করোনা মহামারিতে মরছে মানুষ, বিপর্যস্ত তাদের জীবন। কাজ নেই, রোজগার নেই, পরিবারের ভরণ-পোষণ, সন্তানদের পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ কোনও কিছুরই কোনও নিশ্চয়তা নেই। সরকার করোনার হাত থেকে জীবন বাঁচানোর কথা বলে আকস্মিক লকডাউন ঘোষণা করেছে, কিন্তু কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের বেঁচে থাকা, ঘরে ফেরার কোনও ব্যবস্থাই করেনি। তারা ধুঁকতে ধুঁকতে শত শত মাইল হেঁটেছে। রাস্তাতেই কতজন শেষ নিঃশ্বাসটুকু রেখে গেছে সরকার তার হিসাবটা পর্যন্ত রাখেনি! এই হল গত ৭ মাস ধরে ভারতের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের সংক্ষিপ্ত চিত্র। অন্য দিকে ধনকুবেরদের সেবাদাস হিসাবে তাদের সীমাহীন লুঠের সুযোগ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। শ্রমিক, চাষি সহ সর্বস্তরের খেটে-খাওয়া মানুষের উপর নেমে এসেছে ভয়াবহ আক্রমণ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া খেটে খাওয়া মানুষ তাই ডাক দিয়েছে ধর্মঘটের। ২৬ নভেম্বর দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘট। পড়ে পড়ে মার খাওয়ার বদলে প্রতিরোধের আগুন বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে বদ্ধপরিকর গোটা ভারতের মেহনতি জনগণ।
মহামারিতে বিপর্যস্ত মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়েছে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিমালিক ধনকুবের লুঠেরার দল। তাদের সেবাদাস হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকার সেই লুঠের পথ সুগম করতে এই সময়টাকেই কাজে লাগিয়েছে। তারা ঠিক এই সময়টাকে বেছে নিয়েছে রেল, প্রতিরক্ষা সহ অন্যান্য সরকারি বিভাগ এবং ব্যাঙ্ক, বিমা, বিদ্যুৎ, তৈলক্ষেত্র, ইস্পাত, টেলিকম, কয়লা সহ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের শিল্পগুলিকে একচেটিয়া মালিকদের হাতে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে। ইতিমধ্যেই দেশের ৬টি বিমানবন্দর আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। ১০৯টি রুটে ১৫১ জোড়া ট্রেনবেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন, রেল কারখানা, রেলের মাল পরিবহণ পরিষেবা বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্তও পাকা। রেলের সর্বাত্মক বেসরকারিকরণ শুধু যেন সময়ের অপেক্ষা। একই সাথে সড়ক পথ, আকাশপথ ও জলপথেরও মালিকানা চলে যাচ্ছে বেসরকারি হাতে। এর ফলে শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরির় নিরাপত্তা তো থাকবেই না। বিপুল পরিমাণে বাড়বে রেল সহ সমস্ত পরিবহণের ভাড়া এবং পণ্য মাশুল।
ব্যাঙ্ক থেকে ১০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়ে তা আত্মস্যাৎ করেছেন যে সব ভারতীয় ধনকুবের, সেই ঋণের বোঝা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে সরকার এনেছে ফিনান্সিয়াল সেক্টর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন বিল বা ‘এফএসডিআর-২০১৯’ বিল। যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে ওই সমস্ত ‘ব্যাঙ্ক লুঠেরা’ পুঁজিপতিদের হাতেই তুলে দেওয়ার রাস্তা খুলে যাবে। অনাদায়ী ঋণের বোঝায় ব্যাঙ্ক ফেল করলে সাধারণ আমানতকারীদের টাকা দিয়েই ব্যাঙ্কের দায় মেটানো হবে। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অনেক কষ্টে জমানো টাকার কোনও সুরক্ষা থাকবে না। একাধিক ব্যাঙ্কের মিলন (মার্জার), বহু শাখার ক্লোজার, ডাউনসাইজিং ইত্যাদির মধ্য দিয়ে হাজার হাজার ব্যাঙ্ক-কর্মচারী কাজ হারাবেন। করোনা মহামারির সুযোগে এই সর্বনাশা বিলকে কার্যকরী করতে চাইছে সরকার।
