আজ কত বাড়ল পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিনের দাম? সকালে উঠেই এখন ভারতের যে কোনও সাধারণ মানুষের মনে এই আতঙ্কটাই ভেসে ওঠে৷ প্রতিদিন নিয়ম করে বেড়ে চলেছে এই পেট্রোপণ্যের দাম৷ বাড়তে বাড়তে ৮ সেপ্টেম্বর কলকাতায় পেট্রোলের দাম দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৩ টাকা লিটার, ডিজেলের ৭৫ টাকা৷ এই দাম বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা যথেষ্ট আশঙ্কার৷ একই সাথে ভর্তুকিযুক্ত রান্নার গ্যাসের দামও গিয়ে পৌঁছেছে প্রায় ৫০০ টাকার উপরে৷ তার দামও প্রতি মাসেই বাড়ছে৷ একই সাথে সরকারি নীতি অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে প্রতি মাসে কেরোসিনের দাম বাড়ে ২৫ পয়সা৷ একেবারে গরিব–মধ্যবিত্ত–সাধারণ মানুষের হেঁশেলে এভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে বিজেপি সরকার৷ পেট্রল–ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে পরিবহণ খরচ৷ যার হাত ধরে নতুন করে বাড়ছে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম৷ এমনিতেই ভারতের অধিকাংশ মানুষের রোজগারের বেশিরভাগ অংশই চলে যায় খাদ্য কিনতে৷ এর উপর চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামই মাসে ৪ থেকে ৭ শতাংশ বাড়ায় নাভিশ্বাস ওঠার দশা সাধারণ মানুষের৷ ভোগ্য পণ্য কেনা তো অনেক পরের কথা, খেয়ে–পরে কোনও রকমে বাঁচাটাই হয়ে উঠেছে দুষ্কর৷
‘‘ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলি ২৯টি দেশে ডিজেল রপ্তানি করছে ৩৬ টাকা লিটার দরে৷ অথচ দেশের মানুষের কাছে বিক্রি করছে ৭৫ টাকা লিটার দরে৷’’ |
কিন্তু কেন এই ভয়াবহ দাম বৃদ্ধি? বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দামবৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ বাড়া এবং ডলারের তুলনায় টাকার দামের রেকর্ড পতনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে বিজেপি সরকার হাত ধুয়ে ফেলেছে৷ প্রশ্নটা এখানেই৷ সরকারের কাজ কি শুধু অজুহাত দিয়ে মানুষকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বাণী বিতরণ নাকি দ্রুত হস্তক্ষেপ করে মানুষকে সুরাহা দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্যই দেশের খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত জল করা ট্যাক্সের টাকায় মন্ত্রী আমলাদের রাজার হালে পোষা হয় আর তা যদি না হয়, কোনও দেশকে গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক– এইসব গালভরা নাম দেওয়ার অর্থ কী?
বিশ্ব বাজারে দাম বেড়েছে ঠিকই৷ কিন্তু তাতেই কি এমন ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী ছিল? বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম এখন না হয় বাড়ছে, কিন্তু যখন কম ছিল তখনও কি ভারতের বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম কমাতে সরকার তেল কোম্পানিদের বাধ্য করেছিল? নিজেরা কি কর–সেস কমিয়ে দাম কম থাকার সুবিধা মানুষকে দিয়েছিল? বরং ঠিক বিপরীত, বিশ্ববাজারে ২০০৮–এর জুনে যে অশোধিত তেল ব্যারেলপ্রতি ১৩৬ ডলার দামে বিক্রি হয়েছিল, দাম কমতে কমতে ২০১৬–র ফেব্রুয়ারিতে তা দাঁড়ায় মাত্র ৩০ ডলারে৷ অর্থাৎ ৭৮ শতাংশ দাম কমেছিল অশোধিত তেলের৷ কিন্তু সে সময় ভারতে পেট্রল–ডিজেল–রান্ন গ্যাসের দাম কমেছিল ২০ থেকে ২২ শতাংশ মাত্র৷ এই সুযোগে বিপুল পরিমাণ লাভ পকেটে পুরেছে একদিকে তেল কোম্পানিগুলি আর একদিকে সরকার৷ কমানো দূরে