‘‘ ‘মারো শালা যবনদের’ ‘মারো শালা কাফেরদের’ আবার হিন্দু–মুসলমানি কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে৷ প্রথমে কথা–কাটাকাটি, তারপর মাথা–ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল৷ … হিন্দু–মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে– ‘বাবা গো, মা গো’ … দেখিলাম হত–আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না৷ শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদি চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল’’৷
১৯২৬ সালের ২ এপ্রিল কলকাতায় শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷ এই দাঙ্গার বীভৎসতা নজরুলের হৃদয়ে তীব্র বেদনা সৃষ্টি করেছিল৷ সেই ঘটনাকে সামনে রেখে লিখেছিলেন এই ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধটি৷ এই দাঙ্গার পরও দেশ বহু দাঙ্গা দেখেছে৷ দাঙ্গায় মরে সাধারণ মানুষ৷ তারা শুধু হিন্দু নয়, শুধু মুসলমান নয়৷ নজরুল সেদিনই বলেছিলেন, ‘ভূতে–পাওয়ার মতো ইহাদের মন্দিরে পাইয়াছে, ইহাদের মসজিদে পাইয়াছে’৷ নজরুল দাঙ্গা দেখেছিলেন পরাধীন ভারতে৷ সেদিন ব্রিটিশ শাসকরা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল শাসন–শোষণের স্বার্থে৷ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সত্তরটা বছর কেটে গেছে৷ পুঁজিবাদী শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট দেশের মানুষের সামনে যখন শিক্ষা–স্বাস্থ্য–কর্মসংস্থানের কোনও দিশা নেই, তখন ব্রিটিশ শাসকদের দেখানো পথে আজ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সহায়তায় কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিভেদ, দাঙ্গা, হানাহানি সুচতুর পরিকল্পনার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে৷ মন্দির–মসজিদ ইস্যুকে জিইয়ে রাখা হয়েছে, যাতে যে কোনও ভোটের আগে আবার খুঁচিয়ে তোলা যায়৷ গোমাংস রাখা ইত্যাদি নানা অছিলায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা দেশ জুড়ে হিংসার বাতাবরণ তৈরি করছে৷ এই পরিস্থিতিতে কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর জীবনসংগ্রাম ও সাহিত্যকর্ম অনেক বেশি প্রাসঙ্গিকতার দাবি রাখে৷
১৯৩০ সালে আরএসএস–এর আজমির অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে শ্রীপরমানন্দ বলেছিলেন, ‘‘হিন্দুস্তান শুধুমাত্র হিন্দুদের দেশ এবং মুসলিম, খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতের যেসব মানুষ ভারতে বাস করেন, তাঁরা কেবলমাত্র আমাদের অতিথি৷ যতদিন অতিথি হিসাবে থাকতে চান, ততদিন তাঁরা এ দেশে বাস করতে পারেন৷’’ ১৯৩৮–এ নাগপুর অধিবেশনে আরএসএস নেতা সাভারকর উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার তুলে বললেন, ‘‘ভারতবর্ষ কেবলমাত্র হিন্দুর৷ এটি হিন্দু জাতির পিতৃভূমি ও পবিত্র ভূমি৷’’এর বিপরীতে ১৯৩৮–এ কুমিল্লার একটি জনসভায় সুভাষচন্দ্র বসু বলেন, ‘‘…হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় বলে হিন্দুরাজ–এর ধ্বনি শোনা যায়৷ এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা৷’’
নজরুলও বেশ কিছুদিন আগে থেকে তা ধরতে পেরেছিলেন৷ ১৯২৬–এর দাঙ্গার পর কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলন হয়৷ নজরুলকে সেখানে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হয়েছিল৷ আর এক সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়কে সঙ্গে নিয়ে গেয়েছিলেন ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’ গানটি৷ দেশের প্রকৃত কান্ডারির খোঁজে সেদিন গেয়েছিলেন–
‘‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ
কান্ডারি আজি দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ৷
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’’
