৫ আগস্ট সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের স্মরণ দিবস উপলক্ষে তাঁর ‘ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য’ পুস্তিকা থেকে একটি অংশ প্রকাশ করা হল৷
আপনি শত চেষ্টা করলেও আদর্শ, রুচি ও মূল্যবোধের কোনও একটি বিশেষ উন্নত মানকে একটি জায়গায় ধরে রাখতে পারেন না– তা সে শরৎচন্দ্র, নজরুল, রবীন্দ্রনাথের রুচির মানই হোক, আর বুদ্ধ, শঙ্করাচার্য, যিশুখ্রিস্ট কিংবা মহম্মদ, আর মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন– তাঁদের যে কোন তত্ত্ব এবং মূল্যবোধের ধারণাই হোক৷ তাকে একটা জায়গায় চিরস্থায়ী করতে গেলেই তা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়বে৷ আর একটি বিষয় আলোচনা করলে এই বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে৷ মানসিকতা বলতে আমরা কী বুঝি? চিন্তা এবং ভাব কী? আমরা জানি, একদিকে ব্যক্তি মস্তিষ্ক ও বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে নিয়ত দ্বন্দ্ব–সংঘাত অপরদিকে ব্যক্তি মস্তিষ্কের সাথে তার নিজস্ব সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার দ্বন্দ্ব– এই দুই দ্বন্দ্বের ফলেই ব্যক্তিচিন্তা ও মননশীলতার বিকাশ ঘটছে৷ সমাজের সমস্ত মানুষের এই চিন্তাগুলির বা মননশীলতার সাধারণীকরণের (জেনারালাইজেশন) মধ্য দিয়েই সামাজিক মানসিকতার সৃষ্টি, যাকে আমরা এককথায় সমাজমনন বা সমাজচিন্তা (social thinking) বলে থাকি৷ একদিকে এই সমাজচিন্তার ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও তার সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতি ও বহির্জগতের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই ক্রমাগত মানুষের মানসিকতার বিকাশ ও ভাবজগতের সৃষ্টি হয়ে চলেছে৷ এই দ্বন্দ্বকে কেউই এক জায়গায় বাঁধতে পারে না৷ সমস্ত মানুষের মননশীলতার এই যে দুই ধরনের দ্বন্দ্ব, একে যদি এক জায়গায় বাঁধতে পারতাম, তা হলে ভাবজগতকেও এক জায়গায় বাঁধা সম্ভব হত৷ তাই কোনও এক জায়গায় থামবার উপায় নেই৷ কাজেই যত প্রগতিশীল ভাবনা–ধারণাই হোক না কেন, তাকে চিরস্থায়ী করে এক জায়গায় দাঁড় করাতে গেলেই অমনি তার মানে অন্যরকম হয়ে দাঁড়ায়, তা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে৷
পূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি, গতি দুই ধরনের– যেটা সামনে ঠেলে তা প্রগতিশীল, আর যা আমাদের পেছন দিকে নিয়ে যায় তা প্রতিক্রিয়াশীল৷ আজকের সামাজিক প্রয়োজনে, অর্থাৎ প্রগতির পরিপূরক অর্থে যে আদর্শবাদ আজ সবচেয়ে উন্নত চেতনার মানকে নির্দেশ করছে– অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে, অর্থাৎ উৎপাদনের উপায় ও জীবনধারা পাল্টাবার সাথে সাথে যে নতুন প্রয়োজনবোধের জন্ম হচ্ছে, তার সঙ্গে তাল রেখে যদি আমরা আমাদের ভাবনা–ধারণা, চিন্তা, আদর্শবাদ ও মূল্যবোধ– এগুলোকে ক্রমাগত পাল্টাতে ও আরও উন্নত করতে না পারি, তাহলে কী হয়? তাহলে এক সময়ের প্রগতিশীল আদর্শ, পরবর্তী সময়ে আর একটা পরিবর্তিত অবস্থায় উৎপাদন ও জীবনপদ্ধতি পাল্টাবার সাথে সাথে নতুন প্রয়োজনবোধের মাপকাঠিতে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে৷ ফলে, তা আমাদের ক্রমাগত নিচের দিকে টেনে নামাতে থাকে৷ এইভাবে সমস্ত ভাবাদর্শের মূল্যায়ন করতে