আশ্রমের মধ্যে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের অপরাধে স্বঘোষিত ধর্মগুরু আসারাম বাপু আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে৷ জোর করে জমি দখল, বেআইনি আর্থিক লেনদেন সহ আরও অনেকগুলি অভিযোগের বিচার চলছে, ধর্ষণের আরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে৷ বিচারপর্বে তিন জন সাক্ষী খুন হয়েছেন৷ ন’জন সাক্ষীর উপর হামলা হয়েছে৷ তদন্তকারী পুলিশ অফিসারকে কয়েক হাজার হুমকি চিঠি দেওয়া হয়েছে৷ ধর্ষিতা নাবালিকার বয়স বাড়িয়ে আঠারো বছর ঘোষণা করতে বলে তাঁর স্কুলের প্রিন্সিপালকে দিনের পর দিন হুমকি দেওয়া হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বিজেপি–কংগ্রেসের বড় বড় নেতাদের সাথে আসারামের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক৷ বিপুল এই প্রভাব–প্রতিপত্তির চাপ এড়িয়ে এই রায়ে পৌঁছানো ছিল খুবই কঠিন৷
২০১৩ সালে যোধপুরের কাছে মানাই গ্রামে আসারামের আশ্রমে নাবালিকা মেয়েটিকে নিয়ে যায় আসারামের শিষ্য তার বাবা–মা৷ ‘অশুভ আত্মা’ তাড়ানোর নাম করে আসারাম মেয়েটির ওপর অত্যাচার চালায়৷ এর আগেও আসারামের আশ্রমের চার নাবালকের রহস্যমৃত্যু হয়৷ দু’জনের পচা–গলা দেহ আশ্রমের কাছে নদী থেকে উদ্ধার হয়৷ অভিযোগ ওঠে তাদের উপর কালাজাদু প্রয়োগ করতে গিয়েই তাদের হত্যা করা হয়৷ সুরাটে আসারামের এক আশ্রমের দুই বোন তাঁদের উপর ধর্ষণের অভিযোগ আনেন৷ এই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ আসারামের ছেলে নারায়ণ সাঁইকে গ্রেফতার করে৷ সুরাট এবং আমেদাবাদে প্রায় ৬৭ হাজার একর জমি জোর করে দখল করার অভিযোগে মামলা চলছে আমেদাবাদের কোর্টে৷ অপরাধের এমন অজস্র ঘটনা ছড়িয়ে রয়েছে আশ্রমগুলিতে৷
চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া আসারাম প্রথম জীবনে টাঙ্গা চালাত৷ গুরুর ভেক ধরে গুজরাটে সবরমতীর তীরে খড়ের কুটির দিয়ে যাত্রা শুরু৷ তারপর রকেট গতিতে তার অগ্রগতি৷ সারা দেশে এখন ৪০০টি আশ্রম৷ দেশে–বিদেশে কয়েক কোটি ভক্ত৷ সেই তালিকায় নেতা–মন্ত্রী–আমলা–পুলিশ-অফিসার–ডাক্তার, শিক্ষক, কে নেই৷ কোটি কোটি টাকার লেনদেন হত এই সব আশ্রমে৷ আয়কর তদন্তে ২০০৮–০৯–এর মধ্যে ২৩০০ কোটি টাকা অঘোষিত আয়ের খোঁজ মেলে৷ পুলিশের দাবি, ভয় দেখিয়ে জমির দখল থেকে শুরু করে লোভনীয় শর্তে টাকা ধার দেওয়ার প্রস্তাবও দিত আসারামের সংস্থা৷ তদন্তকারীদের দাবি, আসারামের সম্পত্তির পরিমাণ কমপক্ষে দশ হাজার কোটি টাকা৷ স্কুল, ছাপাখানা, ওষুধের কারখানা, কী নেই৷ মাস আটেক আগে একই রকম ভাবে আশ্রমের মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া স্বঘোষিত গুরু গুরমিত রাম রহিমের কথা সকলেরই মনে আছে৷ আরও অনেক ‘ধর্মগুরু’র মতোই রাম রহিম কিংবা আসারাম সকলেরই বিশাল বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্য তৈরির রাস্তাটা মোটামুটি একই রকম৷ সকলেই ভক্তদের অন্ধভক্তিকে মূলধন করে রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন এবং অনুগ্রহ আদায় করে৷ বিনিময়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভক্তদের সমর্থন