থাক, বিজেপি সরকার সে সময় পরপর কয়েকবার উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়েছে যাতে তেলের দাম না কমে৷ আর তেল ব্যবসায় লগ্নি করে রিলায়েন্স, এসার, আদানি গোষ্ঠীর মতো ধনকুবেররা সেই সুযোগে ভারতে তেল–গ্যাস বেচে আকাশছোঁয়া মুনাফা সিন্দুকে পুরেছে৷ তাহলে এখন বিশ্ব বাজারে দাম বাড়তে দেখে সরকার কেন উৎপাদন শুল্কে ছাড় দিয়ে বা কর, ভ্যাট, সেস কমিয়ে মানুষকে সুরাহা দেবে না? কেন সরকার এই সময় তেল কোম্পানিগুলিকে দাম কমাতে বাধ্য করে মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে না? সরকার এবং তেল কোম্পানি উভয়েই তো বিশ্ববাজারে কম দাম থাকার সুযোগে বিপুল টাকা ঘরে তুলে রেখেছিল এই অজুহাতে যে, পরে দাম বাড়লে এই বাড়তি তহবিল কাজে লাগিয়ে তারা দাম কমাবে৷ কোথায় কী পেট্রোপণ্য নিয়ে কার্যত লুঠের কারবার চালাচ্ছে সরকার এবং ধনকুবের মালিকরা৷
কেমন লুঠ চলছে একটু দেখা যাক৷ ৮ সেপ্টেস্বর বিশ্ববাজারে এক ব্যারেল (১৫৯ লিটার) অশোধিত তেলের দাম ছিল ৬৯.৮২ ডলার৷ ডলার–টাকার বিনিময় হার অনুযায়ী ১৫৯ লিটার অশোধিত তেলের দাম ছিল ৫০৩৪.৩৭ টাকা৷ অর্থাৎ লিটার প্রতি ৩১.৬৬ টাকা৷ ইন্ডিয়ান অয়েলের ঘোষিত বিবৃতি অনুসারে পেট্রলে প্রাথমিক লাভ সহ উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ৩৮.৭৪ টাকা৷ অথচ ওইদিন ভারতের বাজারে পেট্রলের দাম ছিল প্রায় ৮৩ টাকা লিটার৷ এত বিপুল পার্থক্য হল কী করে? দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের চাপানো উৎপাদন শুল্ক্, রোড সেস, ভ্যাট ইত্যাদি নানা কিছু মিলিয়ে ওইদিন জনগণকে প্রতি লিটার পেট্রলে কর গুনতে হয়েছে ৪৪.২৬ টাকা৷ কত লাভ সরকারের! শেষ আর্থিক বছরে কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের ঘাড় ভেঙে এই খাতে ট্যাক্স আদায় করেছে ২ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা, আর রাজ্য সরকারগুলির ভাগ ১ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা৷ একটা বিষয় পরিষ্কার, বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম এখনও ১০০ ডলার থেকে অনেক কম৷ অথচ ভারতে তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১৩০ ডলার থাকার সময়কেও ছাপিয়ে বহুদূর চলে গেছে৷ অথচ ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইজরায়েল ইত্যাদি ১৫টি দেশে ৩৪ টাকা লিটার দরে পেট্রোল রপ্তানি করছে৷ এছাড়াও ২৯টি দেশে তারা ডিজেল বেচছে ৩৬ টাকা লিটার দরে৷ কী করে তা সম্ভব হচ্ছে? তাহলে কি বলা যায় বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে বলে ভারতের বাজারে দাম বাড়ছে? নাকি মানুষের ঘাড় ভেঙে যথেচ্ছ লুঠের কারবারই এরজন্য দায়ী৷ সরকারি প্রচারকরা বলতে পারেন, কর না পেলে সরকার উন্নয়ন করবে কী করে? দেখা যাক কেমন উন্নয়ন! একসময় তেল ক্ষেত্র থেকে আদায় করা টাকা খরচ হত গ্রামীণ রাস্তাঘাট–পরিকাঠামোর উন্নয়ন, রাস্তা–হাইওয়ে তৈরি ইত্যাদি কাজে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলি তাকে সাধারণ তহবিলে মিশিয়ে দিয়েছে৷ তার উপর সমস্ত নতুন রাস্তাতেই এখন চড়া হারে টোল ট্যাক্স বসিয়ে নতুন লুঠের খাতা খুলেছে৷ তাহলে এই বিপুল রাজস্ব খরচ হচ্ছে কীসে? দেখা যাচ্ছে সরকার এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব খরচ করেছে নীরব মোদি, বিজয় মালিয়াদের মেরে দেওয়া ব্যাঙ্কের টাকা পূরণ করতে, না হয় কর্পোরেট কর কমানো সহ পুঁজিপতিদের বিপুল কর ছাড় দিতে৷
