এমন করে যে অসমুদ্র–হিমাচল আন্দোলনে, প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠবে তা ছিল শাসকদের ভাবনার অতীত৷ সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণির একের পর এক আক্রমণে শোষিত, নিপীড়িত মানুষ ক্ষোভে, ঘৃণায় শাসকদের উপর তেতে উঠছিল, এ কথা ঠিকই৷ তবু মানুষের ঝিমুনির কাটছিল না৷ আর এতেই শাসক শ্রেণি ধরে নিয়েছিল, তারা দেশের মানুষকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে, নৈতিক ভাবে পঙ্গু করে রাখতে, অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসে বুঁদ করে রাখতে, সবার উপরে, আন্দোলন বিমুখ করে রাখতে যে সব কায়দা নিয়ে চলেছে, মানুষের এই নিষ্ক্রিয় হতাশ মনোভাব বোধহয় তারই সুফল৷ অবশ্য সব যুগেই শাসকরা এমন ভ্রান্তিবিলাসে ভোগে যে তারা চিরকাল মানুষকে এমনই নিশ্চুপ আত্মসমর্পণের মধ্যেই আটকে রাখতে পারবে৷ তা যদি সত্যিই হত তবে সভ্যতার ইতিহাস অন্য ভাবে লেখা হত৷ শাসক শ্রেণি এবং তাদের তল্পিবাহকরা চায় এই ভাবেই তাদের ধূর্ততা, চাতুরি, স্বৈরাচার এবং দমনমূলক আচরণের দ্বারা জনগণের ইচ্ছা এবং তৎপরতাকে স্তব্ধ করে দেবে এবং ইতিহাসের অনিবার্য গতিপথকে আটকে দিয়ে ক্ষমতার গদিতে অটুট থাকবে৷ তারা স্মরণে রাখে না, জনগণের অন্তরে জমাট ক্ষোভের বারুদে একবার বিস্ফোরণ শুরু হলে তা এই সব তুচ্ছ প্রতিরোধকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে, ভেঙে ফেলবে শাসক শ্রেণির সব শৃঙ্খলকে৷ আজ তেমনটাই ঘটছে৷
শাসক আরএসএস–বিজেপি এবং এবং তাদের প্রভু দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি আজ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কীভাবে জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি থেকে লাভাস্রোত অবিরাম বেগে বেরিয়ে আসছে৷ নোট বাতিল এবং জিএসটি চালুর ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি, ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধি, তেলের দামবৃদ্ধি, ব্যাঙ্কের সুদ কমানো, পুঁজিপতিদের জন্য ব্যাপক করছাড়, কর্পোরেট করছাড়, ব্যাঙ্কগুলি থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ পুঁজিপতিদের ছেড়ে দেওয়া, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, বাড়তে থাকা কৃষক আত্মহত্যা, ব্যাপক বেকারি এবং ছাঁটাই, মহিলাদের উপর আক্রমণ, গোরক্ষার নামে গণহত্যার মতো অপরাধ বাড়তে থাকা, যথেচ্ছ মানবাধিকার হরণ, সর্বব্যাপক দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে জনমনে ক্ষোভের বারুদ জমা হয়ে চলেছিল৷ জনগণের এই ক্ষোভের কথা শাসকদের অজানা নয়৷ এই ক্ষোভকে ধামাচাপা দিতে, অর্থনীতির এই ভয়াবহ দুরবস্থা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে এবং সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের প্রতিবাদ–প্রতিরোধক্ বিপথগামী করতে শাসক আরএসএস–বিজেপি ধর্ম–বর্ণ–জাতকে ভিত্তি করে তাদের বিভক্ত করার ধূর্ততা ক্রমাগত চালিয়ে যাচ্ছে৷ এই লক্ষ্য থেকে যখন তারা এনআরসি নিয়ে এল, তা আপামর জনগণের মধে নাগরিকত্ব হারানোর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল৷ ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলল৷ এবার আতঙ্কিত হল শাসক শ্রেণি৷ আন্দোলনের মধ্যে হিন্দু–মুসলমানে বিভাজন তৈরি করে আন্দোলনকে ভাঙতে তারা মুসলমান ছাড়া বাকি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার নাম করে নিয়ে এল সিএএ৷