বিদ্যুতের মতো অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাকে পুরোপুরি একচেটিয়া মালিকদের যথেচ্ছ মুনাফা শিকারের ক্ষেত্রে পরিণত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এনেছে ‘বিদ্যুৎ বিল (সংশোধনী)-২০২০’। এর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ কর্মীদের চাকরির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা নেমে আসবে। সাধারণ গৃহস্থ গ্রাহক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিদ্যুতের বিপুল মূল্যবৃদ্ধিতে গভীর সমস্যার সম্মুখীন হবেন।
দেশের তথা জনগণের মালিকানাধীন প্রাকৃতিক সম্পদ– কয়লা, লোহা, তামা, অভ্র সহ সমস্ত খনিগুলি দেশি-বিদেশি পুঁজি-মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছে সরকার। জল-জমি-জঙ্গল সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের উপর স্বাভাবিক অধিকার হারাচ্ছে দেশের মানুষ। জ্বালানি তেল-গ্যাসের ব্যবসায় আগেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দেশি-বিদেশি বহুজাতিক পুঁজি-মালিকদের মুনাফার অবাধ রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ভারত পেট্রোলিয়ামের মতো লাভজনক তেল কোম্পানিকেও বেচে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
মালিক শ্রেণির স্বার্থে ৪৪টি শ্রম আইনকে পরিবর্তন করে ৪টি শ্রম কোডে (বিধি) রূপান্তরিত করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এতদিনশিল্প বিরোধ আইনে ১০০ বা ততোধিক শ্রমিক কাজ করলেই শিল্পে লে-অফ, ছাঁটাই, ক্লোজার করতে সরকারের অনুমতি নিতে হত। এখন থেকে তা প্রযোজ্য ৩০০ বা ততোধিক শ্রমিকযুক্ত কারখানায়। উন্নত প্রযুক্তির যুগে এখন ৩০০ শ্রমিক আছে, এমন শিল্পসংস্থাই কম। ফলে দেশের ৭০ শতাংশ কারখানা ও ৭৪ শতাংশ শ্রমিক এই আইনের বাইরে চলে গেল এবং মালিকদের অবাধ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সুযোগ করে দেওয়া হল। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও মাত্র তিন মাসের নোটিশে ছাঁটাইয়ের প্রশাসনিক নির্দেশ নিঃশব্দে জারি হয়েছে।
চা শিল্পের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জন্য এখনও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। বিড়ি শ্রমিক, নির্মাণ, মৎস্যজীবী, হকার, মোটরভ্যান, রিক্সা, টোটো চালক, মুটিয়া মজদুর, জরি, তাঁত শিল্পের শ্রমিক সহ অসংগঠিত শিল্পের কোটি কোটি শ্রমিক বাঁচার মতো মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড-ডে মিল, পৌর স্বাস্থ্যকম¹ সহ ১ কোটির বেশি স্কিম ওয়ার্কার সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা আজও পাননি।
কেন্দ্রীয় সরকার যে তিনটি কৃষি আইন সম্প্রতি এনেছে, তার ফলে ধান-গম-ডাল-তৈলবীজ-আলু-পেঁয়াজের মতো অত্যাবশ্যকীয় কৃষিপণ্যের অবাধ মজুতদারির ছাড়পত্র পেয়ে গেছে বৃহৎ মালিকরা। ফলে খুচরো বাজারে ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধিতে ইতিমধ্যেই নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। কৃষকদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বহুজাতিক পুঁজির খপ্পরে। বহুজাতিক মালিকদের ইচ্ছামতো দামে কৃষকরা ফসল বেচতে বাধ্য হবে, নতুন কৃষি আইন এ দেশের কৃষকদের সেই দিকেই ঠেলে দিয়েছে। কৃষি উপকরণ, সার বীজ, কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ থেকে শুরু করে সেচের জলের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ– সব কিছুতে কর্পোরেট কোম্পানির শর্তের কাছেই আত্মসমর্পন করতে হবে কৃষককে। আশার কথা পাঞ্জাব হরিয়ানা সহ দেশের নানা প্রান্তে এই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন কৃষকরা। তাঁরাও সমর্থন করেছেন শ্রমজীবী মানুষের এই ধর্মঘটকে।
