৯ মে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে রাশিয়া, চিন সহ বেশ কিছু দেশের শীর্ষ নেতারা সমবেত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত লালফৌজের হাতে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পরাজয়ের ৮০তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করলেন। সমারোহ দেখে কারও মনে হতে পারে, ফ্যাসিস্ট বাহিনীর পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের যে বিজয় এই দিনটিতে ঘোষিত হয়েছিল, এই সব নেতারা বোধহয় সেই ঐতিহ্যকেই বহন করছেন। সে দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হিটলারের নেতৃত্বে আক্রমণ নিছক একটি দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ ছিল না, তা ছিল সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ। সেই সময়কার সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী সহ ২ কোটি সাধারণ মানুষের প্রাণ ও অপরিমেয় ধ্বংসের বিনিময়ে ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে পরাজিত করে শুধু রাশিয়া নয়, গোটা ইউরোপকে রক্ষা করেছিল স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়া। আজ যাঁরা সেই বিজয় দিবস উদযাপন করলেন তাঁরা কি সত্যিই সেই ঐতিহ্যের উত্তরসূরি?
বাস্তবে সকলেই জানেন, বহু বছর আগেই এই দেশগুলি সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদী পথের পথিক হয়েছেন। রাশিয়া, চিন দুই দেশেই প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত। দুই দেশই ইতিমধ্যে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে। রাশিয়ায় সে কাজটি মূলত পুতিনের হাত দিয়েই হয়েছে, ঠিক যেমন চিনে তা শি জিং পিনের হাত ধরে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যে যুদ্ধ তা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। তা হলে এই সব রাষ্ট্রপ্রধানরা বিজয় দিবসের এই উদযাপনে কেন? আসলে সমাজতন্ত্রের আদর্শকে পরিত্যাগ করলেও এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে, ফ্যাসিস্ট বাহিনীর পরাজয়কে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের, বিশ্বের দেশে দেশে শোষিত মানুষের যে আবেগ এখনও অটুট রয়েছে, নিজ নিজ দেশে ক্ষমতা অটুট রাখতে, এই যুদ্ধে জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন পেতে জনগণের সেই আবেগটি তাঁদের প্রয়োজন। এর বেশি কিছু নয়। তাই উদযাপনের এই বিরাট সমারোহে বিজয়ের প্রধান কারিগর, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের নির্মাতা জোসেফ স্ট্যালিনের উল্লেখ কোথাও নেই। কারণ স্ট্যালিন মানে সমাজতন্ত্র। স্ট্যালিন মানে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। স্ট্যালিন মানে শোষণহীন সমাজের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা। স্বাভাবিক ভাবেই পুতিনের রাশিয়াতে কিংবা জিং পিনের চিনে খোঁজ মিলবে না বিজয় দিবসের যথার্থ তাৎপর্যের। সেই তাৎপর্যের সন্ধানে একবার পিছন ফিরে তাকানো যাক।
১৯৪৫ সালের ৮ মে বার্লিনের উপকণ্ঠে সোভিয়েট লালফৌজের কাছে জার্মানির ফ্যাসিস্ট সামরিক চক্রের চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সরকারি ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। যদিও তার ছ’দিন আগে ২ মে রাইখস্ট্যাগে সোভিয়েট রণপতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে বার্লিনের চূড়ান্ত যুদ্ধ শেষ হয়েছিল।
১৯৪৫ থেকে ২০২৫, এই ৮০টি বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির। এ বছর ৯ মে সারা বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী ও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ উদযাপন করেছে অক্ষশক্তির পরাজয়ের ৮০তম বার্ষিকী।
বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তীব্র সংকটকালে ফ্যাসিবাদের উত্থান