হয়৷ এই ভাবেই আদিম সমাজ থেকে মানুষের চিন্তা ও তার ভাবজগৎ স্তরে স্তরে একটাকে ছাড়িয়ে আর একটা উন্নত স্তরে উন্নীত হতে হতে আধুনিক চিন্তা ও ভাবনা–ধারণাগুলির আমরা সন্ধান পেয়েছি৷ একথা না মানলে, আমার একটা প্রশ্নের জবাব আপনারা কেউ দিতে পারবেন না বলে আমার ধারণা৷ যেমন ধরুন, বুদ্ধ, শঙ্করাচার্য, যিশুখ্রিস্ট, মহম্মদ– এই বিরাট মানুষগুলোর ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে মানবসমাজে উপস্থিতির কথা আমরা সবাই জানি৷ যাঁরা ধর্মপ্রাণ, তাঁরা অবশ্য ওঁদের ঈশ্বরের সন্তান মনে করেন, ঈশ্বর প্রেরিত দূত বলে মনে করেন, ‘প্রফেট’(prophet) মনে করেন৷ কিন্তু যাঁরা মানবতাবাদী, আধুনিক চিন্তায় যাঁরা উদ্বুদ্ধ, তাঁরা ওঁদের বিরাট পুরুষ, অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ বলেই মনে করেন৷ আজকাল আমরা যাঁদের কথায় কথায় বড় মানুষ বলে থাকি, তাঁদের সঙ্গে এইসব বিরাট মানুষগুলোর কোনও তুলনাই হয় না৷ তদানীন্তন পরিস্থিতিতে তাঁদের প্রতিভার যে প্রমাণ তাঁরা রেখে গেছেন, আমরা কয়জন আজকের পরিস্থিতিতে তুলনামূলক বিচারে সেই প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারছি৷ তবুও একটু খেয়াল করলেই একটা জিনিস আমাদের নজরে পড়বে৷ বুদ্ধ, শঙ্করাচার্য, মহম্মদের মতো বিরাট প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মননশীলতার দ্বারা, আজ যে আধুনিক চিন্তাধারা ও ভাবনা–ধারণাগুলো আপনারা লালনপালন করেন, তা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি৷ অত্যন্ত উঁচুমানের মননশীলতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা আধুনিক চিন্তা ও ধ্যান–ধারণাগুলোর জন্ম দিতে পারেননি৷ যেমন, গণতান্ত্রিক চেতনা, গণতান্ত্রিক সমাজগঠন, ‘সেকুলারিজম’ (ধর্মনিরপেক্ষতা), ‘সেকুলার হিউম্যানিজম’ (ধর্মনিরপেক্ষ বা পার্থিব মানবতাবাদ) প্রভৃতি ভাবনা–ধারণা ও মতাদর্শের কথা এবং এইগুলোকে ভিত্তি করে ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারীর স্বাধীনতা, ‘লিবার্টি’ ও ‘ফ্রিডম’ প্রভৃতি নতুন মূল্যবোধগুলোর কথা যদি ধরি, তা হলে দেখব, শিল্পবিপ্লব বা পুঁজিবাদী বিপ্লবকে কেন্দ্র করে উৎপাদন ব্যবস্থা পাল্টাবার সাথে সাথে এই যে সব আধুনিক ভাবনা–ধারণাগুলোর জন্ম হল– এগুলোর কথা এমনকী স্কুলের ছাত্ররাও আজকাল অল্পবিস্তর জানে৷ অথচ এইসব কিন্তু বুদ্ধ, মহম্মদ, শঙ্করাচার্য, যিশুখ্রিস্টের মতো প্রতিভাবানদের পক্ষেও চিন্তা করা সম্ভব হয়নি৷ এটা এজন্য নয় যে, প্রতিভা তাঁদের আমাদের থেকে কম ছিল, বা উচ্চচিন্তা তাঁরা করতে পারতেন না৷ এরূপ ঘটার কারণ এই যে, সমস্ত মানুষের চিন্তার ‘মেটেরিয়াল কন্ডিশন’ (বাস্তব পরিবেশ) আগে তৈরি হয় তবে তার ভাবজগতের সৃষ্টি হয়৷ এইখানেই মানুষের চিন্তাশক্তির আপেক্ষিক স্বাধীনতার সীমা৷ এই সত্য যারা মানে না, তাদের আমি একটা প্রশ্নের জবাব দিতে বলব৷ আজকের যেসব উচ্চ আদর্শবোধ বা আধুনিক ভাবনা–ধারণাগুলির আমরা অধিকারী, তাঁদের চিন্তায় সেদিন কেন তা জন্ম নেয়নি? চিন্তার সীমাহীন (absolute) স্বাধীনতায় যাঁরা বিশ্বাসী, যাঁরা মনে করেন ‘স্বাধীন চিন্তাসত্তা’ই ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ভাবজগতের সৃষ্টি করে চলেছে, তাঁদের আমার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে৷ এ প্রশ্নের সম্মুখীন হলেই তাঁরা বুঝতে পারবেন, চিন্তাশক্তির এই স্বাধীন সত্তার ধারণা মিথ্যা, অলীক৷ আসলে প্রত্যেকটি ব্যক্তিচিন্তারই একটা আপেক্ষিক স্বাধীনতা আছে এবং তার আবার একটা সীমাও আছে৷ সেই সীমাটা বাস্তব পরিবেশের (material condition) সীমা৷