নিশ্চিত করে তুলে দেয় ভোটবাজ এইসব নেতাদের পায়ে৷ ভক্তরা গুরুদের ঈশ্বরের দূত বলে মনে করে, তাদের নির্দেশকে অমান্য করার কথা ভাবতে পারে না৷ ধর্ম এবং রাজনীতির এই বোঝাপড়াতেই উভয়ে নিশ্চিন্তে এবং নিরাপদে অপরাধ করে চলে৷ তাই প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, যখন কেউ আমার পাশে ছিল না, তখন আসারাম ছিলেন৷ তাই আসারামের বিরুদ্ধে ৬৭ হাজার একর জমি জবর দখলের অভিযোগের বিচার প্রক্রিয়া থমকে থাকে৷ তাই রামরহিমের শাস্তি হলে সংগঠিত বিক্ষোভ হয়৷ একের পর এক অপরাধ চলে, পুলিশ–প্রশাসন শাসক দলের নির্দেশে নীরব নিষ্ক্রিয় থাকে৷ এই সব ধর্মগুরুদের অপরাধ যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, কিংবা অত্যাচারিত, প্রতারিত ভক্তদের কেউ জীবন বাজি রেখে প্রতিবাদে নামে, অপরাধকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে তখন কখনও কখনও আসারাম, রাম–রহিমের মতো দু–এক জনকে জেলে যেতে হয়৷ আরও কত ভণ্ড গুরু এভাবে দিনের পর দিন কত আশ্রমে কত শত সরল বিশ্বাসী ভক্ত নারীর ইজ্জত লুঠ করে যাচ্ছে তার খবর কে রাখে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অত্যাচারিতরা ভয়ে মুখ খোলে না৷ যারাও বা সাহস সঞ্চয় করে মুখ খোলে তারা বিচারের দরজায় পৌঁছানোর আগেই গুরুদের সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর হাতে লোপাট হয়ে যায়৷ এমন দু–একজন গুরুর কীর্তি ধরা পড়লে কিছু মর্মন্তুদ কাহিনি প্রকাশ্যে আসে৷
এই ধর্মব্যবসায়ীরাই আজ সমাজে ধর্মের ধ্বজাধারী৷ ভারতে বুদ্ধ চৈতন্য বিবেকানন্দের মতো ধর্মীয় মহাপুরুষরা জন্মেছেন৷ তাঁরা তাঁদের পথে মানুষের মুক্তির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন৷ বিবেকানন্দ কলকাতায় প্লেগ রোগীদের সেবার জন্য অর্থের সংস্থান করতে বেলুড় মঠ বিক্রি করে দিতে বলেছিলেন তাঁর অনুগামীদের৷ আর এইসব ভণ্ড গুরুজিরা দেশের কোটি কোটি শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির চিন্তা দূরের কথা, তাদের দুঃখ কষ্ট দারিদ্র যন্ত্রণার দিকে ফিরেও তাকায় না৷ এই ধর্মগুরুরা ধর্মের নামে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের অশিক্ষাকে পুঁজি করে, তাদের অন্ধতার মধ্যে ডুবিয়ে রেখে নিজেরা ধনকুবের হয়ে উঠেছে, ভোগ–বিলাস–বৈভবের জীবনযাপন করে চলেছে৷ ভক্ত নারীদের জীবনকে নামিয়ে নিয়ে আসছে নরকের পাঁকে৷ মহিলাদের সম্পর্কে এই আসারাম কী মনোভাব পোষণ করে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ডে তার উক্তিতে৷ বলেছিল, ‘‘তাঁর উচিত ছিল ধর্ষকদের ভাই বলে সম্বোধন করে কাতর আবেদন জানানো৷ এতে তাঁর জীবন এবং সম্মান দুই–ই বেঁচে যেত৷ তালি কি এক হাতে বাজে? আমার অন্তত তা মনে হয় না৷’’ তার মতো ‘মহাজ্ঞানী’ পুরুষ কোনও নারীকে যৌন নির্যাতন করলে তা পাপ বলে গণ্য হবে না বলে মনে করত এই আসারাম৷ আশ্রমের এক ভক্ত আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এই কথা জানিয়েছেন৷ এরা নাকি ধর্মগুরু এদের জীবনে কোথাও ধর্মের চিহ্ণমাত্র আছে? এদেরই দুষ্কর্মের সহায়ক হয়ে ওঠে ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলি৷ রাজনীতির