জঙ্গি সংগঠনের ভোট বয়কটের হুমকি সত্ত্বেও মানুষকে ভোট দিতে বলা কি অপরাধ? বেশি ভোট পাওয়া, তাও কি অপরাধ? মানুষ তাঁর কথা শোনে এটাও কি অপরাধ? এমন অপরাধের কথা কেউ শুনেছে কোনও দিন! কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বিজেপি নেতারা মনে করেন এ সবই হল মারাত্মক অপরাধ। কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাকে বিনাবিচারে আটক রাখতে জন নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ঠিক এই অভিযোগগুলিই তুলেছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতির বিনাবিচারে আটকের ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার ঠিক কয়েক ঘন্টা আগে তাঁদের উপর জন নিরাপত্তা আইন (পিএসএ) প্রয়োগ করেছে সরকার। যার ফলে এঁদের বিনা বিচারে দু’বছর পর্যন্ত সরকার আটক রাখতে পারে। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে ডাহা মিথ্যে বলেছিলেন। তিনি বলেন, প্রবীণ সাংসদ এবং রাজ্যের ৫ বারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাকে আটক করাই হয়নি। অথচ ফারুক আবদুল্লা ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা বাতিলের দিন থেকেই বন্দি। শুধু তাই নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একথা বলার অল্প কিছু পরেই ফারুক আবদুল্লার ওপর পিএসএ প্রয়োগ করে সরকার। ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতিদের এতদিন সাধারণ নিবর্তনমূলক (প্রিভেন্টিভ) আটক আইনের ভিত্তিতে গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল। কিন্তু ৬ মাস ধরে কোনও আদালতে তাঁদের হাজির করা হয়নি। নিবর্তনমূলক আইনে তাঁদের আর আটক রাখা যাবে না বুঝেই পিএসএ প্রয়োগ করা হয়েছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন জম্মু কাশ্মীর প্রশাসন যে বয়ান দিয়েছে, তাতে লেখা হয়েছে, আটক ব্যক্তি এমন একজন লোক, যিনি ডাক দিলে জঙ্গিদের ভোট বয়কটের ডাক উপেক্ষা করে দলে দলে লোক ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। বলা হয়েছে, এই আটক ব্যক্তি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেন। তিনি ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরোধিতা করেছেন, টুইটারে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছেন এবং অশান্তিতে ইন্ধন দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, ওমর আবদুল্লার আটক হওয়ার আগে ৪ এবং ৫ আগস্ট ২০১৯-এর শেষ যে কটি টুইটার মন্তব্য সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেছে, তার সবকটিতেই তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন– কাশ্মীরকে ঘিরে কেন্দ্রীয় সরকার গোপনে কিছু একটা করতে চাইছে। যাই ঘটুক না কেন কাশ্মীরের মানুষ যেন শান্ত থাকেন, প্রতিবাদ যেন হিংসাত্মক না হয়, হিংসাত্মক প্রতিবাদে লাভ বিজেপিরই হবে। (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১০.০২.২০২০) এর কোনটিকে হিংসায় উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা বলে অমিত শাহরা মনে করছেন, তার কোনও ব্যাখ্যা কেন্দ্রীয় সরকার দেয়নি।