কিন্তু শাসক শ্রেণির ছল মানুষ ধরে ফেলল৷ কোনও রাজনৈতিক দলের অপেক্ষা না রেখে ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়ল আন্দোলনে৷ প্রবল ঠাণ্ডা তুচ্ছ করে সন্তান কোলে মায়েরা নেমে এলেন রাস্তায়৷ এই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ছাত্র–যুবদের অংশগ্রহণ৷ বিশেষত মেয়েরা এই আন্দোলনে যে সাহস দেখাল তা খুবই প্রেরণাদায়ী৷ ছাত্র–শিক্ষক–বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞানী-ইতিহাসবিদ-চিকিৎসক-লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী-আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমানরাও শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যোগ দিলেন শ্রমিক–চাষি সহ সব ধরনের মানুষের গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী কনভোকেশনের মঞ্চে সিএএ–র কপি ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানালেন৷ দিল্লির শাহিনবাগের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে৷ কলকাতায় প্রথমে পার্কসার্কাসে, পরে জ্যাকারিয়া স্ট্রিটে একই রকমের আন্দোলন জনগণের অংশগ্রহণে মানুষের মনে প্রবল নাড়া দিল৷
এই আন্দোলন প্রমাণ করে দিল যে দেশের মানুষ নীরবে বিজেপির প্রতারণা, বিভ্রান্তির রাজনীতি মেনে নেবে না৷ সমস্ত রকমের অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক চিন্তার প্রসারকেও যে তারা মানবে না, তা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ঘোষণা করল৷ স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি সরকার এবং শাসক শ্রেণি আন্দোলন দমন করতে আন্দোলনকারীদের উপর তাদের হিংস্র দাঁত–নখ প্রয়োগ করতে দ্বিধা করল না৷ আলিগড়ে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে, জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসকেরা ছাত্রদের উপর বীভৎস অত্যাচার নামিয়ে আনল৷
পশ্চিমবাংলায় আন্দোলন ব্যাপক রূপ নিল৷ প্রধানমন্ত্রী বললেন, তিনি পোশাক দেখেই বুঝতে পারছেন আন্দোলন কারা করছে৷ আন্দোলনে তিনি সাম্প্রদায়িক রঙ চাপানোর চেষ্টা করলেন৷ অমনি হিন্দু ছাত্র–ছাত্রীরা মুসলমান পোশাক পরে আর মুসলমান ছাত্র–ছাত্রছাত্রীরা হিন্দু পোশাক পরে আন্দোলনে আসতে থাকল৷ আন্দোলনে ভাঙচুরের ঘটনার তীব্র নিন্দায় যখন শাসকরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তখন দেখা গেল এক দল বিজেপি কর্মী লুঙ্গি এবং টুপি পরে ট্রেনে ঢিল ছুঁড়ছে৷ স্থানীয় মানুষ আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার এই চক্রান্ত ধরে ফেলল৷
এই আন্দোলনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, আরএসএস–বিজেপি এবং তাদের সরকারের আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির সব রকমের চেষ্টা সত্ত্বেও আন্দোলনে হিন্দু–মুসলমানের তথা নানা ধর্ম–বর্ণের শোষিত মানুষের ঐক্যের অটুট ছবি৷ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে৷ সাধারণ মানুষ যখনই জীবনের সাধারণ দাবিগুলি নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নামে তখনই সংহতি এবং সৌভ্রাতৃত্ব লৌহ-দৃঢ় হয়ে ওঠে৷ ন্যায্য দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনের সাংস্কৃতিক পরিবেশ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা, জাত্যাভিমান, জাতিবাদী মানসিকতা– যেগুলি প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা আন্দোলনে বিভাজন আনতে ছড়িয়ে দেয়, সেগুলি থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে৷
এর জন্য প্রয়োজন জনগণের রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হওয়া, ঠিক–ভুল ধরতে পারার ক্ষমতা অর্জন করা, উচিত–অনুচিত ধরতে পারা, ছদ্মবেশী শত্রুকে চিনতে পারা এবং আন্দোলনকে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে সঠিক রাস্তায় সংগ্রাম গড়ে তোলা৷ এই জন্যই গণআন্দোলনকে সুসংহত, সুশৃঙ্খল এবং সঠিক নেতৃত্বে গড়ে তোলার বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা শুধু সফলতার জন্যই প্রয়োজনীয় নয়, সংগ্রামী জনতার কাঙ্খিত রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলার জন্যও প্রয়োজনীয়৷ কিন্তু তা হল না৷ ফলে আন্দোলন বাস্তবে দিশহীনই রয়ে গেল৷
