ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো (এন সি আর বি)–র ২০১৭ সালের বার্ষিক রিপোর্টটি প্রকাশিত হল ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর৷ সরকারি এই সংস্থার কাজ দেশের সমাজজীবনে সংঘটিত অপরাধগুলির সামগ্রিক এবং রাজ্যভিত্তিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা৷ প্রতিদিন নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা বৈদ্যুতিন মাধ্যম এবং খবরের কাগজে বের হয়৷ কিন্তু এই অপরাধগুলি সমাজজীবনে কতখানি ছড়িয়ে আছে, সেগুলি বাড়ছে না কমছে– তা তুলে ধরার কথা এই রিপোর্টে৷ ২০১৭–র আগে বিভিন্ন বার্ষিক রিপোর্ট সমাজ–পরিস্থিতির ভয়াবহ ছবিটা কিছুটা হলেও তুলে ধরেছিল৷
২০১৭ সালের বার্ষিক রিপোর্টটি প্রকাশ হল ২০১৯–এর শেষে, এন সি আর বি–র ৭০ বছরের ইতিহাসে যা কখনও ঘটেনি৷ দেরিতে প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও রিপোর্টটি অসম্পূর্ণ৷ গণপ্রহারে মৃত্যু, জাতপাতের সংঘর্ষের ফলে মৃত্যু, খাপ পঞ্চায়েতের নিদানে খুন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে গণধর্ষণ, গোরক্ষার নামে হত্যা, সাংবাদিকদের উপর হামলা সহ পঁচিশটি অপরাধ সম্পর্কে কোনও তথ্য রিপোর্টে প্রকাশিত হয়নি৷ কেন প্রকাশ করা হল না? ২০১৫ সালে মহম্মদ আখলাক ও পেহলু খানের গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার পরে এই ধরনের অপরাধের বিষয়টি রিপোর্টে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়৷ কিন্তু ২০১৬ সালের রিপোর্টেও এই বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশিত হয়নি৷ এরপর সেই সময়ের এনসিআরবি–র ডিরেক্টর ঈশ কুমারের অধীনে আলাদাভাবে গণপিটুনি ও ধর্মীয় কারণে খুনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করা হয়৷ তা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের রিপোর্টে এই বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া গেল না৷ খণ্ডিত এই রিপোর্ট দেখাচ্ছে আগের বছরের তুলনায় অপরাধের নথিভুক্তির মাত্রা ৩.৬ শতাংশ বেড়েছে৷ অপহরণের মাত্রা বেড়েছে ৯ শতাংশ৷ সমস্ত অপরাধের ক্ষেত্রেই শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ, দ্বিতীয় বিহার৷ মহিলাদের উপর অত্যাচারের ক্ষেত্রেও উত্তরপ্রদেশ শীর্ষে৷ দ্বিতীয় স্থানে মহারাষ্ট্র৷ দাঙ্গার ঘটনার ক্ষেত্রে প্রথম বিহার, তারপরে উত্তরপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র৷
পশ্চিমবঙ্গও পিছিয়ে নেই৷ হিংসার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় স্থানে এবং মহিলাদের উপর অত্যাচারের ক্ষেত্রেও তৃতীয় স্থানে৷ কিন্তু ধর্ষণের চেষ্টার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষ স্থানে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে যে পশ্চিমবঙ্গ আন্দোলন, শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে গোটা ভারতবর্ষকে পথ দেখাত, আজ লজ্জাজনক ভাবে জঘন্য অপরাধের ঘটনার সংখ্যায় তার নাম উপরে উঠে আসছে৷
সামগ্রিক ভাবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই ধরনের অপরাধচিত্র ভয়াবহ৷ এমনিতেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপে বিজেপি সরকার চূড়ান্ত ভাবে সমালোচিত৷ সামাজিক ক্ষেত্রেও দেশের এবং তাদের শাসিত রাজ্যগুলির এই ভয়াবহ চিত্র জনসমক্ষে প্রকাশ পেলে তা বিজেপির ‘রামরাজত্বে’র পর্দা ফাঁস করে দেবে, সে জন্যই কি নির্বাচনের প্রাকমুহূর্তে এই রিপোর্টের প্রকাশ আটকে দেওয়া হয়েছিল? চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে, বেকারি, ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধির কোপে মানুষ বিপর্যস্ত৷ কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন, শ্রমিকরা অর্থনৈতিক খাঁড়ার মুখে দাঁড়িয়ে, ব্যাঙ্কে সুদের হার কমছে শুধু নয়, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আমানতের সুরক্ষা পর্যন্ত থাকছে না৷ এই চূড়ান্ত অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জি’–র নামে ‘বিদেশি’ তকমা লাগিয়ে দেওয়ার হুঙ্কারে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ৷ এমনিতেই সংখ্যাগুরু ধর্মের জিগির তুলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণ, দলিতদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ বিস্ফোরক এই পরিস্থিতিতে এনসিআরবি–র রিপোর্টে যদি ভয়াবহ সামাজিক চিত্রটা প্রকাশ পায় তা হলে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে৷ তাই তথ্য চাপা দেওয়ার এই হীন প্রয়াস৷