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আবার সংকটে পড়েছিল। যুদ্ধে পরাজিত জার্মানির সংকট তীব্র রূপ নিয়েছিল। কারণ, যুদ্ধের শেষে ইংরেজ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা জার্মানির সমস্ত কলোনি বা উপনিবেশগুলি নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিয়েছিল। ইটালি যুদ্ধে ইংরেজ ও ফরাসির পক্ষে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও, তাকে কলোনির ভাগ প্রায় কিছুই দেওয়া হয়নি। ফলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে যে গুরুতর বাজার ও ব্যবসা সংকট দেখা দিল, তার সব চেয়ে বড় ধাক্কা পড়ল ইটালি ও জার্মানিতে। কারণ, তাদের হাতে উপনিবেশ ছিল না যেখানে মাল বিক্রি করে তারা সংকট থেকে উদ্ধার পেতে পারে। হাজারে হাজারে শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। শ্রমিক আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়, ইটালিতে শ্রমিকরা কল-কারখানা দখল করে নেয়। পুঁজিপতি শ্রেণি তখন শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে শ্রমিকদের মধ্য থেকেই পুরনো এক বিশ্বাসঘাতক নেতা মুসোলিনিকে সামনে নিয়ে আসে। সে শ্রমিকদের দমন করার জন্য ধনিক শ্রেণির সাহায্যে একটি দল গড়ে তোলে যার নাম ফ্যাসিস্ট দল।
পুঁজিপতি মালিক শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় মুসোলিনির দলের শক্তিবৃদ্ধি হতে থাকে, কিন্তু সোসাল ডেমোক্রেটিক নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতায় ইটালির শ্রমিকরা এই বিপদ ধরতে পারেনি। নেতাদের নিজেদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে খেয়োখেয়ির জন্য শ্রমিকরা ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
ফলে, ইটালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্টরা শ্রমিক নেতাদের হত্যা করে, কলে-কারখানায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে শ্রমিকদের পরাজিত করে। পুঁজিপতি শ্রেণি আনন্দিত হয়ে ফ্যাসিস্টদের হাতে দেশের সরকারি ক্ষমতা তুলে দেয়। কিন্তু শ্রমিকদের পরাজিত করার দ্বারা বাজার সংকটের কোনও সমাধান করা গেল না। কারণ, পুঁজিবাদ রইলই। ফলে, ইটালির পুঁজিপতি শ্রেণির কাছে কলোনি দখল করা ও তার জন্য ইঙ্গ-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুদ্ধের জরুরি প্রয়োজন দেখা দিল। যুদ্ধের প্রয়োজনেই মুসোলিনির দল দেশের মধ্যে নতুন করে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধের জিগির তুলল।
জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান
ইটালির মতো একই কারণে জার্মানিতেও ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটল। জার্মানিতে তার নাম দেওয়া হল নাৎসিবাদ যা মুসোলিনির জমানার তুলনায় আরও উগ্র, আরও বেশি বর্বর ও নৃশংস রূপ নিল। ১৯১৮ সালে জার্মানিতেও সোসাল ডেমোক্রেটিক শ্রমিক নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে শ্রমিক বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে পুঁজিবাদী বাজার সংকটের ধাক্কা থেকে জার্মানি বাঁচতে পারেনি। মন্দা, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি পুঁজিবাদী সংকটের সমস্ত লক্ষণই সেখানে প্রকট হতে থাকে। তার উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ইংরেজ ও ফরাসিরা প্রতি বছর জার্মানির কাছ থেকে আদায় করে নেওয়ায় জনজীবনের দুর্দশা বেড়ে যায়। ১৯৩০ সালের প্রবল বাণিজ্য সংকট জার্মান জনজীবনে প্রচণ্ড আঘাত করে। অসন্তোষের আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জার্মান শ্রমিকরা পুঁজিবাদকে ধ্বংস করার দাবি তোলে। জার্মান পুঁজিপতি শ্রেণি ভীত হয়ে পড়ে। ধনিক শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়। ১৯৩১ সাল নাগাদ শ্রমিকদের সংঘবদ্ধতা এত বৃদ্ধি পায় যে, জার্মান ধনিক শ্রেণি শ্রমিক আন্দোলন ধবংস করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে হিটলার ‘জাতীয় সোসালিস্ট’ (নাৎসি) নামে একটি দল খুলেছিল। জার্মান পুঁজিপতি শ্রেণি হিটলারের দলের মধ্যেই আশ্রয় খোঁজে ও তাকে সাহায্য করতে থাকে।