আন্দোলন যখন গতি পেল অমনি ভোটবাজ বুর্জোয়া–পেটি বুর্জোয়া দলগুলি এর থেকে ফয়দা তুলতে মৌমাছির মতো ঘুরঘুর করতে শুরু করে দিল৷ কংগ্রেস, শাসক একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দল, এতদিন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে৷ ক্ষমতায় থাকার সময়ে একের পর এক জনবিরোধী নীতি নিয়েছে, শ্রেণি সংগ্রাম এবং গণআন্দোলনকে নির্মম ভাবে দমন করেছে, গণআন্দোলনের শত শত কর্মীকে হত্যা করেছে, নরম হিন্দুত্বের নামে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছে এবং অজস্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছে৷ একই ভাবে জরুরি অবস্থা জারি করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে৷ একই রকম ভাবে বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা চালিয়েছে এবং একের পর এক কালা কানুন জারি করেছে৷ কংগ্রেস রাজত্বেও অসংখ্য বড় বড় দুর্নীতি এবং কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে৷ ফলে কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল৷ সেই কংগ্রেসই এখন গণতন্ত্রের, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে, উত্তাল গণআন্দোলনের পক্ষে সহানুভূতি জানাচ্ছে৷ ফলে এ কথা কোনও ভাবেই ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতের শোষণমূলক পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষায় কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়েই ফ্যাসিবাদ কায়েমের শক্তি৷ বাস্তবিক, আজ যে দলই পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে চলবে তার চরিত্র ফ্যাসিবাদী হতে বাধ্য৷ উল্লেখ্য, গত শতকের চারের দশকের শুরুতে যখন সিপিআই সহ সব রাজনৈতিক দলগুলিই মনে করছিল ভারতে ফ্যাসিবাদ আসবে না, তখন আমাদের দলের নেতা, শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক, এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ মার্কসবাদী চিন্তাপদ্ধতিতে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন, সমস্ত পুঁজিবাদী–সাম্রাজ্যবা দেশে ফ্যাসিবাদ সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখা দিয়েছে৷ আরও ব্যাখ্যা করে তিনি দেখান, ভারতে ফ্যাসিবাদ রয়েছে বিশ্বাসের তত্ত্বে, ‘বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ তর্কে বহু দূর’ এমন আপ্তবাক্যে, যার দ্বারা মানুষের মনকে যুক্তিবিচারের বিজ্ঞানসম্মত পথ থেকে সরিয়ে অন্ধ বিশ্বাস, পূর্বধারণা আর রহস্যবাদের কানাগলিতে ঠেলে দেওয়া হয়৷ শ্রেণিসংগ্রাম ও সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরুদ্ধে জনমনকে বিষিয়ে তুলতে উগ্র জাতিবাদের স্লোগান তুলেছে এবং একই সঙ্গে দমন নীতি ও ভুল বোঝানোর দুমুখো রাস্তা নিয়েছে৷ ফ্যাসিজম সম্পর্কে বলতে গিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, গুটিকয়েক পুঁজিপতির হাতে ক্রমাগত বেশি বেশি পুঁজির কেন্দ্রীভবন ফ্যাসিবাদেরই চরিত্র–লক্ষণ৷ বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদের আদর্শগত ভিত্তি হল অধ্যাত্মবাদ এবং বিজ্ঞানের কারিগরি দিকের অদ্ভুত মিশ্রণ৷ তাঁর এই বিশ্লেষণ আজ ভবিষ্যৎবাণীর মতো শোনাচ্ছে৷
তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক নানা দলও এই সময়ে মিটিং–মিছিল করতে নেমে পড়েছে এবং পুঁজিবাদী মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার কুড়িয়ে চ্যাম্পিয়ান সাজতে চাইছে৷ অথচ ক্ষমতায় থেকে এই দলগুলিই কি পুঁজিবাদী নীতিগুলিকে কার্যকর করছে না এবং সব রকমের গণআন্দোলনকে দমন করছে না? জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার কোনও প্রচেষ্টা কি এই দলগুলির আছে? নাকি এই দলগুলি সবাই আন্দোলনে আছে এটা দেখিয়ে পরের ভোটে জিততে চাইছে? শেষ পর্যন্ত ভোটের বাক্সে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আন্দোলনের আর কোনও উদ্দেশ্য তাদের আছে কি? বাস্তবিক, ছাত্র–যুবরা, সাধারণ মানুষ যখন এই আন্দোলনে রক্ত ঝরাচ্ছে, বুলেটের সামনে বুক পেতে দিচ্ছে, মৃত্যুবরণ করছে, তখন ভোটবাজ এই দলগুলি এই আত্মদান থেকে নির্বাচনে কতখানি ফয়দা তোলা যাবে তার হিসেব কষছে৷
বাস্তবিক এ এক কঠিন পরিস্থিতি৷ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে সামনে রেখে সব স্তরের শোষিত মানুষকে জড়িত করে সঠিক বামপন্থী লাইন এবং সঠিক বামপন্থী নেতৃত্বে শক্তিশালী সংগঠিত গণআন্দোলনের অনুপস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী শক্তি মাথা তুলছে৷ ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী বাম–গণতান্ত্রিক গণআন্দোলন এই মুহূর্তের জরুরি প্রয়োজন৷ এই লক্ষ্য থেকেই, মার্কসবাদ–লেনিনবাদ ঘোষের চিন্তাধারায় পরিচালিত আমাদের দল বার সিপিএম–সিপিআইয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছে যাতে ভোটকেন্দ্রিক বুর্জোয়া রাজনীতির বিকল্প হিসাবে সংগ্রামী বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ এক বাম–বিকল্প জনগণের সামনে উপস্থিত করা যায়৷ কিন্তু তারা আমাদের প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি৷ এবারও আমরা বাম–গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তুলে এই উত্তাল গণআন্দোলনকে বামপন্থী আন্দোলনের রূপ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যাতে বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি দলগুলিকে এই আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং আন্দোলনকে উন্নত বামপন্থী নীতি এবং সংস্কৃতির ভিত্তিতে এক দীর্ঘস্থায়ী সংগঠিত সংগ্রামী রূপ দিয়ে দাবি আদায়ের জায়গায় যাওয়া যায়৷ এই লক্ষ্য থেকেই আমরা চলমান এনআরসি–সিএএ বিরোধী আন্দোলনে আরও সাতটি দাবি যোগ করেছিলাম৷
কিন্তু তাঁরা আমাদের আবেদনে সাড়া দেননি৷ বরং সিপিএম নেতৃত্ব আমাদের এড়িয়ে চলছেন৷ একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি না হওয়া সত্ত্বেও অবিভক্ত সিপিআই গত শতকের ছয়ের দশকে পশ্চিমবাংলায়, কেরলে, অন্ধ্রপ্রদেশে এবং আরও কয়েকটি রাজ্যে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল৷ কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতায় গিয়ে তারা সংগ্রামের পথ ত্যাগ করে৷ তারপর থেকে তারা আর কোনও শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলেনি শুধু নয়, এমনকি গড়ে ওঠা গণআন্দোলনগুলিতে অংশগ্রহণ করতে এবং তাতে নেতৃত্ব দিতেই অস্বীকার করেছে৷ তারা এখন শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির বিশ্বস্ত দল কংগ্রেসের সঙ্গে এবং রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলির বুর্জোয়া দলগুলির সঙ্গে জোট গড়ে তুলছে যাতে নির্বাচনে কিছু আসন জোগাড় করা যায়৷ বামপন্থার নামে যে রাজনীতির তারা আজ চর্চা করছে তা বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার, যা এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন, তার থেকে বহু দূরে৷ পরিবর্তে তারা বিরোধী সব দলগুলির সঙ্গে এমন জোট গড়ে তুলছে যার লক্ষ্য বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে কিছু আসন জোগাড় করা৷ আমাদের সঙ্গে জোট ভেঙে দেওয়া এবং যুক্ত আন্দোলনে না আসার এটাই কারণ৷
