কর্ণাটকের রাইচুর জেলা থেকে শরৎ সদনের সেমিনারে এসেছেন মাল্লানগৌড়া, গরিব কৃষক পরিবারের তেইশ বছরের তরুণ। জেলার বিদ্যানিধি কলেজে পড়তেন তিনি। কলেজের প্রিন্সিপালের সংস্পর্শে এসে এসইউসিআই(সি)-র সাথে তার পরিচয়। কৃষি সংক্রান্ত তিনটি কালা আইন আসার পর দেশে যে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় তার আহ্বানে মাল্লানগৌড়া চাষিদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। মূলত তুলো চাষিদের মধ্যে তার কাজ। তাদের নিয়ে জোরদার করেন এআইকেকেএমএস-এর সংগঠন।
এআইকেকেএমএস-এর সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে ১১ মার্চ হাওড়া শরৎ সদনে এক আন্তর্জাতিক সেমিনার হল। ‘কৃষিক্ষেত্রে বহুজাতিকের আক্রমণ ও কৃষক আন্দোলন’– এই ছিল সেমিনারে আলোচ্য। মাল্লানগৌড়া এখানে এসেছেন জানতে বুঝতে, শক্তি সঞ্চয় করতে।
সেমিনার পরিচালনা করেন এআইকেকেএমএস-র সভাপতি এবং দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড সত্যবান।
বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এআইকেকেএমএস-র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে কমরেড সত্যবান ও কমরেড শঙ্কর ঘোষ। এআইকেএমএস-এর আশিস মিত্তাল, এআইকেএম-এর প্রেম সিং গলৌত। নেপাল থেকে এসেছেন এ বিশ্বকর্মা, বাংলাদেশ থেকে এসেছেন এ এইচ দুলাল। তাঁরা নানা দিক থেকে বললেন, কী ভাবে পুঁজিপতি, বহুজাতিকের স্বার্থে দেশে দেশে সাধারণ কৃষকদের উপর নির্যাতন চলছে। আজও তার প্রতিকার নেই। আশিষ মিত্তাল তথ্য তালিকা উল্লেখ করে বলেন, ‘ভারতে অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রির নামে সাধারণ চাষিদের শোষণের ব্যবস্থা ক্রমাগত পাকা করা হচ্ছে।’ প্রেম সিং গলৌত বলেন, ‘আমাদের লড়াই শুধু সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং আম্বানি-আদানির বিরুদ্ধে। দিল্লির কৃষক আন্দোলন এই বিষয়টা স্পষ্ট করে দিয়েছে।’
সেমিনারে আগত প্রতিনিধিদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা হল। আসামে কৃষি এবং কৃষি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত জনা পঞ্চাশেক প্রতিনিধি এসেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন কিতাব আলি। প্রায় ষাট বছর বয়স। চাষের কাজ করেন। বললেন, ‘ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙনে কৃষিজমি ধবংস হয়ে চাষিরা সর্বস্বান্ত হচ্ছে। সরকার কোনও ভ্রুক্ষেপ করছে না। বাধ্য হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিলে সেখান থেকে তাঁদের নির্মম ভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এমনিতেই ফসলের দাম পাওয়া যায় না, তার ওপর রয়েছে লাগাতার হাতির আক্রমণ। সেই আক্রমণে ফসলের সাথে প্রায়ই মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। কোনও সুরক্ষা নেই।’ কিতাব আলি জানালেন, ‘আমাদের সংগঠন লাগাতার আন্দোলন করছে। সাধারণ চাষিরা আকৃষ্ট হচ্ছে। সেমিনারে অনেকেই এসেছেন। ‘বাস্তবে, এই সম্মেলন প্রমাণ করল গত কয়েক বছরে দেশজুড়ে এআইকেকেএমএস-র অগ্রগতিকে। দেশের প্রায় সমস্ত রাজ্য থেকে প্রতিনিধি এসেছে। বিহারের মুঙ্গের থেকে চাষিরা এসেছেন। তাঁদের কেউ কেউ দিল্লির দীর্ঘ ধরনা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাঁদেরই একজন সুধীর যাদব। বললেন, ‘আমাদের সমস্ত দাবি মানতে বাধ্য করব বিজেপি সরকারকে। তারা পালাতে পারবে না। আমাদের কথা গোটা দেশের মানুষকে বলতে এসেছি, শুনতে এসেছি তাদের কথা। দেশের চাষিরা ভাল নেই, তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।’