১৯৯১ সাল থেকে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সংকট থেকে উদ্ধার পেতে নয়া উদারনীতিবাদী আর্থিক নীতি নিয়ে একটার পর একটা সরকার চলেছে। তাতে সংকট তো কাটেইনি বরং যত দিন গেছে তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। সংকট কাটানোর মরিয়া চেষ্টায় মালিক শ্রেণি শ্রমিক শ্রেণির ওপর আক্রমণের মাত্রা তীব্র করেছে। কোটি কোটি শ্রমিকের রক্ত-ঘাম ঝরানো শ্রমের বিনিময়ে সৃষ্ট সম্পদ ক্রমাগত মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের কুক্ষিগত হচ্ছে। মাত্র ১ শতাংশ ধনী কুক্ষিগত করেছে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ। বিজেপি সরকার তার কর্পোরেট প্রভুদের সেবায় এই বৈষম্যকে আরও বাড়তেই সাহায্য করছে। তাই দাবি উঠেছে– সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিককে নূ্যনতম ১৮ হাজার টাকা বেতন দাও, দুঃস্থ পরিবারগুলিকে মাসিক ৭৫০০ টাকা ভাতা দাও। দাবি উঠেছে গ্রাম শহরের সমস্ত কর্মক্ষম মানুষের জন্য কমপক্ষে ২০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি দিক সরকার। ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট এই দাবিকে বধির সরকারের কানে প্রবেশ করাবেই।
নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে একদিকে যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি মালিকদের যথেচ্ছ মুনাফার রাস্তা খুলে দেওয়া হচ্ছে। একই সাথে বিজ্ঞানসম্মত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার উপর এসেছে মারাত্মক আঘাত। ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে প্রকৃত ঐতিহ্যকে তুলে না ধরে ভারতকে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের আঁতুড়ঘর হিসাবেই বিশ্বের সামনে উপস্থিত করছে বিজেপি এবং তার পরিচালিত সরকার। পৌরাণিক গল্পকেই সত্য বলে চালানো হচ্ছে।
শোষিত মানুষের ঐক্য ভাঙতে বিজেপি সরকার জাতপাত, ধর্ম-বর্ণের বিভেদকে উস্কানি দিচ্ছে। দাঙ্গা লাগাচ্ছে। গো-কল্যাণের নামে, ধর্মের নামে পিটিয়ে মানুষ খুন করার মতো পৈশাচিক কাজেও সরকারি দলের প্রত্যক্ষ মদত আছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, দলিত সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন যেন সাধারণ ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার এনআরসি, এনপিআর, সিএএ-র মতো আইনের মধ্য দিয়ে দেশের নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ, বৈরিতাকে বাড়িয়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। পূর্ব-পাকিস্তান কিংবা পরবর্তী সময় বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ যাঁরা বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করছেন, এ দেশের উৎপাদনে ভূমিকা নিচ্ছেন তাঁদের জীবনকেও এর মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত করে তোলা হয়েছে।
একই সাথে বাড়ছে নির্যাতিতা নারীর আর্তনাদ। এই নির্যাতন রুখবে কি, উত্তরপ্রদেশ সহ নানা রাজ্যে বিজেপি সরকারের মন্ত্রী, প্রশাসন উঠে পড়ে লেগেছে ধর্ষকদের বাঁচাতে! বিজেপি নেতা এমনকি মুখ্যমন্ত্রীরা পর্যন্ত নারী-বিদ্বেষী মন্তব্য করে চলেছেন।
সব মিলিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া জনগণ, শ্রমিক-কৃষকের সামনে আজ একটাই পথ খোলা– সে পথ হল আন্দোলনের পথ। ধর্মঘট সারা দুনিয়ার খেটে খাওয়া নির্যাতিত মানুষের হাতে এক অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার। যে হাতিয়ারকে ভয় পায় শাসক শ্রেণি। তাই ধর্মঘটের কথা শুনলেই ওদের গেল গেল রব ওঠে। সমস্ত প্রচারযন্ত্র, প্রশাসনের নখ দাঁত নিয়ে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ধর্মঘট রুখতে। সেটাই প্রমাণ করে ধর্মঘটের আজকের দিনের প্রয়োজনীয়তা।
২৬ নভেম্বরের ধর্মঘটকে এ জন্যই সর্বাত্মক সফল করার কাজে গোটা ভারতের শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।