এক বাংলা দৈনিকের সম্পাদকীয়তে ‘অপ্রস্তুত’ শিরোনামে প্রশ্নটা এসেছে৷‘গত মাসে মুর্শিদাবাদের মালদহগামী বাসটি দৌলতাবাদে সেতু হইতে জলে পড়িবার পর যাহা ঘটিল, তাহা আরও বিস্ময়কর৷ নদীতে নিমজ্জিত বাসটি উদ্ধারের কাজ শুরুই হয় বিস্তর বিলম্বে৷ মুর্শিদাবাদ জেলায় ডুবুরি মিলে নাই, ক্রেন জোগাড় করিতে সময় লাগিয়াছে তিন ঘন্টারও অধিক৷ যে কয়জন প্রাণে বাঁচিয়াছেন, ওই এলাকার মৎস্যজীবীদের সহায়তায়৷ … ইহা প্রশংসাযোগ্য সন্দেহ নাই৷কিন্তু যাঁহারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁহারা দায় পালন না করিলে তাঁহাদের কী ব্যবস্থা নেওয়া হইবে? মুর্শিদাবাদে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে ইতিপূর্বে৷ জলঙ্গীতে বাস জলে পড়িয়াছিল ১৯৯৮ সালে, বহরমপুরে ১৯৯৯ সালে৷ বেলডাঙায় গত মাসেই পুকুরে বাস পড়িয়াছিল৷ অথচ মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রশাসনের নিজস্ব ডুবুরি নাই, মোটরবোট নাই, ক্রেন কোথা হইতে দ্রুত মিলিবে তাহার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নাই৷’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ৯/২/১৮)৷ আরও গুরুতর প্রশ্ন আছে৷ দৌলতাবাদের বাস দুর্ঘটনার জন্য একহাতে মোবাইল ফোন, অন্য হাতে স্টিয়ারিং ধরা ড্রাইভারের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়েছে৷জেলা প্রশাসনও মৃত ড্রাইভারের বিরুদ্ধে গুরুতর মামলা রুজু করে দায় সেরেছে৷ সারা মুর্শিদাবাদ জেলাতেই রাজ্য সড়ক, জাতীয় সড়কের অবস্থা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর৷ সড়কগুলি প্রতিদিনই পথদুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর সাক্ষী৷ বহরমপুরের লাগোয়া ৩৪ নং জাতীয় সড়কের অন্তর্গত ভাগীরথীর ওপর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সেতু, যা ভেঙে ১৯৯৯ সালের ৫ মে গভীর রাতে ২৬ জনকে নিয়ে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের বাস তলিয়ে যায়–সেই সেতু জুড়ে মৃত্যুখাদ৷ দৌলতাবাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটি যে রুট দিয়ে আসছিল– ডোমকল থেকে চোদ্দোমাইল পর্যন্ত মাসখানেক আগেই রাস্তা সারানো হয়েছে–ইতিমধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে রাস্তার কঙ্কাল৷ ক’দিন আগেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্রিজের কাছে বাস উল্টেছে, লরি পাল্টি খেয়েছে৷ এমনকী দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্রিজের আগেই গর্ত আছে, পরে তড়িঘড়ি বোজানো হয়েছে৷ বাসটি প্রচণ্ড গতিতে আসতে গিয়ে গর্তে পড়ে চাকার স্প্রিং ভেঙে কিংবা স্টিয়ারিং বক্স বিকল হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জলে পড়েনি তো? বাসটির ফরেনসিক তদন্তের দাবি উঠেছিল৷ তদন্তকারী দলও নাকি এসেছিল৷ কিন্তু কোথায় তদন্ত? জল থেকে তোলা বাসটিই নাকি উধাও৷
সংবাদে প্রকাশ, রাজ্য পরিবহন দপ্তর বহরমপুর পুরসভাকে বাসটি উপহার দিয়েছিল৷ পুরসভা বেসরকারি ‘বঙ্গ ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস’ সংস্থাকে ছ’মাসের চুক্তিতে চালাতে দিয়েছিল, চুক্তির সময় শেষ হলেও নবীকরণ হয়নি৷ এরপর সেই সংস্থা বক্সিপুরের দুই ভাইকে মৌখিক চুক্তিতে চালাতে দেয়৷ শর্ত, প্রতিদিন নির্দিষ্ট টাকা দাও, তারপর লাভ কর৷ যথার্থ মালিকানাহীন, দায়দায়িত্বহীন, রক্ষণাবেক্ষণ হীন, আদিম লেনদেনের মৌখিক শর্তে বাসটি যাতায়াত করেছে অসংখ্য মানুষের জীবন বাজি রেখে৷ শোনা যাচ্ছে চুক্তিপত্রে এই নম্বরের বাসেরই উল্লেখ নেই, আছে অন্য বাস৷ এই দায়িত্বহীন উদাসীনতার দায় কে নেবে? মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার–তৎপরতায় আগমন, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা এতগুলি জীবন ফিরিয়ে দেবে কি? প্রিয়জন হারানো মানুষের হাহাকারের সচিত্র বিবরণ আর ক্ষতিপূরণের ঘোষণায় ভোটের বাজারে শাসকের লাভ হতে পারে, অসহায় মানুষের লাভ নেই৷