এখানে উল্লেখ করা দরকার, জেপি আন্দোলন, যা এক সময় কংগ্রেসের দুর্নীতি, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, স্বৈরাচার প্রভৃতির বিরুদ্ধে ছাত্ররাই গড়ে তুলেছিল, যা একটা বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই আন্দোলনে আমরা সিপিএম এবং সিপিআইকে যুক্ত হওয়ার এবং আন্দোলনে বাম নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলাম যাতে আন্দোলন থেকে দক্ষিণপন্থী বুর্জোয়া দলগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা যায়৷ কিন্তু সেই আহ্বন ব্যর্থ হয়েছিল৷ সিপিআই সেদিন সরাসরি কংগ্রেস জোটে যুক্ত হয়েছিল, আর সিপিএম তলায় তলায় ইন্দিরা সরকারের সাথে বোঝাপড়া গড়ে তুলেছিল৷ তারা অজুহাত তুলেছিল, যেহেতু এই আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক জনসংঘের মতো (বর্তমানে বিজেপি) অতি দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি রয়েছে তাই জনগণের ন্যায্য দাবিতে গড়ে উঠলেও তারা এই আন্দোলনে যোগ দেবে না৷ আর এই সুযোগে আন্দোলনের নেতৃত্বের দখল নিয়েছিল দক্ষিণপন্থীরা এবং আন্দোলনের কৃতিত্বকে আত্মসাৎ করে ’৭৭ সালে ক্ষমতায় বসেছিল৷ এই সিপিএম নেতারা যখন দেখলেন, পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী জনতা দল, যা জনসংঘকে নিয়েই গড়ে উঠেছে, তা ক্ষমতায় বসতে চলেছে, তখন তারা পুরো একটা ডিগবাজি খেয়ে কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান তুলে সেই জনতা দলে গিয়ে ঢুকলেন৷ তাদের এই সুবিধাবাদী রাজনীতিই বিজেপিকে সামনে আসার এবং বুর্জোয়া রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী দলে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিল৷ এই ভাবে সেদিন একিট সত্যিকারের সংগ্রামী বাম বিকল্প গড়ে তোলার এক কার্যকরী সুযোগ হাতছাড়া হল৷
আজ আবার এনআরসি–সিএএ বিরোধী দেশজোড়া আন্দোলনে যুক্ত বামপন্থী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার তেমনই একটি সুযোগ উপস্থিত হয়েছে৷ উত্তাল আন্দোলন দেখিয়ে দিচ্ছে জনগণের মধ্যে আন্দোলনের মানসিকতা প্রবল৷ এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কাঙ্খিত বাম–গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তোলা যায় এবং দেশজোড়া শ্রেণি সংগ্রাম এবং গণআন্দোলকে তীব্র রূপ দেওয়া যায়৷ কিন্তু এই অবস্থায়ও সিপিএম সংগ্রামী বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি কোনও আগ্রহই দেখাচ্ছে না৷ পরিবর্তে জনগণের কাছে ঘৃণিত কংগ্রেসের এবং আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলির লেজুড়বৃত্তিতেই তার আগ্রহ বেশি৷ উল্লেখ্য, এই সিপিএম আসামে এনআরসি সমর্থন করেছে৷ এই অবস্থায় সিপিএম সিপিআইয়ের আপসকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের দল পূর্ণ শক্তি নিয়ে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং জনগণের কমিটি গড়ে তুলে সাহসী যুবকদের নিয়ে ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মধ্যে জনগণের শক্তির জন্ম দেওয়ার এবং কাঙ্খিত সংগ্রামী বামপন্থী আন্দোলনে পরিণত করার সমস্ত রকম চেষ্টা করছে৷ কোনও রকম মিডিয়া প্রচার ছাড়াই রাজ্যে রাজ্যে মানুষ আমদের সংগ্রামী চরিত্রের কথা জানে৷ আমরা শ্রেণি সংগ্রাম এবং গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷ আমরা পুনরায় সিপিআইএম নেতৃত্ব সহ তাদের সমর্থকদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি সুবিধেবাদী ভোট রাজনীতি ত্যাগ করে বর্তমান এনআরসি–সিএএ বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ বিকল্প বাম বিকল্প গড়ে তুলতে এবং সেই নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলনকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে তাঁরা সময়ের আহ্বানে সাড়া দিন এবং তাঁদের রাজনৈতিক সততার পরিচয় দিন৷