তাহলে আমরা কী দেখছি? আপনার চিন্তা, আমার চিন্তা, অজয়দার (পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী) চিন্তা, বা যে কোনও ব্যক্তির চিন্তা– বাস্তবে আসলে এগুলো কী? কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির এই চিন্তাধারা গড়ে উঠছে? এটা বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে বোঝা দরকার, সমাজচিন্তা বলতে আসলে কী বোঝায়? ‘সোস্যাল থিংকিং’ বা সমাজ চিন্তা বলতে আমরা একটা বিশেষ সমাজের একটা সুনির্দিষ্ট আদর্শগত–সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে(distinct ideological-cultural category) বুঝিয়ে থাকি– যার মধ্যেই বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারা ও ভাবনা–ধারণার নিয়ত দ্বন্দ্ব–সংঘাত চলছে৷ কেন চলছে, কীভাবে চলছে– সে সম্বন্ধে যার যা তত্ত্বই থাকুক না কেন, বহু রকমের চিন্তা যে একটা সমাজচিন্তার পরিমণ্ডলের মধ্যেই রয়েছে– সে সম্বন্ধে বোধহয় কোনও দ্বিমত নেই৷ একটা বিশেষ পরিবেশ বা পরিস্থিতির মধ্যে নানা ভাবনা চিন্তা ও তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব–সংঘাত নিয়েই আমরা একটা সমাজচিন্তার পরিমণ্ডলকে বুঝিয়ে থাকি৷ সমস্ত মানুষের চিন্তায় সেই সমাজচিন্তারই ব্যক্তিকরণ ঘটছে, ‘পারসনিফিকেশন’ ঘটছে৷ ব্যক্তির মধ্য দিয়ে সমাজচিন্তার এই প্রকাশকেই (personified social thinking) আমরা বলি ব্যক্তি–চিন্তা৷ শঙ্করাচার্যের চিন্তাও এইভাবেই গড়ে উঠেছে৷ যিশুখ্রিস্টের চিন্তাও এইভাবেই গড়ে উঠেছে, মহম্মদের চিন্তাও এইভাবেই গড়ে উঠেছে৷ রাজা রামমোহন রায়, নজরুল, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তানায়কদের চিন্তাও এইভাবেই গড়ে উঠেছে৷ এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই৷ মানুষের মস্তিষ্কের সাথে সমাজ পরিবেশ ও বহিঃপ্রকৃতির দ্বন্দ্বের দ্বারা এটা সীমায়িত৷ সুতরাং, মানুষের ভাবজগৎ, অর্থাৎ মানুষের চিন্তা ও ভাবনা–ধারণার জগৎ বস্তু থেকেই গড়ে উঠেছে, বাস্তব পরিবেশ অনুযায়ী গড়ে উঠেছে৷ আবার মনে রাখতে হবে একইসাথে বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে তা দ্বন্দ্ব–সংঘাতময়৷ এরকম নয় ব্যাপারটা যে, উৎপাদনের উপায় ও জীবনধারণের পদ্ধতি পাল্টাচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের মন ও ভাবনাগুলো পাল্টে যাচ্ছে৷ এরকম ধারণা ভুল৷ এরকম যান্ত্রিক নয় ব্যাপারটা৷ দু’য়ের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক৷ যদিও বস্তুগত উৎপাদনের উপরকাঠামো (superstructure) হিসাবেই মানুষের ভাবগত উৎপাদন বা ভাবজগৎ গড়ে উঠেছে, সমাজচিন্তা জন্ম নিচ্ছে, এই ভাবজগৎ এবং সমাজচিন্তা আবার বাস্তব পরিবেশের পরিবর্তনের ধারায় ক্রমাগত তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছে৷ কিন্তু কোনও অবস্থাতেই মানুষের ভাবজগৎ একটা নির্দিষ্ট বাস্তব পরিবেশের(given material condition) পরিধিকে অতিক্রম করে যেতে পারে না– তার সীমাকে অতিক্রম করতে পারে না৷ এবং পারে না বলেই অতীতের কোনও মনীষীর পক্ষেই আধুনিক চিন্তা ও ভাবনা–ধারণাগুলির জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়নি৷ …
