এমনিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত সংকটের আবর্তে। ভারত দ্রুত পিছিয়ে পড়ছিলই। হঠাৎ করোনা মহামারিতে দীর্ঘ লকডাউনের কারণে অর্থনীতিবিদদের হুঁশিয়ারি যে ‘দেশ ১০-২০ বছর পিছিয়ে পড়বে।’ লকডাউনের আগে আস্ত কারখানাগুলো যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনই আছে। আছে কাঁচামাল, আছে বিদুৎ, জল, পরিবহণের ব্যবস্থা। আছে কারখানার মালিক। নেই শুধু শ্রমিক। তাই সব থেকেও উৎপাদন বন্ধ। তাই মালিকের লাভের হিসাব বন্ধ। ২০১৯-২০ সালে দেশে উৎপাদিত সম্পদের মোট পরিমাণ ৮৮২ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬৬১ লক্ষ কোটি টাকা রয়েছে দেশের ১০ শতাংশ ধনীতম ব্যক্তিদের কাছে। ভূমিহীন কৃষক খেতমজুর প্রান্তিক চাষি যা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করেছেন তার ৭.৫ কোটি টন মজুত করে রাখা আছে দেশের খাদ্য ভাণ্ডারে।
হঠাৎ করে করোনা মহামারির আক্রমণে পর্যুদস্ত দেশ। এখন প্রথম প্রয়োজন কোভিড-১৯ ভাইরাসের আক্রমণ থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানো। তার জন্য চাই খাদ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা, চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে চাই উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। এর জন্য আনুমানিক প্রয়োজন ৯.৫ লক্ষ কোটি টাকা। লাভের উদ্দেশ্যে উৎপাদন বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে এমনিতেই দেশের কোটি কোটি শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার। তার উপর বন্ধ কলকারখানার কোটি কোটি অসংগঠিত কর্মহীন শ্রমিক। তাদের প্রয়োজন ন্যূনতম মাসিক ৫০০০ টাকা অনুদান।
কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে ঘোষণা করেছিল, ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ। এই টাকা তুলতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সুদ কমানো হয়েছে ব্যাপক। বিশ্বে অপরিশোধিত তেলের দাম কমতে কমতে তলানিতে, কিন্তু দেশে আবার নতুন করে কর বসানো হয়েছে। এই লকডাউনের মধ্যেই শ্রমিকদের কাজের সময় একই বেতনে ৮ ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করার সিদ্ধান্ত চাপানো হচ্ছে। এই লকডাউনের সুযোগে আনা হচ্ছে দানবীয় বিদ্যুৎ আইন সংশোধনী বিল। যার মধ্য দিয়ে বৃহৎ শিল্পপতি ও কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিদ্যুৎমাশুল কমিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের মাশুল বিপুল বাড়ানো হবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন যার প্রায় সবটাই চলে যাবে মালিক গোষ্ঠীর স্বার্থে। এইভাবে দেশরক্ষার দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের ৯০ শতাংশ খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণির উপর। প্রায় মাসাধিক কাল ধরে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর কেন্দ্র-রাজ্য সরকারগুলোর নিদারুণ বদান্যতায় শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হল। ক্লান্তিতে ট্রেনে কাটা পড়ল ১৬ জন শ্রমিক। এক বিন্দু জলের অভাবে রাস্তায় জঙ্গলে পড়ে প্রাণ দিল শিশু শ্রমিক। ‘তোরা ছোটলোক মরবি মর, আমাদের মারবি নাকি!’ তাই তাদের উপর বর্ষিত হল কীটনাশক। সামান্য উপযুক্ত মানের পিপিই-র অভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা, প্রাণ গেল কয়েক জনের। আর এই ফাঁকে দুর্নীতিবাজ ঋণখেলাপিদের ঋণ মকুব করে দেওয়া হল। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের পবিত্র ভোটাধিকারে মহিমান্বিত হে আমার ভারত কতদিন চোখ বুজে সইবে! কতদিন এই পরজীবী মালিকদের, পরজীবী মালিক পদলেহনকারী দেশনেতাদের ভাষণ শুনবে! কেন এই দাবি তুলবে না– সরকারে যদি থাকতে চাও দেশের ১০ শতাংশ ধনীতমদের সম্পদের উপর ১০ শতাংশ সম্পদ কর বসাও।
সুব্রত বিশ্বাস, কলকাতা