শ্রমিকদের মধ্যে অনৈক্য, ইটালির মতো জার্মানিতেও পুঁজিপতি শ্রেণি ও নাৎসিদের সহায়তা করল। হিটলার ভুয়ো সমাজতন্ত্র ও দেশের প্রগতির স্লোগানে শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও বিভ্রান্ত করতে থাকল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানি, ইংরেজ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যে ভার্সাই সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিল, জার্মান জনগণ তার বিরুদ্ধে স্বভাবতই বিদ্বেষ পোষণ করত। হিটলার ভার্সাই সন্ধির বিরুদ্ধে ‘আন্দোলন’ শুরু করল। দীর্ঘকালের কুসংস্কার থেকে ইউরোপের জনগণের মধ্যে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাব কাজ করত। হিটলার তাকেও কাজে লাগাল। হিটলার আওয়াজ তুলল, জার্মানির সকল দুর্দশার জন্য দায়ী হচ্ছে ভার্সাই সন্ধি, ইহুদি ও কমিউনিস্টরা। এই স্লোগানে বিভ্রান্ত করে ১৯১৯ সাল থেকেই ফ্যাসিস্টরা জার্মানিতে লোক সংগ্রহ করছিল। ১৯৩০-৩১ সালের তীব্র ব্যবসা সংকট যখন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের আগুন জ্বালিয়ে দিল তখন জার্মান পুঁজিপতি শ্রেণি ১৯৩৩ সালে হিটলারের নাৎসি দলের হাতে জার্মানির সরকারি ক্ষমতা তুলে দিল, যাতে ফ্যাসিস্টরা সাধারণ জনমতকে বিভ্রান্ত করে শ্রমিকদের ক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু শুধু এর দ্বারা জার্মান পুঁজিবাদকে সংকট থেকে মুক্ত করা সম্ভব ছিল না। ফলে, কলোনি চাই। তাই হিটলার ‘জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব’ ও সমগ্র বিশ্বের উপর তার ‘প্রভুত্ব করার অধিকারের’ আওয়াজ তুলে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করল– যার আসল উদ্দেশ্য ছিল জার্মান পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে উপনিবেশ দখল করা।
একই ভাবে জাপানেও এক ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ঘটল। জার্মানি-ইটালি-জাপান এই তিন ফ্যাসিস্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে প্রধান মিল ছিল এই যে, এদের কারওরই উপনিবেশ ছিল না। তাই উপনিবেশ দখলে একে অপরকে সাহায্য করার জন্য এই তিন শক্তি নিজেদের মধ্যে জোট বাঁধল। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এ ভাবে বাজার নিয়ে কাড়াকাড়ি বা উপনিবেশ রক্ষা ও দখলের দ্বন্দ্ব থেকেই ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছিল। হিটলারের কমিউনিস্ট বা সোভিয়েট বিদ্বেষের মধ্যে গোপনীয়তা কিছু ছিল না। সে প্রকাশ্যেই কমিউনিস্ট নিধনের আওয়াজ তুলল এবং বলশেভিজমকে ‘সভ্যতার শত্রু’ বলে চিহ্নিত করে রাশিয়াকে ধবংস করার ডাক দিল। সে দিন যারা মনে করেছিল যে, হিটলারি ফ্যাসিস্ট আক্রমণ কেবল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হবে, অচিরেই তাদের ভুল ভাঙল এবং দেখা গেল, যা কিছু সত্য সুন্দর ও শুভ, তার বিরুদ্ধেই হিটলারি খড়গ নেমে এল।
মানবজাতিকে ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেছিল লালফৌজ
১৯৩৯ সালে জার্মান বাহিনীর দ্বারা পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তারপর ফ্রান্স পশ্চিম ইউরোপ দখল করে নেওয়ার পর জার্মান বাহিনী ১৯৪১ সালের ২২ জুন আক্রমণ করল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নকে। হিটলার মনে করেছিল, ফ্যাসিস্ট আক্রমণের সামনে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের প্রতিরোধ যেমন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল, ঠিক তেমনই ‘দুর্বল’ সোভিয়েট ইউনিয়নকে ধবংস করার মধ্য দিয়ে, একই সাথে সে বলশেভিজমকে খতম করবে এবং সমগ্র রাশিয়াকে জার্মানির উপনিবেশে পরিণত করবে। জার্মান সামরিক শক্তির বৃহদংশ নিয়োজিত করা হল সোভিয়েটের বিরুদ্ধে। এই সময় জার্মান বাহিনী যদি পশ্চিম রণাঙ্গণে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর কাছে গুরুতর বাধা পেত, তবে হিটলারের পক্ষে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অধিকাংশ শক্তি কেন্দ্রীভূত করা সম্ভব হত না। কিন্তু ব্র্রিটেন ও আমেরিকা পশ্চিমে হিটলারের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকরী পাল্টা আক্রমণ বা যুদ্ধই করেনি। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই চরিত্র ও সম্ভাব্য ভূমিকা হিটলারের অজানা ছিল না। সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জার্মানি আক্রমণ করলে ব্র্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়ে সোভিয়েটের ধবংসই চাইবে, এ কথা বুঝেই হিটলার পশ্চিম ছেড়ে এসে পূর্বে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রায় সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই আক্রমণের তিন বছর পর যখন মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে পরিচালিত সোভিয়েট লালফৌজের হাতে জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়, একমাত্র তখনই ১৯৪৪ সালের জুন মাসে, অর্থাৎ বার্লিন দখলের মাত্র ১০ মাস আগে, ব্রিটিশ-মার্কিন সরকার ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলেছিল। এ ক্ষেত্রেও তাদের লক্ষ্য ছিল, লালফৌজের আগে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী দিয়ে বার্লিন দখল করে যুদ্ধজয়ের গৌরব থেকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নকে বঞ্চিত করা। কিন্তু মহান স্ট্যালিনের রাজনৈতিক-সামরিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি, অভূতপূর্ব রণনীতি ও রণকৌশল এবং সোভিয়েট লালফৌজ ও জনগণের অপরিসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগ ইঙ্গ-মার্কিন চক্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছিল। ৩০ এপ্রিল ও ২ মে বার্লিনে রাইখস্ট্যাগের মাথায় লাল পতাকা ও সোভিয়েট রণপতাকা উড্ডীন করেছিল লালফৌজ। সমগ্র বিশ্বের জনগণের কাছে প্রমাণিত যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুর্ধর্ষ জার্মান সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে মানবজাতিকে ফ্যাসিস্ট শক্তির ধবংসলীলা থেকে রক্ষার প্রধান কৃতিত্ব ও গৌরব সর্বহারার মহান নেতা কমরেড স্ট্যালিনের নেতৃত্বে পরিচালিত সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি, সোভিয়েট লালফৌজ ও সোভিয়েট ইউনিয়নের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উন্নত সমাজতান্ত্রিক আদর্শে ঐক্যবদ্ধ বীর জনগণেরই প্রাপ্য এবং এটা তারা পেরেছে উন্নততর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই যা পুঁজিবাদী সংকট থেকে মুক্ত ছিল।
এ জন্য কী অসীম মূল্য সোভিয়েট জনগণকে দিতে হয়েছিল, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে মোট ৩২০ ডিভিসন জার্মান সৈন্যের মধ্যে একমাত্র পূর্ব রণাঙ্গনেই ২০৬ ডিভিসন জার্মান সৈন্য লালফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯৪৪ সালের জুন মাসে পশ্চিম ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার সময়েও ১৫৭ ডিভিসন জার্মান সৈন্য ছিল পূর্ব রণাঙ্গনে। ১৯৪৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৩০ ডিভিসন। বাকি ডিভিসনগুলি ছিল ব্রিটেন, ইটালি ও আটলান্টিকে ছড়িয়ে। এই সৈন্য সংখ্যাই বলে দেয় যে, জার্মান সমরশক্তির বিরুদ্ধে আসল লড়াই করেছিল লালফৌজ এবং ইউরোপের যুদ্ধের এটাই ছিল মর্মকথা। এই ভয়াবহ লড়াইয়ে ২ কোটি রুশ জনগণ প্রাণ দিয়েছিল, লক্ষ কোটি ঘরবাড়ি ও খামার ধবংস হয়েছিল। ইউরোপীয় রাশিয়ার এক-তৃতীয়াংশ জমি যার মধ্যে শিল্পাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল, ধবংস হয়ে গিয়েছিল। এমন একটি পরিবার ছিল না, যার কেউ না কেউ যুদ্ধে প্রাণ দেয়নি। এমন অপরিমেয় আত্মত্যাগের বিনিময়েই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়ন গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করেছিল। মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে এই জয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও সাম্যবাদী আদর্শের জয় ছিল বলেই তা দুনিয়া জুড়ে স্বাধীনতার আন্দোলন ও শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি আন্দোলনে অভূতপূর্ব জোয়ার সৃষ্টি করে দিয়েছিল যা দেখে ভীত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই সোভিয়েট বিরোধী ঠাণ্ডা যুদ্ধের সূচনা করেছিল। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার ছড়ানোর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং প্রচারশক্তিকে নিযুক্ত করেছিল।
ফ্যাসিবাদ এখন পুঁজিবাদের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য