মানবতাবাদের আগে গড়ে ওঠা প্রায় সমস্ত মতাদর্শগুলো ঐশ্বরিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপরই প্রতিষ্ঠিত৷ অর্থাৎ সমস্ত মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, তাই সমস্ত মানুষের প্রতি প্রেম ও মমত্ববোধই ছিল এইসব ভাবাদর্শগুলির মূল কথা৷ ঈশ্বরের স্বীকৃতি থেকেই কতকগুলো মূল্যবোধের সৃষ্টি– যাকে আমরা দর্শনের ভাষায় ‘প্রায়রি ভ্যালু’ বা পূর্ব নির্ধারিত নীতিবোধ বলে থাকি৷ আর মানবতাবাদ, অর্থাৎ বুর্জোয়া মানবতাবাদ সেদিন যে মূল্যবোধের জন্ম দিয়েছিল সেগুলি মূলত গড়ে উঠেছিল মানুষকে কেন্দ্র করে৷ মানুষের সত্যিকারের প্রয়োজন ও সামাজিক চেতনাই ছিল সেদিন এই মূল্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু৷ ধর্মীয় ভাবধারা ও অতিপ্রাকৃত সত্তার স্বীকৃতিজনিত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এই মানবতাবাদই প্রথম মানুষের সমাজে ‘সেকুলার’ এবং গণতান্ত্রিক ভাবনা–ধারণা ও মূল্যবোধ নিয়ে এলো৷ সেকুলার কথাটার বাংলা মানে পার্থিব৷ তাই সমস্ত সেকুলার ধারণার শুরুই অতিপ্রাকৃত সত্তার অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে (all secular concepts start with the non-recognition of any supernatural entity)৷ কিন্তু ভারতবর্ষে, আমাদের দেশে সেকুলার রাষ্ট্রের বর্তমানে মানে দাঁড়িয়েছে সমস্ত ধর্মে সমান উৎসাহদান৷ এরকম ঘটার পিছনে দেশের রাষ্ট্রনায়কদের, তত্ত্ববিদদের ও রাজনৈতিক নেতাদেরই যে মিলিত কৃতিত্ব রয়েছে– এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷ কিন্তু আমরা হয় অজ্ঞতাবশত ভুল করছি, আর না হয় ইচ্ছা করেই ভুলে বসে আছি যে, সেকুলার রাষ্ট্র গঠনের ধারণাটি গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্র, সমাজজীবন, অর্থনৈতিক জীবন, রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন– সমস্ত কিছুকে চার্চের প্রভাব বা ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য৷ জীবন সম্পর্কিত পার্থিব গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা(secular concept of life) এবং পার্থিব মানবতাবাদের এই হল ভিত্তি৷ কংগ্রেসি রাষ্ট্রনায়ক ও বুর্জোয়া চিন্তাবিদদের কথা বুঝতে পারি৷ কিন্তু বহু তথাকথিত মার্কসবাদী ও কমিউনিস্ট নেতাদের চিন্তা, ভাবনা–ধারণা, প্রতিদিনের আচরণ ও ধর্মানুষ্ঠানগুলোর প্রতি ক্রমবর্ধমান পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে সেকুলারিজম সম্বন্ধে যে ধারণা প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে সত্যিই অবাক হতে হয়৷ এইসব নেতারা মিলে আমাদের দেশে ‘সেকুলার স্টেট’–এর মানে যা দাঁড় করিয়েছেন, তাতে যে–কোনও চিন্তাশীল ব্যক্তির মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন দেখা দেবে৷ ইসলাম ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে বলে আমরা পাকিস্তানকে বলব ইসলামিক ধর্মীয় রাষ্ট্র(Islamic theocratic state)৷ আর যদি সকল ধমের্র পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহদানই ভারত রাষ্ট্রের কাজ হয়, তা হলে তাকে একটি বহুধর্মীয় রাষ্ট্র(multi-theocratic state) ছাড়া আর কী বলা চলে?