গণতন্ত্রের কী অপূর্ব নমুনা! অমিত শাহরা মুখে স্বীকার করুন আর নাই করুন, এর মধ্য দিয়ে একটা কথা তাঁরা পরিষ্কার মেনে নিয়েছেন, কাশ্মীরের মানুষ তাঁদের কথা শোনেন না। তাঁরা সারা কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, মানুষের চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছেই। ৬ মাস পর আংশিকভাবে ফোন-ইন্টারনেট খুললেও তা এখনও পুরোপুরি চালু নয়। সরকারের বিরুদ্ধে সামান্য খবর করলেই বর্ষীয়ান সাংবাদিকদের পর্যন্ত তুলে নিয়ে গিয়ে হেনস্থা করছে পুলিশ। যে সমস্ত দলগুলি ভারতের সংসদীয় ভোট রাজনীতিতেই আছে, তাদের নেতারাও বন্দি। এমনকি যে মেহবুবা মুফতি কাশ্মীর রাজ্যে বিজেপির সাথে কোয়ালিশন সরকার চালিয়েছেন মাত্র কিছুদিন আগেই, তাঁকেও বিপজ্জনক ব্যক্তি বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার! আরও হাস্যকর হল তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগে লিখেছে ‘ড্যাডিস গার্ল’ অর্থাৎ বাপকা বেটি। কে সেই পিতা? তিনি হলেন বিজেপি সমর্থিত ভিপি সিং সরকারের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদ। মেহবুবা মুফতি সম্বন্ধে লেখা হয়েছে, তিনি সারা দেশে গণপিটুনিতে হত্যা নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন। সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভাল, স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টও এই সমালোচনাটি একাধিকবার করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও নীতির বিরুদ্ধতা করা যাবে না, গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা যাবে না, সাধারণ মানুষ তাঁদের ক্ষোভ বিক্ষোভের কথা সরকারের কাছে জানাতে পারবেন না এটাই কি কাশ্মীরের স্বাভাবিকত্ব? অবশ্য কাশ্মীর কেন, আজ সারা ভারতেই বিজেপি সরকার এই ‘গণতন্তে্রর’ নমুনাটিকেই তো প্রয়োগ করে চলেছে! বিজেপির কিংবা সরকারের বিরুদ্ধতা মানেই দেশদ্রোহিতা, এই দর্শনেই তো তাঁরা বিশ্বাসী। তাইতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে ছোট-বড় বিজেপি নেতারা বিরোধীদের গুলি করার কথা বলে চলেছেন। আর সেই নির্দেশ মেনে একের পর এক বিজেপি ভক্ত নাথুরাম গডসে হওয়ার বাসনায় খোদ দিল্লিতে পর্যন্ত প্রতিবাদী মানুষের উপর গুলি চালিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশ তো অলিখিত ‘পুলিশি রাজ’ জারিই করে দিয়েছে। সেখানে বিক্ষোভ করলেই গুলি চলছে। দিল্লির বুকে যে কোনও প্রতিবাদকে দমাতে কাশ্মীরের কায়দাতেই এনএসএ অর্থাৎ নির্বিচারে আটকের আইন জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা বলেছিলেন তাঁরা কাশ্মীরকে ভারতের সাথে মিলিয়ে দিচ্ছেন। কাশ্মীর সহ সারা দেশে একই কায়দায় গণতন্তে্রর গলা টিপে ধরাই কি সেই মিলনের পথ! অমিত শাহরাই উত্তর দিতে পারেন। তাঁদের কথা শুনে মনে হতে পারে যেন এতদিন কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না! কাশ্মীরের জনগণই তো স্বায়ত্তশাসনের সীমিত অধিকারের ভিত্তিতে ভারতভুক্তির দাবিতে আন্দোলন করে সংবিধানসম্মত ভাবে তা আদায় করেছিলেন। বিজেপি সরকারের একতরফা গা-জোয়ারি সিদ্ধান্ত তাঁদের সেই আকাঙক্ষাকে মারাত্মক আঘাত করেছে। এর উপর কাশ্মীরের মানুষ দেখছেন কেন্দ্রীয় সরকারের সাজানো সফরে বিদেশি প্রতিনিধিরা কাশ্মীর ঘুরে আসছেন, অথচ তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কিংবা ভারতীয় পার্লামেন্টের কোনও বিরোধী দলের সদস্য কাশ্মীরে পা রাখার অনুমতিও পাচ্ছেন না। কাশ্মীরের সাংসদ ফারুক আবদুল্লা বন্দি, তিনি সংসদে আসার অনুমতিটুকুও পাচ্ছেন না। এগুলোই আসলে কাশ্মীর তথা বিজেপি শাসিত ভারতে ‘স্বাভাবিক’! এটাই বিজেপি শাসনের ‘গণতন্ত্র’!
