বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতা বেঙ্কাইয়া নাইডু সম্প্রতি এক ভাষণে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মহিমা কীর্তন করেছেন৷ তাঁর মতে, জাগতিক ঘটনাবলীর কিছু ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারলেও ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃত সত্যলাভের সর্বোৎকৃষ্ট পথ আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ৷ আর এর জন্য ধর্মের আশ্রয়লাভই সকলের কাম্য হওয়া উচিত৷ তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার সাথে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধ আবারও একবার সামনে এসে গেল৷
এ দেশের এক প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা উপহাস করে লিখেছিলেন–‘সবই ব্যাদে আছে’৷ যখন ধর্মধ্বজীদের মুখে শুনেছিলেন সত্য উদঘাটনে বিজ্ঞানের নাকি কোনও ভূমিকা নেই, যা কিছু ভূমিকা সবই ওই বেদ–পুরাণের৷ কেবল ডঃ সাহা নন, অন্ধতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, মধ্যযুগীয় কূপমণ্ডুক চিন্তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন বোস, অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখ অগণিত মনীষী৷ এমনকী স্বয়ং বিদ্যাসাগরও৷ তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালে সাংখ্য, বেদান্তের তীব্র বিরোধিতা করে আধুনিক বিজ্ঞান, লজিক, গণিত পড়াতে চেয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীদের৷ অথচ আমাদের দেশের বর্তমান শাসক দলের নেতা–মন্ত্রীরা লাগাতার শাস্ত্র–পুরাণের অলীক মহিমা প্রচার করে জনমানসে উত্তরোত্তর বিভ্রান্তি বাড়িয়ে চলেছেন৷
সত্যিই কি বেদ বাইবেল কোরাণ গীতায় বর্তমান দিনের নানা সমস্যার উল্লেখ আছে? জনজীবনের মূল্যবৃদ্ধি, স্কুল–কলেজে ফি–বৃদ্ধি, ভর্তি সমস্যা, বেকার সমস্যা, কল–কারখানায় লকআউট–ছাঁটাই, চাষির ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যার সমাধান কোনও ধর্মে আছে? পুরাণের কোথাও গণতন্ত্র, ভোট, রিগিং, ছাপ্পার উল্লেখ আছে? সতীদাহের ব্যবস্থা করলে আজকের দিনে খুনের দায়ে সাজা হবে না? তা ছাড়া জগৎ সৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মগ্রন্থের ভিন্ন মত, এবং সেগুলি পরস্পরবিরোধী৷ সত্য যাচাই হবে কী দিয়ে? ব্যক্তির বিশ্বাস নাকি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে৷ আধ্যাত্মিক সকল চিন্তা কোনও না কোনও ধর্মপ্রচারকের আত্মোপলব্ধি৷ তা তাঁদের সময়ের সামাজিক সমস্যার ধরন, জীবন–যাপন, পাপ–পুণ্য বোধ ইত্যাদির ভিত্তিতে মানবমঙ্গলের স্বার্থে ব্যক্তিগত উপলব্ধি৷ তা একান্ত বিশ্বাসনির্ভর৷ অপরপক্ষে বিজ্ঞান সত্য উদঘাটনে নির্ভর করে ধারাবাহিক পরীক্ষা–পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাইয়ের উপর৷ এবং এর ভিত্তিতে বহু মানুষের অভিজ্ঞতার পারস্পরিক আদান–প্রদানের মাধ্যমে৷ তাই সত্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারে বিজ্ঞানই৷
আমাদের দেশের নেতা–মন্ত্রীরা কেন আধুনিক বিজ্ঞানকে তুচ্ছ করে প্রাচীন ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক ভাবনা–ধারণার প্রচার করছেন? একদা বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে ধর্মীয় চিন্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে গড়ে ওঠা আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ কেন ধর্মের জয়গান গাইছে দেশে দেশে? এরও কারণ আছে৷ প্রকৃতপক্ষে, দারিদ্র–ক্ষুধা–যন্ত্র পীড়িত মানুষের জন্য প্রতিকারের পথ খুঁজেছেন ধর্ম প্রবক্তারা৷ কিন্তু পথ পাননি৷ তাঁরা চোখের জলে আবেদন করেছেন দুঃখ কষ্ট ভোগ করার, কৃচ্ছসাধন করার৷ স্বপ্ন দেখিয়েছেন এর মধ্য দিয়ে পরজন্মে আসবে স্বর্গবাসের অনন্ত সুখ৷ শান্তির বাণী প্রচার করেছেন, তবু তাঁরা সমাজ প্রভুদের শৃঙ্খল মোচনের কথা বলেননি৷ সেখানে বৈজ্ঞানিক চিন্তা নিপীড়িত মানুষকে দিয়েছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষণ–যন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তির দিশা৷ জীবদ্দশাতেই অপার স্বর্গসুখ আনার প্রত্যয় জুগিয়েছে৷ স্বভাবতই এই সমাজের প্রভু মালিক শ্রেণি ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারীর দল বিজ্ঞান চিন্তা প্রসারের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছে তাদের মৃত্যুবাণ৷ তাই একে আটকানোর এত রাজসূয় প্রয়াস৷ বিপ্লব ভীত মালিক শ্রেণি নিজেদের বাঁচাতে আজ মানুষের চিন্তায় বন্ধ্যাত্ব আনছে বিজ্ঞানের মোড়কে প্রাচীন ভাবনার প্রসারের দ্বারা৷ এরই জন্য শুধু আধ্যাত্মিক চিন্তার মহিমা কীর্তন নয়, প্রচলিত শিক্ষায় জ্ঞান লাভের যতটুকু সুযোগ অবশিষ্ট আছে তাও অবলুপ্ত করা হচ্ছে৷ বর্তমানে বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদের নানা আপাত হাস্যকর দাবি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়– অন্ধকারময় উগ্র ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি৷ বিজ্ঞান চিন্তায় বলিয়ান হয়ে নতুন ব্যবস্থার লক্ষ্যে এর বিরুদ্ধে লড়াই আজ সময়ের আহ্বান৷
চন্দন সাঁতরা, কলকাতা
(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)