সেকুলার গণতন্ত্রের, সেকুলার গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রার মূল নীতিগুলি কী? সেকুলার ভাবনা–ধারণা বা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রার মূল নীতিগুলো গড়ে তোলার ব্যাপারে শিক্ষা যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে– এ কথা বোধকরি কেউ অস্বীকার করবেন না৷ তা হলে এটাই তো স্বাভাবিক যে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে শিক্ষা সবসময় ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধগুলোকে তুলে ধরবে৷ যদি সত্যসত্যই ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মর্যাদা দিতে চাই তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবশ্যই ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে হবে৷ কিন্তু আমরা আমাদের এই তথাকথিত সেকুলার রাষ্ট্রে বাস্তবে কী দেখছি? শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করা তো দূরের কথা, শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় প্রভাব, শিক্ষানুষ্ঠানগুলিতে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের আধিক্য, এমনকী পাঠ্যপুস্তকগুলিতে ধর্মীয় প্রচার দিনের পর দিন ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে৷ তাই শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষাব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণের দাবিতে যাঁরা আজ আন্দোলন পরিচালনা করছেন, তাঁদের প্রথমেই দুটো জিনিস পরিষ্কার করে বুঝতে হবে৷ প্রথমত শিক্ষাকে ধর্মীয় ভাবধারা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে হবে৷ দ্বিতীয়ত শিক্ষা সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি– পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির জন্য শ্রমিক শ্রেণি ও অন্যান্য শোষিত জনসাধারণের প্রতিদিন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে লড়াই চলছে, তার পরিপূরক কি না বিচার করে দেখতে হবে৷ এ দু’টি মাপকাঠির ভিত্তিতেই শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষাব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কোনও একটি আন্দোলন প্রগতিশীল কি প্রতিক্রিয়াশীল– তা বিচার করে দেখতে হবে৷ আমাদের দেশে শিক্ষার সংস্কার নিয়ে বহু কমিশন বসেছে৷ এই সব কমিশনগুলো শিক্ষা ব্যবস্থার নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে পাতার পর পাতা সুপারিশে ভর্তি করে ফেলেছে৷ কিন্তু সমস্যাটির আসল জায়গায় ঘা দেওয়া এদের পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ তাই আজ দেশের অভ্যন্তরে নৈতিকতার অধঃপতনের আসল কারণটি নেতারা কেউই ঠিকমতো ধরতে পারছেন না৷ বহু চিন্তাশীল ব্যক্তি ও অনেক রাজনৈতিক নেতার ধারণা, আমরা সব ঠিকমতো আচরণ করছি না, তাই এরকম কাণ্ড হচ্ছে৷ যাঁরা সৎ, যাঁরা সত্যিই সমস্যাটা ধরবার চেষ্টা করছেন, যাঁরা ভাবছেন মানুষগুলো ঠিকমতো আচরণ করছে না, ব্যক্তিগত আচরণবিধি নেই,– সত্যিই নেই– রাজনীতিতে নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই, প্রশাসনে নেই, আমি তাঁদের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই৷ এটা যে নেই একথা সবাই অনুভব করছেন, আমরাও করছি৷ কিন্তু নেই কেন? এই তো সেদিন স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তোমরা নেতারা ছাত্রদের বলেছিলে, ‘ফ্লাওয়ার্স অব বেঙ্গল’৷
তারা দলে দলে ‘কেরিয়ার’ ছেড়ে, কোনও পিছু ডাকে কান না দিয়ে, তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ মাস্টারমশাইদের সেদিন আদর্শ পুরুষ মনে করত ছাত্ররা৷ আজকে তাঁদের মনে করে না কেন? সেইসব ছাত্র কোথায় হারিয়ে গেল? তাহলে কি এ কথাই মানতে হবে, তখন ঈশ্বর আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন, তাই আমাদের সব ঘরে ঘরে সুপুত্র পাঠাতেন, এখন আমাদের প্রতি বিগড়ে গেছেন কাজেই বেছে বেছে যত কুপুত্র আমাদের ঘরে ঘরে পাঠাচ্ছেন? আপনারা নিশ্চয়ই কেউ এভাবে ভাবেন না৷ তা হলে গোটা দেশের মানসিকতা বিগড়ে গেল কী করে? নৈতিকতার মান ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে কেন? আমরা তো নৈতিকতার মান বাড়াতেই চাইছি৷ আমরা তো বলছি, দেশকে রক্ষা কর, পরিশ্রম কর, সৎ হও৷ কিন্তু, যত বলছি সৎ হও, পরিশ্রম কর, তত মানুষ মোটা অর্থে প্রয়োজনবাদী হয়ে পড়ছে৷
(২৬ মে, ১৯৬৯)
(৭০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ২০ জুলাই, ২০১৮)