধনের পালা। সমস্যাসংকটে জেরবার দেশের জনসাধারণের সামনে ‘পরম ধার্মিক’ প্রধানমন্ত্রীর ছবি প্রচারে কোমর বেঁধে নেমেও পড়ূন ভক্তরাও। কিন্তু একটি প্রশ্নের জবাব দেবেন কি প্রধানমন্ত্রী? গণধর্ষিতা, চোখের সামনে শিশুকন্যাকে খুন হয়ে যেতে দেখা বিলকিস বানোকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষক গণহত্যাকারীদের জেলমুক্ত করার যে ষড়যন্ত্র গুজরাটে তাঁর দল বিজেপি নিছক ভোটের স্বার্থে প্রায় সফল করে তুলেছিল, তা দেখে, সব কিছু জেনে চুপ করে থেকে, চরম সেই অপরাধকে নীরবে প্রশ্রয় দিয়ে কোন সততার পরিচয় তিনি রাখলেন, ধর্মের কোন নীতি এর দ্বারা পালন করলেন তিনি?
২০০২ সালে কুখ্যাত গুজরাট গণহত্যার সেই কালো সময়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীরা গণধর্ষণ করেছিল পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানোকে। পাথরে আছাড় মেরে থেঁতলে হত্যা করেছিল তাঁর শিশুকন্যাকে। চোখের সামনে বিলকিস খুন হতে দেখেছিলেন পরিবারের ১৪ সদস্যকে, যার মধ্যে নাবালক ছিল ৮ জন। কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ আর আদালতে এক অসমসাহসী লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে বানো ও তাঁর স্বামীকে। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের আইনজীবী ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিবাদী কিছু মানুষ। নিরপেক্ষ তদন্তে বাধা আসতে পারে, সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করা হতে পারে বুঝেই তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই মামলা গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্রে সরিয়ে নিয়ে যায়। সেই সময়ে গুজরাটে সরকারে ছিল বিজেপি, মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। অবশেষে বহু টালবাহানার পর ২০০৮-এ ওই ১১ জন দুষ্কৃতীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ২০২২ সালের প্রথম দিকে এক আসামী কারামুক্তির আবেদন জানায়। সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলে। সামনে ছিল গুজরাটের বিধানসভা ভোট। এই অবস্থায় ‘শত অপরাধ করলেও হিন্দুত্ববাদীরা নিরাপদ’—এই বার্তা দিয়ে হিন্দু ভোট টানতে রাজ্যের বিজেপি সরকার দ্রুত ওই ১১ জনের কারামুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত সমর্থন করে অমিত শাহের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। ২০২২-এর ১৫ আগস্ট গুজরাট সরকার মুক্তি দেয় দুষ্কৃতীদের। এরপর রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানানো হলে সুপ্রিম কোর্ট পুরো বিষয়টি নতুন করে খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্তে আসে যে, এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গুজরাটের বিজেপি সরকার দোষীদের শাস্তি মকুব করেছিল। মিথ্যা তথ্য দিয়ে আদালতের সঙ্গে প্রতারণাও করা হয়েছিল। এই অবস্থায় কারামুক্তির সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
মনে পড়ে যায় ২০২২-এর স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদির সেই ভাষণের কথা। সেদিন ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে’ ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নারী-মর্যাদা রক্ষায় সঙ্কল্প নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অথচ সেদিনই তাঁর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সায় নিয়ে গুজরাটে তাঁর দলেরই সরকার মুক্তি দিয়েছিল ধর্ষক-গণহত্যাকারী হিন্দুত্ববাদী অপরাধীদের। চরম নির্যাতিতা এক মহিলাকে রক্ষার বদলে নির্মম অপরাধীদের রক্ষায় রাজ্যের সরকার ও প্রশাসনের বিপুল উদ্যোগে এগিয়ে আসা, আইন ভেঙে, মিথ্যাচার করে দুষ্কৃতীদের মুক্ত করে আনা—এর চেয়ে বড় অধর্ম আর কী হতে পারে!
উগ্র হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীদের জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ বিশ্বহিন্দু পরিষদের সদস্যরা যখন তাঁদের মালা পরিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে স্বাগত জানাচ্ছিলেন, তখন চুপ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দল বিজেপির বিধায়ক যখন এই জঘন্য অপরাধীদের ‘সংস্কারী ব্রাহ্মণ’ বলে প্রশংসা করেছিলেন, তখনও তিনি প্রতিবাদ করেননি। এবারেও সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সারা দেশে যখন তোলপাড় উঠে গেছে, তখনও তিনি নিশ্চুপ। হায় রে, একজন মুখ্যমন্ত্রী হয়েও যিনি ধর্ষিতা নারীর সুবিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করেন না, একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও যিনি প্রকারান্তরে দুষ্কৃতীদের পক্ষে দাঁড়ান, তিনিই আজ উপবাস জপ তপ করে দেশের মানুষের সামনে নিজেকে পরম ধার্মিক বলে প্রতিপন্ন করতে চাইছেন! এর চেয়ে বড় অধর্ম আর কী হতে পারে!
তবে এই অন্ধকারেও আলোর রেখা দৃশ্যমান। ভণ্ড-ধার্মিকতার এই প্রতারণায় আর ভাষণের বড় বড় বুলিতে গোটা দেশের মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যায়নি, যাবে না। তাই বিলকিস বানোর ন্যায়বিচার পাওয়ার লড়াইতে তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন এ দেশের হাজার হাজার মানুষ। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিলকিস। এই শুভবুদ্ধিই মিথ্যাচারী প্রতারকদের প্রতিরোধের প্রধান অস্ত্র। এই অস্ত্রকে শান দিয়ে আরও ধারালো, আরও সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে তোলাটাই আজ সময়ের আহ্বান।