আর একটি তথ্য আরও চমকপ্রদ। কিছুদিন আগে নিউইয়র্কের ভারতীয় কনসাল জেনারেল সন্দীপ চক্রবর্তী প্রবাসী কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ইজরায়েল প্যালেস্টাইনে অধিকার কায়েমের জন্য যা করছে, সেই মডেলই অনুসরণ করতে হবে কাশ্মীরে (দ্য স্ক্রোল, ২৭ নভেম্বর ২০১৯)। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই মন্তব্যের কোনও প্রতিবাদ করা হয়নি। একজন দায়িত্বশীল কূটনীতিক বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলার পর সরকার সেই বক্তব্য বাতিল না করার অর্থ এটাই ধরতে হবে যে, সরকারের মনোভাবের সাথে এ কথার মিল আছে। এই মনোভাব যে কাশ্মীর সমস্যাকে আরও জটিল করবে তা একটা শিশুও বোধহয় বোঝে। সরকার না চাইলে এই ধরনের মন্তব্য কি সরকার চলতে দিত? আসলে সমস্যার সমাধান নয়, সরকার তথা বিজেপি নেতৃত্বের কাছে ‘কাশ্মীর’ হল সারা দেশে ছদ্ম-জাতীয়তাবাদী আবেগের ঢেউ তুলে ভোট জোগাড়ের হাতিয়ার মাত্র!
গত বছর ৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরে একতরফাভাবে ৩৭০ ধারা বাতিল করার পরমুহূর্ত থেকেই তিনজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সহ বহু মানুষকে আটক করেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ীই এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ১৬১ জন। যদিও বেসরকারি মতে বেআইনি ভাবে কোনও লিখিত তথ্য না দিয়ে অজানা জায়গায় আটক করে রাখা মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এর মধ্যে ১০ বছরের স্কুল ছাত্র থেকে শুরু করে অতিবৃদ্ধ মানুষ পর্যন্ত আছেন। অনেককে কাশ্মীরের বাইরে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেলে বন্দি অবস্থায় ক্যান্সার আক্রান্ত কাশ্মীরি নেতার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ছররা গুলিতে, লাঠির আঘাতে মৃত্যু ঘটেছে একাধিক। সরকার ডেথ সার্টিফিকেটটা পর্যন্ত আটকেছে। এগুলো কোন স্বাভাবিকতার লক্ষণ? কাশ্মীরের ফল চাষ, পর্যটন শিল্প থেকে শুরু করে শাল কিংবা কার্পেট ব্যবসা মারাত্মক সংকটে। লক্ষ লক্ষ মানুষ রুজিরোজগারহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। শিশু-কিশোররা স্কুল যেতে ভয় পাচ্ছে। তারা ভয়জনিত ট্রমায় আক্রান্ত। এসব নিয়ে সরকারের কোনও মাথাব্যথা কেউ দেখেছে?
যে পিএসএ আইন প্রয়োগ করা হল, তাকে ১৯৮২ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল ‘ল লেস ল’ বেআইনি আইন। ১৯৭৮ সালে জঙ্গলের কাঠ চোরদের দমনের অজুহাতে তা চালু হয়়েছিল। এই স্বৈরাচারী আইনে এখনও পর্যন্ত ক’জন কাঠচোর গ্রেপ্তার হয়েছে তা হাতে গুনে বলে দেওয়া গেলেও রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর কতবার এই আইন প্রয়োগ হয়েছে তা গুনে শেষ করা মুশকিল (নিউজ ক্লিক, ২০ নভেম্বর ২০১৯)। আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে এত দমন পীড়ন সত্তে্বওগলা টিপে ধরাকে গণতন্ত্র বলে মানানো যায়নি যেমন কাশ্মীরকে, তেমনই সারা দেশকে।
আজ কাশ্মীরের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ শুধু সে রাজ্যের মানুষের সমস্যা নয়। বিজেপি সরকার আজ সারা দেশের শ্রমিক কর্মচারীদের অধিকার হরণ করছে, রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের সম্পদ কার্যত লুঠ করছে, দেশের মানুষের প্রায় সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে, এনআরসি-সিএএ-র মতো মারাত্মক জনবিরোধী আইন এনে দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন আনছে। প্রতিবাদ করলেই তাদের দেশদ্রোহী বলছে। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে যদি মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হয় তাহলে কাশ্মীরের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার দাবিকে সরিয়ে রেখে তা সম্ভব নয়। দেশের জনসাধারণের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি দমন-পীড়নের শিকার তাদের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই আছে সকল মানুষের অধিকারের কথাকে তুলে ধরার শক্তি। শোষিত-নিপীড়িত মানুষের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে কাশ্মীরের জনগণের কান্নার পাশে দাঁড়ানোর দায় আজ সারা দেশের খেটে খাওয়া মানুষেরই।