ক্ষেত্রে আজ এদের প্রধান সহায়ক বিজেপি–আরএসএস৷ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের ভোট রাজনীতির, এমএলএ, এমপি, মন্ত্রী হওয়ার, গদি দখলের রাজনীতির স্বার্থকে চরিতার্থ করছে৷ কংগ্রেস নেতারাও চিরকাল এই ধর্মগুরুদের মদত দিয়ে একইরকম ভাবে ভোটরাজনীতিতে ফয়দা লুঠেছেন৷ তাই আজ রাজনীতিতে নীতি–আদর্শের পরিবর্তে নীতিহীনতা, প্রতারণা, সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গাই প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে৷
কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, আসারাম, রামরহিমদের এমন সব লজ্জাজনক ঘটনা তাদের অনুগামীদের চোখ খুলতে সাহায্য করবে কি? সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ স্বাধীনতার সত্তর বছরে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজ্যে একের পর এক নানা নামের নানা রঙের সরকার এসেছে, সকলেই দেশের বেশিরভাগ মানুষকে অশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কারের অন্ধকারের মধ্যে ফেলে রেখেছে৷ শিক্ষার যতটুকু সুযোগ আছে তা অন্তঃসারশূন্য, বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী মন গড়ে তোলে না৷ বরং নেতা–মন্ত্রীদের বক্তৃতা, পরিকল্পনা মতো ইতিহাসের বিকৃতি, সিলেবাসে অবৈজ্ঞানিক, অনৈতিহাসিক বিষয় হিসাবে ঢোকানোর মধ্য দিয়ে অন্ধতাকেই টিকিয়ে রাখা হচ্ছে৷ এই অন্ধতার চর্চাই এক দিকে এই সব গুরুদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার মূলধন, অন্য দিকে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির, হিন্দুত্বের রাজনীতির রসদ৷ পাশাপাশি আজ কংগ্রেস–বিজেপি সহ বুর্জোয়া–পেটি বুর্জোয়া দলগুলির পুঁজিবাদী আর্থিক নীতির কারণে মানুষের জীবনে ভয়াবহ সংকট নেমে এসেছে৷ অসহায় মানুষ এই সংকট থেকে বেরোনোর কোনও দিশা না পেয়ে আরও বেশি বেশি করে ভাগ্যের উপর, ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে৷ মানুষের এই অসহায়তাকেই কাজে লাগাচ্ছে এই ধর্মগুরুরা৷ মানুষকে এই অসহায়তা থেকে মুক্তি দিতে পারে আজ একমাত্র একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানের দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা ব্যাপক বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলন৷ এই আন্দোলনই পারে মানুষকে ধরিয়ে দিতে যে, ভাগ্য নয়, ঈশ্বর নয়, তাদের জীবনের দুরবস্থার জন্য দায়ী মুনাফাভিত্তিক এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা৷ এই ব্যবস্থা যতদিন থাকবে, ভোটবাজ এই বুর্জোয়া দলগুলি যতদিন শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকবে ততদিন তাদের দুরবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটবে না৷ ব্যাপক গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে পচে যাওয়া এই ব্যবস্থার উচ্ছেদের মধ্য দিয়েই একমাত্র তাদের দুরবস্থার অবসান হতে পারে৷ এবং তা বাস্তবে সম্ভব৷ দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবগুলি সেই উদাহরণ রেখে গেছে৷
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)