শুধু তাই নয়, দুদিন আগেও যে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী দেশগুলি গণতন্ত্রের ধবজা উড়িয়েছিল, যুদ্ধ শেষ হতেই নিজ নিজ দেশে শ্রমিক আন্দোলন থেকে পুঁজিবাদকে রক্ষা করতে সেই ফ্যাসিবাদকেই তারা ভিন্ন রূপে কায়েম করল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হল ফ্যাসিবাদ। এ দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান-ইটালি-জাপান ফ্যাসিস্ট চক্রের সামরিক ভাবে পরাজয় ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু তার থেকে এ রকম সিদ্ধান্ত করা ভুল যে, ফ্যাসিবাদ দুনিয়া থেকে মুছে গেল। বরং ঘটনা এই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যখন তৃতীয় তীব্র সাধারণ বা সামগ্রিক সংকটে পড়েছে, তখন প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের শাসন ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদ স্থায়ী বৈশিষ্টে্য পরিণত হবে। সাথে সাথে তিনি আরও বলেন যে, ফ্যাসিবাদকে কেবল একটি অত্যাচারী নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা মনে করা ভুল হবে। জনগণকে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করা ফ্যাসিবাদের একটি অন্যতম হাতিয়ার। তাই সমগ্র বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণকে এ সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দর্শন-আদর্শ-সংস্কৃতি প্রভৃতি সকল দিক জড়িয়ে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
আজ আমরা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট সামরিক শক্তির পরাজয়ের ৮০তম বর্ষ পূর্তি উদযাপন করছি, তখন আমাদের দেশ সহ বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলির আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও সমগ্র বিশ্বের সাধারণ পরিস্থিতি থেকে কি এই সত্যই স্পষ্ট নয় যে, সমগ্র মানবসভ্যতা আজ, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙনের পর ফ্যাসিবাদের গভীরতর বিপদের সম্মুখীন? সোভিয়েট ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ভাঙনের পর বিশ্বে পুঁজিবাদী বাজার ভৌগলিক দিক থেকে বিস্তার লাভ করলেও, তার দ্বারা পুঁজিবাদের মৌলিক সংকট দূর হয়নি, বরং সমগ্র পুঁজিবাদী বাজারের অন্তর্নিহিত তীব্র সংকটের আসল কদর্য চেহারাটাই এখন বাইরে ফুটে বেরিয়েছে। পাশাপাশি, শ্রমিক-জীবনে বেকারি ও মজুরি হ্রাস, শ্রম-সময় বৃদ্ধি, অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়ার ঘটনা এখন বিশ্বের প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশেই ব্যাপক রূপ নিয়েছে। ফলে শ্রমিক বিক্ষোভও বাড়ছে। এমনকি পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির শ্রমিক শ্রেণি, যাদের ওই সব দেশগুলির শাসক শ্রেণি বিশ্ব লুঠ করা অর্থের জোরে এতকাল কিছু কিছু ঘুষ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল, এখন পুঁজিবাদী সংকটের ধাক্কায় সেই শ্রমিক শ্রেণিরও ঘুম ভাঙছে, তারাও পথে নামছে, ধর্মঘট করছে। ইউরোপ জুড়ে দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলনের ঢেউ উঠছে। ভারতের মতো পুঁজিবাদী দেশের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি বিশ্ববাজারে প্রবেশের আকাঙ্খা ও চাহিদা থেকে বাইরের শক্তিমান সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে যে উদার আর্থিক নীতি গ্রহণ করেছে, তার চাপ পড়েছে ভারতের জনজীবনে। ছাঁটাই, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান।
পুঁজিবাদী বিশ্ব আজ তীব্রতর শোষণ ও যুদ্ধের গভীর বিপদের সম্মুখীন
এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের শাসকরাই সংকট থেকে মুক্তি পেতে শ্রমিক শ্রেণির উপর যেভাবে আরও শোষণের খড়গ নামিয়ে আনছে, তা চরিত্রে ফ্যাসিবাদী ছাড়া কিছু নয়। আবার আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, তীব্র ব্যবসা সংকটে জর্জরিত ইটালি-জার্মানি ও জাপ পুঁজিপতি শ্রেণির উপনিবেশ দখলের উদগ্র চাহিদা এবং ব্রিটিশ, ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নতুন উপনিবেশ দখলের তাগিদ– এই দুইয়ের সংঘাত থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলি সহ সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী সব দেশই গুরুতর বাজার-সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের আক্রমণের পিছনে যেমন সমস্ত শক্তি নিয়ে আমেরিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে তেমনই ভারতের মতো বহু দেশই এই যুদ্ধে অস্ত্র ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহের দ্বারা মুনাফা লুটছে। একই ভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার উল্টো দিকে ইউক্রেনের পিছনে যেমন মার্কিন অস্ত্র এবং অর্থ কাজ করেছে তেমনই ইউরোপের প্রায় সব সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রই এই যুদ্ধে বিপুল বিনিয়োগের দ্বারা লাভবান হয়ে চলেছে। তেমনই মার্কিন-চিন বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিই একদিন বাজার সংকট থেকে বাঁচতে যে বিশ্বায়নের নীতির আশ্রয় নিয়েছিল, তাতে সংকট তো মেটেইনি উপরন্তু তা আরও তীব্র্র আকার ধারণ করেছে। তাই সেই বিশ্বায়নের নীতিকে তার প্রবক্তারাই আজ ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে, সবাই নিজ নিজ দেশে তথা বাজারে শুল্ক প্রাচীর তুলে বাঁচতে চাইছে। সম্প্রতি আমরা দেখলাম ভারত এবং পাকিস্তানের পুঁজিপতি শ্রেণির এই সংকট থেকে রেহাই পাওয়ার মরিয়া চেষ্টায় কী ভাবে পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হল এবং দেশের জনগণের একটা অংশকে যুদ্ধোন্মাদনায় জড়িয়ে ফেলল।
তাই আজ বিশ্বের জনসাধারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয়ের ৮০তম বর্ষপূর্তি পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও যুদ্ধের বিপদ থেকে মুক্ত অবস্থায় পালন করছে না, বরং তারা এখন তীব্রতর শোষণ ও যুদ্ধের গভীর বিপদের সম্মুখীন। সর্বোপরি, বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের গুরুতর বিপর্যয়ে দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি ও শোষিত জনগণের মধ্যে আদর্শগত বিভ্রান্তি শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান দুর্বলতা রূপে কাজ করছে।
এই পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদের সামরিক পরাজয়ের ৮০তম বর্ষপূর্তি উদযাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকার শ্রেণিসংগ্রামের লাইনকে, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শগত লড়াইয়ের মর্মকথাকে ধরতে পারে এবং সেই অনুযায়ী শ্রেণি চেতনাকে উন্নত করতে পারে, তবে তার দ্বারাই শ্রমিক শ্রেণি আবার তাদের সংগ্রামের সঠিক পথ ও আদর্শের সন্ধান পাবে। একই ভাবে বর্তমান বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় শান্তিকামী, যুদ্ধবিরোধী জনগণ যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলিকে সঠিক ভাবে অনুধাবন করেন, তবে তাঁরাও দেখবেন যে, কমরেড স্ট্যালিনের নেতৃত্বে বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের জয়যাত্রা ও দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠার ফলেই সে দিন যুদ্ধের বিরুদ্ধে জঙ্গি শান্তি আন্দোলন গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল যা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে অন্যতম কার্যকরী বাধা রূপে কাজ করেছিল। ফলে আজকের বিশ্বেও যদি বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনকে রুখতে হয়, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ভয়াবহ ধবংসলীলা থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে হয়, তবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সমগ্র বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী গণতন্ত্রপ্রিয় শান্তিকামী জনগণের ব্যাপকতম অংশকে জড়িত করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শান্তি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমরা আশা করি বিশ্বের সর্বত্র শ্রমজীবী ও যুদ্ধবিরোধী জনগণ এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় এর ৮০তম বার্ষিকী উদযাপন করবেন।
লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ১৮ এপ্রিল ২০২৫ এ প্রকাশিত