সুধীরের শেষ কথাটায় কোনও বাড়াবাড়ি নেই। সরকারের রিপোর্ট দেখাচ্ছে, মহারাষ্ট্রে চাষিদের আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। শুধু ২০২২ সালেই সেখানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এক হাজারের বেশি কৃষক। ২০২১ সালের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশ প্রতি দিন অন্তত ১৫ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। কৃষিক্ষেত্রে আত্মহত্যার সংখ্যার সঙ্গেই পাল্লা দিচ্ছে আত্মঘাতী খেতমজুরের সংখ্যাও। ২০২১ সালের প্রতি দিন ভারতে গড়ে আত্মঘাতী হয়েছেন ১৫ জন খেতমজুর। অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’-র রিপোর্টেই রয়েছে কৃষক এবং খেতমজুরদের আত্মহত্যার ওই পরিসংখ্যান। যা গত বছরে দেশের মোট আত্মহত্যার পরিসংখ্যানের ৭ শতাংশেরও বেশি।
মোদি সরকার প্রকাশিত ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে ১০,৮৮১ জন কৃষক ও খেতমজুর আত্মঘাতী হয়েছেন। অর্থাৎ, কৃষিক্ষেত্রে প্রতি দিন গড়ে ৩০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বছরে মোট আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ৫,৩১৮ জন। আত্মঘাতী খেতমজুরের সংখ্যা ৫,৫৬৩ জন। ২০১৭ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে কৃষিক্ষেত্রে আত্মহত্যার এটি নয়া রেকর্ড।
তাই বীরভূমের মুরারইয়ের দুরিয়া গ্রামের চাষি সাদেক শেখ হাজির হয়েছেন সেমিনারে। ক্ষোভে ফুঁসছেন তিনি। বললেন, ‘সার-বীজের কালোবাজারি, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি সর্বনাশ করছে চাষিদের। আমরা প্রশাসনকে বলে বলে হতাশ। সরকার কোনও পদক্ষেপ করে না। লড়াই ছাড়া পথ নেই। এআইকেকেএমএস চাষিদের মধ্যে সেই বার্তা নিয়ে যাচ্ছে।’
সকলেই জানে, পঞ্চাশের দশকে এআইকেকেএমএস-এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কবাদী দার্শনিক এবং এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের প্রতিষ্ঠাতা সর্বহারার মহান নেতা শিবদাস ঘোষের শিক্ষায়। কৃষক ও খেতমজুর আন্দোলনে সঠিক কমিউনিস্ট বিপ্লবী লাইন প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনিই। শাসকশ্রেণি এবং তার তাঁবেদার সরকার এসব জানে। তাই এআইকেকেএমএস-র এই আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিঘ্ন ঘটাতে তারা কসুর করেনি। শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দিয়েছে আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি জো মোরম্যানের ভিসা। তিনি তার বক্তব্য লিখে পাঠিয়েছেন। সেখানে বলেছেন, ‘আমাকে অনুমতি দেওয়া হল না। এ অতি দুঃখজনক। দেশে দেশে শোষিত কৃষকের পারস্পরিক সংহতিকে ভয় পাচ্ছে বহুজাতিকপোষিত সরকার।’ কিন্তু সভাগৃহপূর্ণ সংগ্রামী প্রতিনিধিরা জানিয়ে দিলেন, কোনও ভাবেই বিপ্লবী কৃষক সংগঠন এআইকেকেএমএস-এর অগ্রগতিকে আটকানো যাবে না।