স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে প্রতিরক্ষা খাতে প্রতি বছরই বাজেট বরাদ্দ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে৷ পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের পথে হেঁটেই বিজেপি সরকার ২০১৭ সালে যে বিপুল অর্থের যুদ্ধসামগ্রী আমেরিকা রাশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানি করেছে তা বিশ্বে সর্বোচ্চ আর সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দের নিরিখে ভারতের স্থান বিশ্বে পঞ্চম– আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব, রাশিয়ার পরেই৷ গত বছর সামরিক খাতে ভারতের খরচ কত হয়েছে? ৪ লক্ষ ২৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা৷ (সূত্র : সিপ্রি রিপোর্ট)৷ দেশের পুরনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার খোল–নলচে পাল্টে আধুনিকীকরণের জন্য নাকি এ খরচ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে
প্রতিরক্ষা কথাটির অর্থ– দেশ বা রাষ্ট্রের রক্ষা ব্যবস্থা৷ কিন্তু দেশ মানে তো একটা ভূখণ্ড মাত্র নয়– প্রকৃত অর্থে সেই ভূখণ্ডের মানুষ৷ সেই জনগণের সুরক্ষা তথা জীবনযাত্রার মান কেমন?
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে৷ লক্ষ লক্ষ কারখানা বন্ধ, চালু শিল্পগুলিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ কর্মসংস্থানের পরিবর্তে চলছে তীব্র কর্মসংকোচন৷ ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে চাষিরা আত্মহত্যা করছে৷ মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরছে৷ মহিলাদের উপর নির্যাতন–খুন–ধর্ষণ বেড়ে চলেছে৷ কোথায় তাদের সুরক্ষা? পাশাপাশি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র ৩ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ২ শতাংশ৷ তাহলে দেশের জনগণকে রক্ষা করা কি সরকারের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্য নয়?
প্রতিরক্ষায় বিপুল খরচের প্রশ্ন উঠলেই অবধারিত জবাব আসে– এত বড় দেশ, শুধু সীমান্ত রক্ষার খরচই তো বিরাট৷ শুধু কী তাই আছে পাকিস্তান–চীনের মতো ‘দুষ্ট’ প্রতিবেশী৷ যে কোনও মুহূর্তে ভারত নাকি আক্রান্ত হতে পারে৷ কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে সীমান্ত সংঘর্ষ ও সন্ত্রাস তো লেগেই আছে অথচ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসার সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ বাস্তবে তার বিপরীতে গিয়ে নিয়ত যুদ্ধাতঙ্কের আবহ তৈরির চেষ্টা চলছে৷ মুখে চীনকে দেশের শত্রু হিসাবে খাড়া করা হচ্ছে, অথচ প্রধানমন্ত্রী–বিদেশ চীন সফর, দুই দেশের মন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠক, চুক্তি ঘটেই চলেছে৷
তথ্য পরিসংখ্যান বলছে নির্মমভাবে শোষিত হতে হতে শিল্পদ্রব্য কেনার মতো অর্থ দেশের সাধারণ নিম্নবিত্ত ও গরিব জনগণের পকেটে নেই৷ ফলে শিল্পপতি–পুঁজিপতির উৎপন্ন দ্রব্য বেচার বাজার পাচ্ছে না৷ তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাহিদা তৈরি করা চাই– এমন চাহিদা, যার জন্য জনগণের চাহিদার উপর নির্ভর করতে হবে না৷ একমাত্র সরকার যদি ক্রেতা হয়, অর্থাৎ সরকারই অর্ডার দেবে, সরকারই রাজকোষের অর্থ দিয়ে তা কিনে নেবে, তবেই এটা হতে পারে৷ সেটা হল অস্ত্র ও সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অর্ডার৷ তাই ‘দেশপ্রেমিক’ মালিকদের স্বার্থে ‘দেশপ্রেমী’ সরকারের প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি৷ এরই নাম ‘অর্থনীতির সামরিকীকরণ’৷
বিজেপি ক্ষমতায় এসে গোটা প্রতিরক্ষা উৎপাদনটাকেই পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে৷ আম্বানি টাটা বিড়লা মাহিন্দ্রা অশোক লেল্যান্ড প্রভৃতি বড় বড় কোম্পানিগুলিও এখন আধুনিক অস্ত্র ও বিভিন্ন রকমের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করছে৷ কোম্পানিগুলি যাতে উন্নত দেশগুলির সর্বাধুনিক অস্ত্রের প্রযুক্তি পেতে পারে তাই সরকার উদ্যোগী হয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প ঘোষণা করেছে, যেখানে বিদেশি অস্ত্র উৎপাদক কোম্পানিগুলির সাথে দেশীয় কোম্পানিগুলি যৌথভাবে অস্ত্র উৎপাদন করবে৷ আমেরিকা–ইজরায়েল–ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলির সাথে ইতিমধ্যেই এমন চুক্তি হয়েছে৷ উৎপাদিত এই সব অস্ত্র যেমন সরকার কিনে নেবে তেমনই উদ্বৃত্ত অস্ত্র কোম্পানিগুলি বিক্রি করবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলির কাছে এবং তাদের উপর ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দাদাগিরি এবং ব্যবসার বাজার হাসিল করবে৷ এর মধ্যে কোথায় দেশরক্ষা? কোথায় দেশপ্রেম? এ তো স্রেফ ব্যবসা– অস্ত্র ব্যবসা৷ আমেরিকা–রাশিয়া–ফ্রান্স-ইজরায়েলর সাথে ভারতের সাম্প্রতিক তথাকথিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিত এখানেই নিহিত৷ যার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যুদ্ধের আবহ তৈরি করা এবং দুনিয়াজোড়া সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন পরিকল্পনাকে শক্তিশালী করা৷ এর সাথে জনস্বার্থের সম্পর্ক কী? জনগণ কি যুদ্ধ চায়? চায় না৷ চায় প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক৷ চায় জনগণের জীবন মানের সত্যিকারের উন্নয়ন ও বিকাশ৷
(৭০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৭জুন, ২০১৮)