১৯৩১ সালে লিখেছিলেন ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস৷ যেখানে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার নেতাদের বিভেদ ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বক্তব্যের যথাযথ উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়৷ জাহাঙ্গির নামে এক মুসলমান যুবককে বিপ্লবী দলে দীক্ষা দেওয়ার বিষয়ে অনেক অধিনায়কের আপত্তি৷ স্কুল মাস্টার প্রমত্ত তাদের এক–একটি প্রশ্নের যে উত্তর করেছেন তা আসলে নজরুলের জ্ঞান ও দেশের প্রতি আবেগের প্রতিচ্ছবি৷
প্রমত্ত বললেন, ‘‘হিন্দু, মুসলমান– এই দুই নামের মন্ত্রৌষধিই তো ইংরেজের ভারত সাম্রাজ্য রক্ষার রক্ষাকবচ৷ … ইচ্ছে করলে আমরা অনায়াসে এদেশের মুসলমানদের জয় করতে পারি৷ তবে তা তরবারি দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে৷’’ একজন প্রশ্ন তোলে, ‘‘কিন্তু প্রমত্তদা, ওদের মোল্লা–মৌলভিরা তো কখনও তা হতে দেবে না৷’’ উত্তরে প্রমত্ত বললেন, ‘‘জানি মুসলমান জনসাধারণের অভ্যুত্থানে সবচেয়ে ক্ষতি হবে মোল্লা–মৌলভির৷ তাঁদের রুটি মারা যাবে যাতে করে, তারা প্রাণপণে বাধা দেবেই৷ কিন্তু ভূতেরও ওঝা আছে– সে হচ্ছে মুসলমান ছাত্রসমাজ৷ তরুণ মুসলিমকে যদি দলে ভিড়াতে পারি, তাহলে ইংরেজ আর মোল্লা–মৌলভি এই দুই জোঁকের মুখেই পড়বে চুন৷’’ সেই সময়কার প্রেক্ষিতে প্রমত্তর এর পরের আলোচনা আজও সমানভাবে মিলে যায়৷ আরএসএস, হিন্দু মহাসভার নেতাদের সম্পর্কে সজাগ করে দিতে প্রমত্ত বললেন, ‘‘মুসলমানরা যদি হিন্দুরাজ্যের ভয় করেই, তাতে বড় দোষ দেওয়া চলে না সমরেশ৷ মাতৃসমিতির অধিনায়কদের মত নাকি হিন্দুরাজ্যেরই প্রতিষ্ঠা৷ তাদের এ ভয় আমাদের আন্তরিকতা, বিশ্বাস ও ত্যাগ দিয়ে দূর করতে হবে৷ … মুসলমানদের যদি কোনও দোষত্রুটি থাকেই, তবে তা সংশোধনের সাধনা করব৷ তাদের তাড়াবার পাগলামি যেন আমায় কোনও দিন পেয়ে না বসে৷’’
নবজাগরণের এই বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব নজরুলকে তাই গোঁড়া মুসলমানরা ‘শয়তান’, ‘ধর্মজ্ঞানশূন্য বুনো বর্বর’ ইত্যাদি ভাষায় তীব্র আক্রমণ করেছে৷ এমন বহু আক্রমণ ধর্মধ্বজীরা সেদিন তাঁর বিরুদ্ধে করেছিল৷ এসব আক্রমণের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘মুসলমান সমাজ আমাকে আঘাতের পরে আঘাত দিয়েছে নির্মমভাবে৷ তবু আমি দুঃখ করিনি বা নিরাশ হইনি৷ তার কারণ, বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া আর শিক্ষিত মুসলমানরা ঈর্ষাপরায়ণ৷’’ দেশের শোষিত মানুষের মুক্তির প্রশ্নে তিনি কখনই আপস করেননি৷ ধর্মের নামে উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রেও তাই তিনি ছিলেন নির্মম৷ এই নজরুলের চর্চার প্রসার দেশের শাসকরা কখনও ঘটাতে দেবে না৷ যেমন করে তুলে ধরার বদলে আটকানোর চেষ্টা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী চিন্তাকে৷
‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের শেষে নজরুল যে আহ্বান তুলে ধরেছিলেন তা সমস্ত দেশবাসীর হৃদয়কে নাড়া দেয়৷ মনুষ্যত্বের সেই আহ্বানে যদি সত্যিই দেশবাসী উদ্বুদ্ধ হতে পারে তবে তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম সার্থক হবে বলে তিনি মনে করতেন৷ আজ দিকে দিকে যেভাবে হিন্দুত্বের জিগির তুলে শোষিত মানুষের লড়াইকে পেছন থেকে ছুরি মারা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে নজরুলের ভাবনা অবশ্যই শিক্ষনীয়৷ প্রমত্ত বললেন, ‘‘আমার ভারতবর্ষ– ভারতের এই মূক দরিদ্র নিরন্ন পদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ৷ আমার ভারতবর্ষ ইন্ডিয়া নয়, হিন্দুস্তান নয়, গাছপালার ভারতবর্ষ নয়– আমার ভারতবর্ষ মানুষের– যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দনতীর্থ৷ … ওরে এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়– এ আমার মানুষের মহামানুষের মহা–ভারত!’’
(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)