এবার তেল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা ধনকুবেরদের লুঠ কেমন চলছে দেখা যাক৷ গত আর্থিক বছরে রিলায়েন্স ভারতে তেল–গ্যাস বেচে লাভ করেছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি৷ অর্থাৎ প্রতিদিন তাদের নিট লাভ ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে৷ সরকারি কোম্পানি ইন্ডিয়ান অয়েলও ২১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা লাভ করেছে৷ রুইয়া কোম্পানির এসার লাভ করেছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ শুধু তাই নয়, আদানিদের বিপুল লাভ পাইয়ে দিতে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই ২০০৫ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকারি–বেসরকারি যৌথ ভাবে চলা গুজরাট স্টেট অয়েল কর্পোরেশনের (জিএসপিসি) গ্যাস ক্ষেত্রে বিপুল গ্যাসের ভাণ্ডারের কাল্পনিক গল্প শুনিয়েছিলেন৷ যাতে তাদের শেয়ার বিক্রি হতে পারে৷ প্রভাব খাটিয়ে ওএনজিসিকে দিয়ে তিনি এই প্রকল্পে বিনিয়োগও করিয়েছিলেন৷ পরবর্তীকালে সিএজি রিপোর্ট দেয় এই মিথ্যা গ্যাসভাণ্ডারের গল্প শুনিয়ে কয়েক হাজার কোটি সরকারি টাকা নয়ছয় করা হয়েছে৷ মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নতুন করে ২০১৫–১৬ সালে সরকারি কোম্পানি ওএনজিসিকে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার বাধ্য করে এই দেউলিয়া জিএসপিসি–তে ২০ হাজার কোটি টাকা ঢালতে৷ সম্প্রতি তেলমন্ত্রকের এক সভায় ওএনজিসির প্রতিনিধি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, গুজরাট স্টেট অয়েল করপোরেশনের বকলমে অন্ধ্রপ্রদেশে বিপুল ব্যর্থ বিনিয়োগে তাদের বাধ্য করা না হলে দেশীয় তেলের উৎপাদন খরচ অনেকটাই কমে যেত এবং এই বিনিয়োগের পুরোটাই সরকার করিয়েছে শুধু আদানিদের পাইয়ে দিতে! লুঠের কারবারের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে?
এখন জনসেবক সেজে কংগ্রেসও দাবি তুলছে কর কমিয়ে তেলের দাম কমাও৷ কিন্তু ২০১০ সালের জুন মাসে পেট্রলের দামের উপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তুলে নিয়েছিল কংগ্রেস সরকারই৷ তারপর ২০১৩–র জুন থেকে থেকে প্রতিমাসে ডিজেলের দাম বাড়াতে বাড়াতে ২০১৪–তে তার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তুলে নেওয়ার নীতিটি কংগ্রেসই ঠিক করে গিয়েছিল৷ ২০১৪–র মে মাসে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে বসে এই নীতি পাল্টানো দূরে থাক তারা ওই বছর অক্টোবরে ডিজেলের দামকে পুরোপুরি বিনিয়ন্ত্রণ করে কংগ্রেসের দেখানো পথেই৷ ২০১৭–র ১ মে থেকে প্রতিদিন পেট্রল–ডিজেলের দাম পরিবর্তনের নীতি নেয় নরেন্দ্র মোদি সরকার৷ তারপর থেকে বেশিরভাগ দিনেই বেড়েছে তেলের দাম৷ অর্থাৎ ধনকুবেরদের স্বার্থে বিজেপি কংগ্রেসের ভাব যেন অনেকটা– এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায় দেখ!
তাই বিজেপির মদতে চলা বর্তমান এই লুঠের কারবারের বিরুদ্ধে আর এক লুঠেরা কংগ্রেসকে ডেকে লাভ নেই৷ গড়ে তুলতে হবে বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন৷ ১০ সেপ্টেস্বর দেশজুড়ে বনধের মধ্য দিয়ে যে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে তাকে আরও সংগঠিত রূপ দিতে হবে৷ দেখতে হবে এই আন্দোলনকে যেন ভোটের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ মতলববাজরা না পায়৷
(৭১ বর্ষ ৭ সংখ্যা ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)