‘‘এ দেশের আদালতে গরিব মানুষের পক্ষে বিচার পাওয়া কঠিন। এই বিচারব্যবস্থা ধনী ও গরিবকে সমান দৃষ্টিতে দেখে না।”–মন্তব্য ওড়িশা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এস মুরলীধর-এর।
বৈষম্যবিরোধী একটি সংগঠন আয়োজিত আলোচনাসভায় গত ১৪ এপ্রিল বিচারপতি মুরলীধর এ দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, আদালতে ন্যায়বিচার পেতে এদেশে প্রান্তিক মানুষদের অনেক বাধার সামনে পড়তে হয়। এমনকি শিক্ষিত মানুষের কাছেও এদেশের আইন-কানুন এবং বিচারপদ্ধতি রহস্যময় ঠেকে। এই বিচারব্যবস্থা ধনীর জন্য একরকম আর গরিবের জন্য আর একরকম ভাবে কাজ করে। পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি দেখান, বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তফসিলি জাতি, ওবিসি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে যাঁরা সমাজের নীচের তলার।
লিগাল এইড সার্ভিস সম্পর্কে বিচারপতি মুরলীধর মন্তব্য করেন, এখান থেকে পাওয়া বিনামূল্যের পরিষেবা যেন রেশন দোকান থেকে পাওয়া জিনিসপত্রের মতো, যার মান ভালো হবে বলে কেউ আশা করে না। কারণ, কম দামে বা বিনামূল্যে কিছু পাওয়াকে এ দেশের গরিব মানুষ নিজেদের অধিকার বলে ভাবতে পারেন না, ভাবেন এটা রাষ্ট্রের দয়া-দাক্ষিণ্য। তিনি বলেন, তফসিলি জাতি-উপজাতির মানুষ, দলিত, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা সামাজিক ও আর্থিক ভাবে এবং শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মানুষ, আদালতে যথেষ্ট বৈষম্যের শিকার হন। ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তিতে যুক্ত মানুষজনকে এবং মানসিক ভাবে অসুস্থ কিংবা ফুটপাতবাসীদের সাধারণ আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বলেই ভাবা হয়। এদের ক্ষেত্রে আদালতের আচরণ হয় বৈষম্যমূলক। ফলে এঁদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতি দূর করতে সদিচ্ছা ও সদর্থক নীতি নিয়ে রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি। কিন্তু ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানেন, বর্তমান শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধনী-গরিবের এই বৈষম্য সমাজের কোনও ক্ষেত্র থেকেই দূর করা সম্ভব নয়। সাম্যের জয়ধ্বনি দিয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের জন্ম হলেও, নিজের শোষণমূলক চরিত্রের জন্য শুরু থেকেই এই ব্যবস্থায় বৈষম্য মাথা চাড়া দিয়েছে।
বিকাশের যুগ পার হয়ে এই ব্যবস্থা আজ যখন মরতে বসেছে, তখন অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমাজ সহ সর্বক্ষেত্রেই ধনী-গরিবে বৈষম্য এক বীভৎস রূপ নিয়েছে। হাজারো সদিচ্ছা থাকলেও এই রাষ্ট্রকাঠামো বজায় রেখে আইন-ব্যবস্থার বৈষম্য ঘোচানো সম্ভব নয়। তাই এদেশে টাকা যার, ন্যায়বিচার তার। তবে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম একটি স্তম্ভের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েও বিচারপতি এস মুরলীধর যেভাবে সাহসের সাথে এই সত্য প্রকাশ্যে তুলে ধরেছেন, তার জন্য তিনি অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য।